স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিংয়ের এ টু জেড

স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং কী, কোথা থেকে এল

স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং (Scratch) কী?

স্ক্র্যাচ একটি ব্লক-ভিত্তিক প্রোগ্রামিং ভাষা। স্ক্র্যাচের আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রোগ্রামিং কমিউনিটি। স্ক্র্যাচ ব্যবহার করে প্রোগ্রামিং লজিক সহজেই শেখা যায়। পাশাপাশি ডিজিটাল গল্প, অ্যানিমেশন ভিডিও, কার্টুন, গেম এবং আরও নানা ধরনের প্রজেক্ট তৈরি করা যায়। গেম, অ্যানিমেশন, প্রেজেন্টেশন, গ্রাফিক্স আর্ট, ইন্টারেক্টিভ গল্প ইত্যাদি প্রজেক্ট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই স্ক্র্যাচে রয়েছে। এখানে অন্যান্য প্রোগ্রামিং ভাষার মতো কোড টাইপ করতে হয় না, বরং ব্লকগুলোকে জোড়া লাগিয়ে কাজ করা যায়। তাই এটা শেখা খুব সহজ। স্ক্র্যাচের সঙ্গে বিভিন্ন এক্সটেনশন ব্যবহার করে রোবটিক্স ও ড্রোন প্রোগ্রামিং করা যায়। সেই সঙ্গে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই, ডিজিটাল ভিডিও এবং শব্দ ব্যবহার করার সুবিধাও রয়েছে।

স্ক্র্যাচ হলো একটি মজার প্রোগ্রামিং ভাষা, যা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং কম্পিউটার নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি সৃজনশীলভাবে শেখা এবং শেখানোর জন্য তৈরি হয়েছে। স্ক্র্যাচ ব্যবহার করে তুমি নিজের আইডিয়া প্রকাশ করতে পারো। অন্যকে সাহায্য করতে পারো এবং সবাইকে কম্পিউটার শেখার সুযোগ দিতে পারো। স্ক্র্যাচ তোমাকে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে চিন্তা করতে এবং যুক্তি দিয়ে প্রোগ্রাম বানাতে উৎসাহ দেবে। এছাড়াও, তুমি তোমার তৈরি প্রজেক্টগুলো অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে পারো।

স্ক্র্যাচে তৈরি প্রোগ্রামগুলো ক্রিয়েটিভ কমন্স অ্যাট্রিবিউশন শেয়ার অ্যালাইক লাইসেন্সের অধীনে প্রকাশিত হয়। এর মানে হলো, https://scratch.mit.edu ওয়েবসাইটে থাকা প্রোগ্রামগুলো তুমি দেখতে পারো এবং বুঝতে পারো কীভাবে সেগুলো তৈরি করা হয়েছে। তুমি চাইলে আগের প্রোগ্রামগুলোকে ব্যবহার করে নতুন কিছু তৈরি করতে পারো। তবে, সেক্ষেত্রে আগের প্রোগ্রামের ক্রেডিট দিতে হবে বা আগের প্রোগ্রামটি যে তৈরি করেছে তার নামসহ কৃতিত্ব উল্লেখ করতে হবে।

স্ক্র্যাচ ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান স্ক্র্যাচের উন্নয়ন এবং পরিচালনার কাজ করে। স্ক্র্যাচ বিশ্বের ২০০টিরও বেশি দেশে এবং এটি ৭০টিরও বেশি ভাষায় ব্যবহার করা হয়।

স্ক্র্যাচে শেয়ার করা প্রজেক্টগুলোতে প্রায় ৬৭০ কোটি মন্তব্য করা হয়েছে এবং স্ক্র্যাচের নিবন্ধিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। এটি সত্যিই একটি বিশাল কমিউনিটি, যেখানে সবাই একসঙ্গে শেখে এবং শেখায়!

