কিশোর আলোর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যা হলো

অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথি, কিশোর আলোর পাঠক, স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মীরা সবাই মিলে একসঙ্গে কেক কাটেনতানভীর আহম্মেদ

এখন তো হুটহাট বৃষ্টি হচ্ছে। আর বৃষ্টি হলেই ঢাকায় আটকে যায় যানজটে। কেন এমন হয় জানো? কারণ, বৃষ্টি নামলেই ট্রাফিক পুলিশ ছাতা নিতে দৌড়ায়! কিশোর আলোর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এই কৌতুক শোনান জনপ্রিয় রম্যলেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব। বৃষ্টির সময়ের ট্রাফিক পুলিশের মতোই কিআর জন্মদিনে দৌড়ে দৌড়ে হাজির হন কিআর পাঠক ও অনুরাগীরা। ১ অক্টোবর কিআর জন্মদিনের ছোট্ট পার্টি একদম জমে ওঠে গুণীজনদের অংশগ্রহণে।

কিশোর আলোর জন্মদিন শুরু হয় কিআ সম্পাদক আনিসুল হকের গল্পমুখর শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়ে। তিনি কিআর অফিসে টাইম ট্রাভেল করে আসা আইনস্টাইনকে নিয়ে মজার গল্প শোনান। তিনি জানান, কিআতে কাজ করে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের দল কীভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে এবং এখন নিজেদের সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছে। এক যুগে কিআ পাঠ্যবইয়ের গৎবাঁধা পড়ার বাইরে স্বস্তির জায়গায় পরিণত হয়েছে। আনিসুল হকের বক্তব্য শেষ হয় সভাকক্ষে উপস্থিত সবাই মিলে ‘হ্যাপি বার্থডে টু কিআ’ বলার মাধ্যমে। এরপর প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা ‘আমরা সবাই রাজা’ গানের কিছু অংশ গেয়ে শোনান, তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলায় শিশু-কিশোরেরা। এই ‘আমরা সবাই রাজা’ ধ্বনিতেই কিআর জন্মদিনের মূল উৎসব শুরু হয়।

আরও পড়ুন
কমিকস আঁকার কিছু নিয়ম নিয়ে কিশোর আলোর পাঠকদের পরামর্শ দেন আহসান হাবীব
তানভীর আহম্মেদ

এরই মধ্যে কিশোর আলোর (কিআ) ১২তম জন্মদিনের জন্য তৈরি রংবেরঙের টি-শার্টে ছেয়ে যায় পুরো সভাকক্ষ। কালো, লাল, ধূসর, সাদা থেকে সবুজ—সব রঙের টি-শার্টের সমাহারে কিশোর আলোর জন্মদিনের জন্য শুভেচ্ছা জানান রম্যলেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব। তিনি নিজের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তাঁর কাছে এখন অনেক মা–বাবা এসে জানান যে তাঁদের বাচ্চারা এখন কমিকস পড়তে জানে না। কেন বাচ্চারা কমিকস পড়তে জানে না—এই ভাবনা থেকে তিনি বুঝতে পারেন, মুঠোফোনে স্ক্রল করতে করতে শিশুদের ওপর থেকে নিচের দিকে পড়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। কমিকসের জিগজ্যাগ প্যাটার্ন অনেকে ধরতে পারে না। এই প্রসঙ্গে আহসান হাবীব পরামর্শ দেন যে আমাদের ডিজিটাল মাধ্যম থেকে কিছুটা সরে আসতে হবে। তিনি কমিকস আঁকার কিছু নিয়ম নিয়েও আলোচনা করেন, বিশেষ করে সিক্স প্যানেল বেসিক ও শেষ প্যানেলে ক্লাইম্যাক্স আনার বিষয়টি বুঝিয়ে দেন। আর এর জন্যই আছে কিশোর আলো। কিশোরদের জন্য এমন একটি রঙিন পত্রিকা আছে এবং এটি ১২ বছর ধরে চলছে, এটা আশার সংবাদ। সবশেষে তিনি কিআকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি কিছু কৌতুকও শোনান।

কিআর জন্মদিনের এই আয়োজনে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ উপস্থিত ছিলেন
আব্দুল ইলা

এরপর কিশোর আলোকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান বন্ধুসভার নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ। প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফও উপস্থিত ছিলেন কিআর জন্মদিনের এই আয়োজনে। তিনি বলেন, এখনকার পৃথিবীতে সবকিছুর গতি খুব বেশি, তাই আমাদের ধৈর্যের দরকার। তিনি আরও মন্তব্য করেন, এখনকার গতানুগতিক পড়াশোনা হয়তো শিশুদের সুনাগরিক হতে শেখায়, কিন্তু ভালো মানুষ হতে শেখায় না। তাই তিনি কিশোর-কিশোরীদের বেশি বেশি বই পড়ার পরামর্শ দেন। এরপর দুটি লোকসংগীত পরিবেশন করে ‘আপনঘর’ ব্যান্ড। তাদের গাওয়া গান ‘তোমায় আমি পাইতে পারি বাজি’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সভা।

আরও পড়ুন
লোকসংগীত পরিবেশন করে ‘আপনঘর’ ব্যান্ড
তানভীর আহম্মেদ

পরে কিআর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানান ছড়াকার ও চিকিৎসক রোমেন রায়হান। তিনি কিশোর-কিশোরীদের উৎসাহিত করে বলেন, ‘তোমরা ছড়া লিখবে। এমন সহজ করে লিখবে যে কেউ দেখলে বলবে, “আরে এটা তো আমিও পারব!” কিন্তু লিখতে গেলেই পারবে না।’ তিনি নিজেও মুহূর্তের মধ্যে একটি ছড়া বানিয়ে শোনান: ‘কিশোর আলোর বয়স হলো বারো, সামনে তোমরা আরও বাড়ো।’ এ ছাড়া কিআর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানান শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন। তিনি কিশোরদের উদ্দেশে বলেন, তারা যেন নিজেদের জীবনে শৃঙ্খলা বজায় রাখে।

কিআর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক শিবব্রত বর্মন। তিনি বলেন, এমন একটি সময় আসবে, যখন দাবার সব চাল খেলা হয়ে যাবে, আর কোনো চাল বাকি থাকবে না। তেমনি অনেকের মনে হতে পারে যে পৃথিবীর সব গল্প লেখা হয়ে গেছে। তাঁর নিজেরও এমনটা মনে হয়। তিনি জানান, সব গল্পই শেষ পর্যন্ত পাঁচটি আদিগল্প থেকে এসেছে। এই পাঁচটি আদিগল্প কী—এই নিয়ে একটি ধোঁয়াশা রেখে তিনি কিশোর-কিশোরীদের গল্পগুলো খুঁজে বের করার জন্য উৎসাহিত করেন। এই সময় উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক রোবোটিকস অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত আরিয়েত্তি ইসলাম। সে নিজের সাফল্যের গল্প শোনায় এবং কিশোর আলোকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। কিশোর আলোর সহসম্পাদক আহমাদ মুদ্দাসসের তাঁর ২০১৩ সালের প্রথম কিআড্ডায় আসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এরপর গান পরিবেশন করে কিশোর আলোর পাঠক আরিফা দেওয়ান।

আরও পড়ুন
জীবনে আনন্দটাই আসল-কার্টুনিস্ট মেহেদী হক
তানভীর আহাম্মেদ

এরপর বক্তব্য দেন জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট মেহেদী হক। তিনি বলেন, নিয়মিত কমিকস বা জোকস পড়লে একসময় নিজের থেকেই নতুন আইডিয়া তৈরি হয়। আর বলেন, কোনো কিছু জোর করে করতেই হবে এমন নয়, জীবনে আনন্দটাই আসল। এরপর কথা বলেন জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট নাসরিন সুলতানা মিতু। তাঁকে প্রায়ই প্রশ্ন করা হয়—মেয়ে হয়ে কমিকস আঁকতে সমস্যা হয় কি না? উত্তরে তিনি বলেন, মেয়ে হয়ে কমিকস আঁকতে সমস্যা হবে কেন, তা তিনি বুঝতে পারেন না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কমিকসে মেয়েদের কিংবা বিভিন্ন ধরনের পেশা বা অবস্থান থেকে মানুষের আসা জরুরি। কারণ, মানুষ নিজেদের গল্প নিজেরাই সবচেয়ে ভালো বলতে পারে।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান
তানভীর আহাম্মেদ

