যে প্রতিযোগিতায় কিছুই করতে হয় না
জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘ফ্রেন্ডস’-এর ছয়জন প্রধান অভিনেতার একজন ম্যাট লেব্ল্যাঙ্ক, যিনি ‘জোয়ি’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সম্প্রতি ‘কিছু না করা’ নিয়ে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের অংশ টিকটকে ছড়িয়ে পড়েছে। লাখো মানুষ ক্লিপটি দেখছেন এবং শেয়ার করছেন। ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি বলছেন, ‘পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ, আমার একেবারে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো কিছু না করা। আমি এটাতে দারুণ। আমি একজন পেশাদার “কিছু না করা” মানুষ হতে চাই। কারণ এটা এত সহজ যে এতে কোনো নিয়ম নেই! কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, আজ তুমি কী করবে? আমি বলব, কিছুই না, খুব সহজ কাজ।’
ক্লিপটি স্ক্যান্ডেনেভিয়ান টিভি শো ‘স্ক্যাভলান’-এর একটি অংশ। টিভির এই শোতে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেছিলেন জোয়ি।
এখনকার কিশোর-তরুণদের মধ্যেও ‘কিছু না করা’র ইচ্ছাটা খুব বেশি। সম্প্রতি ফেসবুকে বাংলাদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্র এক ঘণ্টা ধরে কিছু না করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে একটি লাইভ করেছেন। লাইভটা অনেকেই দেখেছেন এবং শেয়ার করেছেন। ‘কিছু না করা’ এবং অন্যরা বিষয়টা দেখছেন, এটাকে কোরিয়ানরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আজ সেই গল্পই জানব।
‘স্পেস আউট’ প্রতিযোগিতা
কোরিয়ার ‘কিছু না করা’র প্রতিযোগিতাটির নাম ‘স্পেস আউট’। এটা শুনতে খুব সহজ মনে হলেও বাস্তবে বেশ কঠিন। ৯০ মিনিট ধরে চলে এই প্রতিযোগিতা। একটি হলঘরে প্রতিযোগীরা চারকোনা দাগের মধ্যে বসে থাকেন। হলঘরভর্তি দর্শক থাকেন। দর্শক ও উপস্থাপক নানা মন্তব্য করেন। এর মধ্যে কিছু না করে বসে থাকতে হয়।
একজন প্রতিযোগী বলেন, ‘আমি কিছু চিন্তা না করা এবং হার্টবিট কমানোর চেষ্টা করছিলাম। যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে এটা কঠিন ও অদ্ভুত।’
‘স্পেস আউট’ প্রতিযোগিতায় ‘কিছু না করা’র সঙ্গে আরও কিছু বিষয় জড়িয়ে আছে। এটি একই সঙ্গে একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা এবং একঘেয়েমি সহ্য করার চ্যালেঞ্জও বটে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিবছর এই ‘স্পেস আউট’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এর প্রধান কারণ হলো, প্রতিযোগিতামূলক কোরিয়ান সমাজে বিশ্রাম নেওয়ার গুরুত্বের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
একজন প্রতিযোগী তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘গোলাপি ইয়োগা ম্যাটে পা ভাঁজ করে বসে আছি। সিউলের হান নদী থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করছি। মাথার ওপরে সেতুতে গাড়ির শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। আমি নিষ্ক্রিয় হয়ে পাথরের মতো অবস্থায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।’
কিছু না করে বসে থাকাটা কিন্তু কিছু কারণে বেশ কঠিন। এতে অংশগ্রহণকারীর হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। কাঁধে ব্যথা বাড়তে থাকে, উপস্থাপকের উচ্চ আওয়াজ আর দর্শকদের মন্তব্যগুলো মনোযোগ কেড়ে নেয়।
প্রতিযোগিতায় মোট ৭৯ জন প্রতিযোগী অংশ নেন। এর মধ্যে সবাই দেড় ঘণ্টা ধরে নীরবে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারেননি। তবে যতক্ষণ বসে থেকেছেন, ততক্ষণ চেহারার দিকে তাকিয়ে বোঝা যায়নি যে তাঁদের মনে কী চলছে। তবে প্রতিযোগীরা একটা কাজ খুব ভালোভাবে করেছেন, সেটা হলো ‘কিছু না করা’।
কিছু না করার নিয়ম
