প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে গাজায় বেশি সাংবাদিক নিহত, সর্বশেষ আনাস আল-শরিফ
আনাস আল-শরিফ আল জাজিরার বিখ্যাত সাংবাদিক। গাজা থেকে মানবিক রিপোর্ট করে তিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিলেন। গত মাসের শেষের দিকে এক রিপোর্টে তিনি নিজেকে বলেছিলেন একজন ‘ক্ষুধায় ডুবে যাওয়া’ মানুষ। গাজার দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি ভিডিও প্রতিবেদনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। গত কয়েক সপ্তাহে গাজায় দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। শতাধিক শিশু ক্ষুধায় মারা গেছে। সাংবাদিকরা ক্ষুধায় কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলছেন।
গাজা যুদ্ধের সবশেষ অবস্থা বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য আনাস ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য সাংবাদিক। সম্প্রতি ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী তার বিরুদ্ধে বিরূপ প্রচারণা চালাচ্ছিল। ছোট করছিল তাঁকে। কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (CPJ) গত মাসে আনাস আল-শরিফের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। তারা অভিযোগ করেছিল, ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে ‘চরিত্রহনন অভিযান’ চালাচ্ছে, যা তাঁকে হত্যার পূর্ব লক্ষণ হতে পারে। তাঁদের এই উদ্বেগ মিথ্যে হয়নি। হত্যা করা হয়েছ আনাস আল-শরিফকে। শহীদ হয়েছেন আনাস।
মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ছিলেন। তাঁর শেষ বার্তাগুলোর মধ্যে একটি ছিল এক্সে (সাবেক টুইটার)। তিনি লিখেছেন, ‘অবিরাম বোমা হামলা। দুই ঘণ্টা ধরে গাজা শহরে ইজরায়েলি আগ্রাসন তীব্র হয়েছে।’
আল-জাজিরা জানিয়েছে, রোববার রাতে গাজা শহরে আল-শিফা হাসপাতালের কাছে ইজরায়েলি হামলায় তাদের পাঁচজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে আছেন সংবাদদাতা আনাস আল-শরিফ।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে আনাস আল-শরিফসহ সাংবাদিকদের হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছেন বহু মানুষ। ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তারা দাবি করেছে, তারা আনাস আল-শরিফকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল, কারণ তিনি হামাসের একজন যোদ্ধা ছিলেন। আনাস এবং আল-জাজিরা আগেই বলেছে, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।
আল-জাজিরার প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সোমবার এক আবেগঘন জানাজার মিছিলে গাজার বাসিন্দারা নিহতদের মরদেহ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন। নিহতদের মধ্যে আছেন আল-জাজিরার বিশিষ্ট সংবাদদাতা আনাস আল-শরিফ এবং তাঁর তিন সহকর্মী। আল-শিফা হাসপাতালের কাছে সাংবাদিকদের তাঁবুতে এই হামলায় আনাস আল-শরিফ, মোহাম্মদ কোরাইকেহ, ইব্রাহিম জাহের, মোমেন আলিওয়া এবং মোহাম্মদ নওফল—এই পাঁচজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবু সালমিয়া জানিয়েছেন, হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের তাঁবুতে ইজরায়েলি ড্রোন হামলায় পাঁচজন সাংবাদিকসহ মোট সাতজন নিহত এবং আটজন আহত হয়েছেন।
আল জাজিরা জানিয়েছে, নিহত পাঁচ সংবাদকর্মী তাঁদের জন্য কাজ করতেন। এদের মধ্যে দুজন সংবাদদাতা, দুজন ক্যামেরাম্যান এবং একজন ক্যামেরাম্যানের সহকারী ছিলেন। এক বিবৃতিতে আল-জাজিরা এই হামলাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। তাঁরা বলেছে, গাজা দখলের আগেই সংবাদ কর্মীদের কণ্ঠরোধ করার এটি একটি ‘বেপরোয়া চেষ্টা’।
ইজরায়েলের সঙ্গে আল জাজিরার সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই ভালো যাচ্ছে না। গাজায় চলমান যুদ্ধের সময় তাদের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। আল জাজিরার অনেক সাংবাদিক গাজায় কাজ করেন। তাঁরা ব্যাপক সংকট ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে গাজাবাসীর দুর্দশার খবর নিয়মিত দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে ইজরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজার বেশ কিছু সাংবাদিক নিহত হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় ৬১,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আল জাজিরা অভিযোগ করেছে, ইজরায়েল যুদ্ধের নৃশংসতা গোপন করার চেষ্টা করছে। এ জন্যই সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে।
গত গ্রীষ্মে ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীর বিমান হামলায় আল জাজিরার রিপোর্টার ইসমাইল আল-ঘুল নিহত হন। তখনও ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছিল, আল-ঘুল হামাসের সামরিক শাখার সদস্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ‘কস্ট অব ওয়ার’ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় শুরু হওয়া যুদ্ধে যতজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, সেই সংখ্যাটা আমেরিকান সিভিল ওয়ার, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধ এবং ৯/১১ পরবর্তী আফগানিস্তান যুদ্ধে নিহত মোট সাংবাদিকের সংখ্যার চেয়েও বেশি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় নিহত হয়েছেন ২৭০ জন সাংবাদিক।
সূত্র: আল জাজিরা ও নিউইয়র্ক টাইমস