এরপর বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌফিক কিআর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আলোচনা করেন। এ ছাড়া কিআর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানান চিকিৎসক ও কার্টুনিস্ট নাইমুর রহমান এবং তিনি নিজের কার্টুনিস্ট হয়ে ওঠার গল্প শোনান। এরপর কিশোর আলোর সহযোগী সম্পাদক আদনান মুকিত নবম শ্রেণিতে থাকাকালে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে শুরু করা ম্যাগাজিন ‘হট্টগোল’ নিয়ে গল্প বলেন। তিনি জানান, তিন বন্ধু মিলে তাঁরা ‘হট্টগোল’ বের করতেন এবং সেই বয়সে তাঁরা আহসান হাবীবের লেখাও তাতে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এই প্রসঙ্গে তাঁদের একটি মজার অভিজ্ঞতা সম্পর্কেও জানান।

আরও পড়ুন
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর স্কুলের এক হেডমাস্টার স্যারের মজার গল্প শোনাচ্ছেন কিআর পাঠকদের
তানভীর আহম্মেদ

অনুষ্ঠানের শেষের দিকে কিআর জন্য শুভেচ্ছা বার্তা দেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনো বসে বক্তব্য দেন না—এই প্রসঙ্গে তিনি তাঁর এক শিক্ষকের কথা বলেন। তিনি জানান, কলেজে যখন তাঁরা পড়তেন, তখন সেই শিক্ষক একদম সময়মতো ক্লাসে আসতেন। একদিন স্যারকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি অসুস্থ, তখন একজন ছাত্র সাহস করে তাঁকে বসে বক্তব্য দিতে অনুরোধ করে। জবাবে স্যার বলেন যে তিনি বসতে পারবেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমি যখন ক্লাসে ঢুকছিলাম, তখন তোমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে সালাম দিয়েছ। তোমাদের সম্মানের প্রতিদান দিতে ক্লাসের বাকি সময় আমি দাঁড়িয়ে থাকব।’ এরপর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর স্কুলের এক হেডমাস্টার স্যারের মজার গল্প শোনান। স্যার ছিলেন প্রায় ছয় ফুট লম্বা এবং নিঃশব্দে বিড়ালের মতো হাঁটতেন। কোনো ছাত্রকে সামান্য দুষ্টুমি করতে দেখলেই তিনি বলতেন, ‘ওইখানেই নিলডাউন’। স্কুল পালানোর সময় এক ছেলে জানালা দিয়ে মাথা বের করেছে—তা দেখে ওকেও তিনি ‘ওইখানেই নিলডাউন’ করে রাখেন। এমনকি ছাত্রদের টয়লেটে দারোয়ান গেছে বলে দারোয়ানকে ওখানেই ‘নিলডাউন’ করে রেখেছিলেন! দুপুর হতে হতে সারা স্কুলে প্রায় ৫০ জনের মতো ছাত্র ‘নিলডাউন’ হয়ে থাকত।

আরও পড়ুন
অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন কিশোর আলোর প্রদায়ক জাহিন যাঈমাহ্ কবির ও আবু তালেব রাফি
তানভীর আহাম্মেদ

এই মজার গল্প বলার পর তিনি বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘আমাদের অবস্থাও এখন অনেকটা ওই রকম হয়েছে। তোমরা যদি “নিলডাউন” থেকে উঠে দাঁড়াতে পারো, যদি দৌড়াতে পারো, তাহলেই বাংলাদেশ আগাবে। নাহলে আমরা ওখানেই “নিলডাউন” হয়ে থাকব।’

সারা দিন কিশোর আলোকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পর্ব শেষে পরে এল কেক কাটার পালা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথি, কিশোর আলোর পাঠক, স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মীরা সবাই মিলে একসঙ্গে কেক কাটেন, ছবি তোলেন আর চলে খাওয়াদাওয়া পর্ব। দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন কিশোর আলোর প্রদায়ক জাহিন যাঈমাহ্ কবির ও আবু তালেব রাফি। সব মিলিয়ে জন্মদিনের এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন আর এত এত শুভেচ্ছা পেয়ে কিশোর আলোর খুশি না হয়ে উপায় কোথায়!

আরও পড়ুন