‘স্পেস আউট’ প্রতিযোগিতায় ‘কিছু না করা’র সঙ্গে আরও কিছু বিষয় জড়িয়ে আছে। এটি একই সঙ্গে একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা এবং একঘেয়েমি সহ্য করার চ্যালেঞ্জও বটে। বিভিন্ন সাজপোশাকে মানুষ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, ১৫ মিনিট পরপর তাঁদের হৃৎস্পন্দন মাপা হয়। যাঁর হৃৎস্পন্দন সবচেয়ে কম ও স্থিতিশীল হবে, তিনি বিজয়ী হওয়ায় এগিয়ে থাকবেন। সঙ্গে দরকার হবে দর্শকের ভোট। দর্শকের ভোটে যিনি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পাবেন, তিনিই হবেন বিজয়ী।
লোকে সাধারণত মনে করে, ‘কিছু না করে কাটানো’ সময়ের বুঝি কোনো মূল্য নেই। তিনি এই ধারণার পরিবর্তন করতে ‘স্পেস আউট’ প্রতিযোগিতা নিয়ে এসেছেন, যা বোঝাতে চায় যে কিছু না করে কাটানো সময়ও মূল্যবান।
কয়েকজন অংশগ্রহণকারী বলেছেন, প্রতিদিন নিজেদের অজান্তেই তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে একটা জায়গায় বসে থাকেন, সেটাই তাঁদের জন্য অনুশীলনের কাজ করেছে।
এই প্রতিযোগিতায় পার্ক বিয়ুং-জিন নামের একজন অংশ নিয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যেঁ তার স্পাইকি চুল অন্য প্রতিযোগীদের মনোযোগ সরিয়ে দেবে এবং তাঁকে বাড়তি সুবিধা দেবে।
যেভাবে এল ‘কিছু না করা’ প্রতিযোগিতা
‘স্পেস আউট’ প্রতিযোগিতা ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্পী ওউপসিয়াংয়ের হাত ধরে শুরু হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে কাজ করেন। দক্ষিণ কোরিয়া দীর্ঘ কর্মঘণ্টার জন্য পরিচিত দেশ। এ দেশের মানুষ লম্বা সময় ধরে কাজ করেন। ওউপসিয়াং নিজে শিল্পী হয়েও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। আশপাশে সবাই ব্যস্ত থাকায় তিনি বিরতি নিতে দ্বিধা করতেন। তবে তিনি ভেবেছিলেন, অন্যরাও হয়তো এমন একটি বিরতি চান।
লোকে সাধারণত মনে করে, ‘কিছু না করে কাটানো’ সময়ের বুঝি কোনো মূল্য নেই। তিনি এই ধারণার পরিবর্তন করতে ‘স্পেস আউট’ প্রতিযোগিতা নিয়ে এসেছেন, যা বোঝাতে চায় যে কিছু না করে কাটানো সময়ও মূল্যবান।
প্রতিযোগীরা জানিয়েছেন, যখন করার মতো কিছুই থাকে না, তখন সময়ের ধারণাটা অদ্ভুত হয়ে যায়। যখন কোনো কর্মী পালস পরীক্ষা করতে আসেন, তখন তাঁরা বুঝতে পারেন যে ১৫ মিনিট শেষ হয়ে গেছে।
এই আয়োজনের মতো একই রকম প্রতিযোগিতা জাপান, চীন, নেদারল্যান্ডস এবং অন্যান্য দেশেও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব অনুষ্ঠান নাকি প্রমাণ করে, ‘মানুষ যেকোনো ভাষায় নীরব থাকতে আগ্রহী’। এ বছর সিউলের প্রতিযোগিতায় ৮০টি স্থানের জন্য ৪ হাজারের বেশি মানুষ অংশ নিতে আবেদন করেছিলেন। আয়োজকেরা এমন অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচন করেছেন, যাঁরা দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে বলে তাঁরা মনে করেছেন।
বিজয়ীর অভিজ্ঞতা
প্রতিযোগীরা জানিয়েছেন, যখন করার মতো কিছুই থাকে না, তখন সময়ের ধারণাটা অদ্ভুত হয়ে যায়। যখন কোনো কর্মী পালস পরীক্ষা করতে আসেন, তখন তাঁরা বুঝতে পারেন যে ১৫ মিনিট শেষ হয়ে গেছে। এই প্রতিযোগিতায় একজন প্রতিযোগী বলেছেন, তাঁর পালস রেট অনেক কমে গিয়েছিল, কিন্তু ফাইনালিস্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট দর্শকের ভোট পাননি। পার্ক নামের একজন ড্রামার বিজয়ী হয়েছেন। তাঁকে রডিনের ‘দ্য থিঙ্কার’এর মতো দেখতে একটি ভাস্কর্য উপহার দেওয়া হয়েছে। বিজয়ী পার্ক বলেন, ‘আমি বারবার আমার মন থেকে এই চিন্তা সরিয়ে ফেলেছি যে আমাকে জিততে হবে।’ তাঁর এ কথায় বোঝা যায়, তিনি আসলে ‘কিছু না করা’র প্রতিযোগিতায় মনে মনে কিছু একটা করছিলেন। যাঁরা এই প্রতিযোগিতায় কোনো পুরস্কার পাননি, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, ‘আমরা কিছুই অর্জন করিনি। এটিই একধরনের বিজয়।’ সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস