মেয়েদের পোশাকে পকেট কম থাকে কেন

মেয়েদের পোশাকে এখন পকেট ফিরে আসছেছবি: গেটি ইমেজেস, বিবিসি থেকে নেওয়া

তুমি হয়ত খেয়াল করেছ, ছেলেদের জিনসের পকেটে মোবাইল, মানিব্যাগ, চাবিসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অনায়াসে রাখা যায়। অথচ মেয়েদের জিনসের প্যান্টের পকেটে মোবাইলটাই ঠিকমতো রাখা যায় না। শুধু যদি পকেটের কথা বলি, তাহলে বলা যায় মেয়েদের রেডিমেড পোশাকে পকেটের চল খুব একটা দেখাই যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের পোশাকের পকেটগুলো হয় খুব ছোট, নয়তো তা কেবলই নকশার জন্য। ছেলেদের পোশাক দেখে মনে হয় প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত পকেট। মেয়েদেরও তো মোবাইল, মানিব্যাগসহ নানা কিছু রাখা প্রয়োজন। তবে কেন এমন করে পোশাক বানানো হয়? এটা কি শুধু ফ্যাশনের ব্যাপার, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?

কেন মেয়েদের পোশাকে পকেট কম থাকে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সবার আগে মনে আসে সহজ একটি উত্তর। তা হলো মেয়েরা তো হ্যান্ডব্যাগ বা পার্স ব্যবহার করে। তাই তাদের পকেটের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিষয়টি এত সরল নয়। এটি একটি কারণ হলেও এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের ইতিহাস। কেন মেয়েদের পোশাকে ছেলেদের মতো পকেট থাকে না সেই প্রশ্নের আসল উত্তর জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের সেই সময় যেখানে পকেটের এই বৈষম্যের জন্ম হয়েছিল। আর এই ইতিহাসের সঙ্গে পার্সের ব্যবহারেরও একটি গভীর সম্পর্ক আছে।

আরও পড়ুন
পোশাকে পকেট ছিল না, মানুষ তখন থলে ব্যবহার করত
ছবি: সিএনএন থেকে

আজ আমরা পোশাকে যে পকেট দেখি এর জন্ম হয়েছিল অনেক আগে। একসময় পকেট কিন্তু পোশাকের অংশ ছিল না। মধ্যযুগে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন মুদ্রা বা চাবি একটি ছোট থলেতে রাখত। সেই থলেটি কোমরে দড়ির সাহায্যে বেঁধে রাখত তারা। সপ্তদশ শতকে পোশাকে বড় পরিবর্তন এল। পুরুষদের পোশাকে প্রথমবারের মতো সরাসরি পকেট সেলাই করার চল শুরু হলো। জ্যাকেট, ওয়েস্টকোট বা প্যান্ট সবকিছুতেই এমনভাবে পকেট যুক্ত করা হলো, যেন তারা সহজেই ঘড়ি, রুমাল কিংবা মুদ্রা বহন করতে পারে। এভাবেই শুরু হলো পোশাকের সঙ্গে পকেটের ব্যবহার। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই সময়ে নারীরা তাদের স্কার্টের ভেতরে আলাদাভাবে একটি থলে বেঁধে রাখতেন। যা জনসমক্ষে ব্যবহার করা ছিল বেশ কঠিন।

আঠারো শতকের শেষের দিকে ফরাসি বিপ্লবের কারণে পোশাকের জগতে বিশাল পরিবর্তন আসে। লম্বা আর ভারী গাউন ঘরানার পোশাকের বদলে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হালকা ও আরামদায়ক স্লিমফিট পোশাক। নারীদের পোশাক দুই-তিন স্তর থেকে এক স্তরে নেমে আসায় স্কার্টের ভেতর থলে বেঁধে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ল। ঠিক এই সময়েই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বহন করার জন্য প্রচলন শুরু হয় হাতব্যাগের।

আরও পড়ুন

ফরাসি বিপ্লবের যুগ শুধু রাজনীতিতেই পরিবর্তন আনেনি। পোশাকের জগতেও এনেছিল এক নতুন নিয়ম। এই সময়েই পকেট হয়ে উঠল ছেলেদের পোশাকের খুবই জরুরি এক অংশ। জ্যাকেট, শার্ট, প্যান্ট সবকিছুতেই দেখা গেল প্রয়োজনের চেয়েও বেশি পকেট। কিন্তু মেয়েদের পোশাকে দেখা গেল উল্টোটা। মেয়েদের যে পোশাকে আগে কিছু পকেট ছিল তা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল। ফলে নারী ও পুরুষের পোশাক আলাদা করার জন্য ব্যবহার শুরু হলো পকেটের।

মনে করা হয় এমনটা করার পেছনে দুটি বড় কারণ ছিল তখন। প্রথমটা অর্থনৈতিক। মনে রাখতে হবে, সে সময়ের সমাজব্যবস্থায় পুরুষতান্ত্রিকতা এখনকার চেয়ে আরও দৃঢ় ছিল। সে সময় বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কাজ ও কেনাকাটা করতেন পুরুষরা। তাই তাদের পকেট দরকার ছিল। অনেকেই মনে করেন, এটি ছিল নারীদের ক্ষমতা দমিয়ে রাখার একটি উপায়। পোশাক থেকে পকেট সরিয়ে দিয়ে তাদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখা হতো। যাতে তারা পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল থাকেন এবং স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করতে না পারেন। এই মানসিকতা ছিল দ্বিতীয় কারণ। মূলত সে সময়ের সমাজের এই ধারণা থেকে মেয়েদের পোশাকে পকেটের ব্যবহার তেমন একটা দেখা যেত না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলেছে।

আরও পড়ুন

এই বৈষম্যের পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। তারা বুঝতে পেরেছিল যে পকেটযুক্ত পোশাক জনপ্রিয় হলে হাতব্যাগের চাহিদা কমে যাবে। তাই তারা এমনভাবে প্রচারণা চালালেন যে, নারীদের পোশাকের সুন্দর ও সরু আকৃতি বজায় রাখতে পকেট বাদ দেওয়া জরুরি। তারা যুক্তি দিলেন, পকেট থাকলে নারীদের পোশাকের সৌন্দর্য নষ্ট হবে। এভাবে সৌন্দর্য আর ফ্যাশনের দোহাই দিয়ে পকেটকে নারীদের পোশাক থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। ফলে নারীরা পকেটবিহীন পোশাক পরতে বাধ্য হলেন। আর নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বহন করতে হ্যান্ডব্যাগ ব্যবহার করতে বাধ্য হলেন। যা হয়ে উঠল নতুন ফ্যাশন।

বর্তমানেও পরিস্থিতি যে খুব বেশি বদলেছে তা বলা যাবে না। যদিও নারীদের পোশাকে এখন পকেট দেখা যায়, কিন্তু সেগুলো হয় খুব ছোট, না হয় শুধু নকশা। তবে এখন অনেক ফ্যাশন ডিজাইনার নারীদের পোশাকে পকেট নিয়ে কাজ করছেন। বর্তমানে #WeWantPockets নামের একটি হ্যাশট্যাগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

সূত্র: বিবিসি, সিএনএন

আরও পড়ুন