দুর্ভিক্ষ দূর হলেও গাজাবাসীর ক্ষুধার কষ্ট দূর হয়নি

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির পর গাজায় প্রবেশ করেছে ত্রাণবাহী ট্রাক। ফিলিস্তিনিরা সংগ্রহ করছেন জরুরি ত্রাণসহায়তা। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসেছবি: রয়টার্স

দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ, অবরোধ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে গাজাবাসী দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়েছিল। তবে বৈশ্বিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) জানিয়েছে, গাজা এখন আর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘দুর্ভিক্ষ’ অবস্থায় নেই। ১০ অক্টোবর শুরু হয়েছে যুদ্ধবিরতি। তবে সেটা মাঝেমধ্যেই ভঙ্গ হচ্ছে বলে বিভিন্ন পক্ষ অভিযোগ করছে। এ অবস্থায় গাজায় মানবিক ও বাণিজ্যিক খাদ্যসহায়তার প্রবেশ কিছুটা বেড়েছে। যে কারণে পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতি হয়েছে বলে আইপিসির সর্বশেষ মূল্যায়নে বলা হয়েছে। তবে একই সঙ্গে সতর্কবার্তাও রয়েছে। এই অগ্রগতি যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।

চার মাস আগে আইপিসি জানিয়েছিল, গাজা উপত্যকার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে। সংখ্যায় প্রায় ৫ লাখ ১৪ হাজার মানুষ। ইসরায়েল তখন সেই মূল্যায়ন প্রত্যাখ্যান করেছিল। এবার নতুন প্রতিবেদনে আইপিসি বলছে, দুর্ভিক্ষের শর্ত পূরণ না হলেও গাজার পরিস্থিতি এখনো ‘গুরুতর ও সংকটাপন্ন’। যদি আবার যুদ্ধ শুরু হয় এবং মানবিক ও বাণিজ্যিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ২০২৬ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পুরো গাজাই আবার দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, দুর্ভিক্ষ আপাতত ঠেকানো গেছে। কিন্তু এই অর্জন খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁর ভাষায়, আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি মানুষ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজন বাড়ছে এমন গতিতে, যা সহায়তার দিয়ে সামলানো যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন
ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

গাজার সব কটি প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সামরিক সংস্থা কোগাট জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৮০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় ঢুকছে, যার ৭০ শতাংশই খাদ্যসামগ্রী। হামাস এই দাবি মানতে চায় না। তাদের বক্তব্য, দিনে ৬০০ ট্রাক তো দূরের কথা, তার চেয়ে অনেক কম ঢুকতে পারছে। শুক্রবার আইপিসির মূল্যায়ন প্রত্যাখ্যান করে কোগাট অভিযোগ করে, প্রতিবেদনে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং তথ্য সংগ্রহে বড় ফাঁক রয়েছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জানায়, প্রতিবেদনে দেখানো সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি সহায়তা গাজায় যাচ্ছে এবং জুলাইয়ের পর থেকে সেখানে খাদ্যের দামও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

অন্যদিকে ত্রাণ সংস্থাগুলো বারবার বলছে, গাজায় প্রয়োজনের তুলনায় সহায়তা এখনো খুবই কম এবং অনেক জরুরি সামগ্রী ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ইসরায়েলের দাবি, খাবারের ঘাটতি নেই; সমস্যা হচ্ছে গাজার ভেতরে বিতরণব্যবস্থায়।

আইপিসি মনে করিয়ে দিয়েছে, গত ১৫ বছরে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে এমন দুর্ভিক্ষ বিশ্বে ঘটেছে মাত্র পাঁচটি। ২০১১ সালে সোমালিয়া, ২০১৭ ও ২০২০ সালে দক্ষিণ সুদান, ২০২৪ সালে সুদান এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালের আগস্টে গাজা। কোনো অঞ্চলকে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করতে হলে অন্তত ২০ শতাংশ মানুষকে চরম খাদ্যসংকটে থাকতে হয়, প্রতি তিন শিশুর একজনকে তীব্র অপুষ্টিতে ভুগতে হয় এবং প্রতিদিন প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে অন্তত দুজনকে অনাহার বা অপুষ্টিজনিত রোগে মারা যেতে হয়।

আরও পড়ুন

শুক্রবারের প্রতিবেদনে আইপিসি বলেছে, বর্তমানে গাজার কোনো এলাকাই আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ শ্রেণিতে নেই। তবে সতর্ক করে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে নিয়মিত, বিস্তৃত ও নিরবচ্ছিন্ন মানবিক এবং বাণিজ্যিক সহায়তার ওপর। দুর্ভিক্ষের মানদণ্ড পূরণ না হলেও আইপিসি ‘বিপর্যয়কর পরিস্থিতি’ নির্ধারণ করতে পারে। এমন জায়গার জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নির্ধারণ করা হয়, যেখানে পরিবারগুলো চরম খাদ্যাভাব, অনাহার এবং অপুষ্টি ও মৃত্যুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে।

এ মুহূর্তে গাজায় এক লাখের বেশি মানুষ এমন বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছে আইপিসি। পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৬ সালের এপ্রিল নাগাদ এই সংখ্যা কমে প্রায় ১ হাজার ৯০০-এ নামতে পারে। তবে পুরো গাজা উপত্যকাই এখনো ‘জরুরি’ পর্যায়ে রয়েছে, যা বিপর্যয়কর অবস্থার ঠিক এক ধাপ নিচে।

গাজায় শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে উদ্বেগজনক। আইপিসির হিসাব অনুযায়ী, আগামী এক বছরে গাজায় ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী প্রায় ১ লাখ ১ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগবে এবং চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে ৩১ হাজারের বেশি হবে মারাত্মকভাবে অপুষ্ট। একই সময়ে ৩৭ হাজার গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীও তীব্র অপুষ্টির শিকার হবেন।

আরও পড়ুন

দক্ষিণ গাজার নাসের হাসপাতালে চিকিৎসকেরা শঙ্কায় আছেন ৪ বছরের আরজওয়ান আল-দাহিনি ও ছয় বছরের ইয়াসের আরাফাতকে নিয়ে। দুজনই মারাত্মক তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে, ক্ষুধার সবচেয়ে ভয়ংকর স্তরে আছে এরা। আরজওয়ানের মা হানিন বলেন, খাবারের সংকটে মেয়েটি হাঁটা বন্ধ করে দিয়েছে, বেড়ে ওঠা থেমে গেছে এবং শরীরের প্রায় অর্ধেক ওজন কমে গেছে। ইয়াসের আরাফাতের ভাই ইতিমধ্যেই অপুষ্টিতে মারা গেছে বলে জানান চিকিৎসক আহমেদ আল-ফাররা। তাঁর বাবা নিজেও অসুস্থ ও অপুষ্ট, আর মা ইমান বলেন, পরিবারটি ডিম বা অন্য কোনো উচ্চ প্রোটিন খাবার কিনতেই পারছে না।

গাজার আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান মোহাম্মদ আবু সেলমিয়া জানান, অপুষ্টি এখনো ব্যাপক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষায় ছয় হাজার শিশুর মধ্যে প্রায় এক হাজার অপুষ্টিতে ভুগছে, যার মধ্যে ১০০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির গাজা ও পশ্চিম তীরের প্রধান কর্মকর্তা আন্তোয়ান রেনার্ড বলেন, উন্নতির কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এখন গাজার বেশির ভাগ মানুষ দিনে দুই বেলা খাবার পাচ্ছে। কিন্তু গাজায় সহায়তা প্রবেশ সহজ করা এখনো ‘নিরন্তর সংগ্রাম’। জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে, ইসরায়েল যদি বাধা না তোলে, তবে মানবিক কার্যক্রম ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

গুতেরেস আবারও বলেন, টেকসই যুদ্ধবিরতি ছাড়া সমাধান নেই। আরও প্রবেশপথ খুলতে হবে, জরুরি সামগ্রীর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলতে হবে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে, গাজার ভেতরে নিরাপদ চলাচলের পথ নিশ্চিত করতে হবে, স্থায়ী অর্থায়ন দরকার এবং বাধাহীন প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

আন্তর্জাতিক রেসকিউ কমিটি সতর্ক করে বলেছে, এই অগ্রগতিকে যেন সংকট শেষ হয়ে গেছে বলে ভুল না করা হয়। তাদের ভাষায়, গাজায় ক্ষুধা এখনো বিপর্যয়কর পর্যায়ে রয়েছে। দ্রুত, পর্যাপ্ত এবং নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা না পেলে দুর্ভিক্ষ ও প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর ঝুঁকি খুব দ্রুতই ফিরে আসতে পারে।

গাজায় দুর্ভিক্ষ হয়তো আপাতত দূর হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ক্ষুধা, অপুষ্টি আর অনিশ্চয়তা।

সূত্র: র‌য়টার্স

আরও পড়ুন