স্ক্র্যাচের ইতিহাস

স্ক্র্যাচের এই যুগান্তকারী উদ্ভাবনের পেছনে রয়েছে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MIT) বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা। তাঁরা এমন একটি প্রোগ্রামিং ভাষা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা অন্যান্য প্রোগ্রামিং ভাষার চেয়ে আলাদা হবে এবং যেকোনো বয়সের মানুষ খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারবে। এই লক্ষ্যে, MIT-এর মিডিয়া ল্যাবের লাইফলং কিন্ডারগার্টেন (Lifelong Kindergarten Group - LLK) গ্রুপের কয়েকজন গবেষক মিলে স্ক্র্যাচ তৈরি করেন। এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মিশেল রেসনিক (Mitchel Resnick), এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন ইয়াসমিন কাফাই (Yasmin Kafai)-এর দল। তাঁরা কম্পিউটার ক্লাব হাউজের সাথে মিলিতভাবে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিংয়ের সূচনা ও বিকাশ ঘটান।

২০০৩ সালে, বাচ্চাদের জন্য কোডিংকে সহজবোধ্য করার লক্ষ্যে একটি নতুন প্রোগ্রামিং ভাষা তৈরি করার প্রস্তাবনা দিয়ে মিশেল রেসনিক, ইয়াসমিন কাফাই এবং জন মায়েদা ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন গ্রান্ট লাভ করেন। স্ক্র্যাচের মূল স্লোগান ছিল ‘কল্পনা করো, প্রোগ্রাম করো, ভাগ করো’ (Imagine, Program, Share)। অর্থাৎ, স্ক্র্যাচ বিশ্বাস করে, ডেভেলপারদের কল্পনাগুলো একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করেই প্রোগ্রামিং ভাষার বিকাশ সম্ভব। এই ধারণাকে সামনে রেখে স্ক্র্যাচ তৈরি হয়েছে। তৈরি পর থেকেই এটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ব্যবহারকারীরা এখানে নিজেদের প্রকল্প তৈরি করতে পারে, অথবা অন্যের তৈরি প্রকল্প ‘রিমিক্স’ করেও নিজের মতো করে উপস্থাপন করতে পারে। স্ক্র্যাচ দিয়ে তৈরি ও রিমিক্স করা সব প্রকল্প Creative Commons Attribution-Share Alike License–এর অধীনে লাইসেন্সকৃত। স্ক্র্যাচ স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল প্রকল্প নির্মাতার নাম প্রকল্প পৃষ্ঠার ওপরের অংশে উল্লেখ করে দেয়।

অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের স্ক্র্যাচের মাধ্যমে প্রোগ্রামিংয়ের হাতেখড়ি দেওয়া হয়। তবে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও খুব সহজেই স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিং শিখতে পারে। বর্তমানে অনেক দেশের স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গাণিতিক যুক্তি ও প্রোগ্রামিং শেখানোর জন্য স্ক্র্যাচ ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, যা এনসিটিবি নামে পরিচিত, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীর কারিকুলামে ২০২৩ সালে স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং অন্তর্ভুক্ত করেছে।

স্ক্র্যাচ ব্লকস হলো একটি নতুন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, যেখানে গ্রাফিক্যাল প্রোগ্রামিং ব্লকের মাধ্যমে প্রোগ্রামিং করা যায়। এটি গুগল এবং এমআইটির স্ক্র্যাচ টিমের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছে। গুগলের Blockly টেকনোলজি এবং স্ক্র্যাচ টিমের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে এই প্রজেক্টটি তৈরি করা হয়েছে। স্ক্র্যাচ ব্লকস প্রোগ্রামিং ব্লক তৈরি করার জন্য একটি বিশেষ ফ্রেমওয়ার্ক। এটি একটি ওপেন সোর্স প্রোজেক্ট। এর ফলে অন্য যে কেউ এই মূল প্রোজেক্টের ওপের ভিত্তি করে নতুন নতুন টুল ও ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করতে পারবে।

স্ক্র্যাচ ২.০ প্রকাশিত হয় ৯ মে ২০১৩ সালে। এই সংস্করণে সাইটের চেহারা পাল্টে যায় এবং এতে একটি অনলাইন প্রজেক্ট এডিটর ও একটি অফলাইন এডিটর যুক্ত হয়। এই সংস্করণে ব্যবহারকারীরা নিজেদের কাস্টম ব্লক সহ আরও কিছু নতুন ফিচারও যোগ করা হয়। স্ক্র্যাচ ২.০-এর অফলাইন এডিটর Windows, Mac এবং Linux–এর জন্য স্ক্র্যাচ ওয়েবসাইট থেকেই ডাউনলোড করা যেত।

২০১৬ সালে স্ক্র্যাচ টিম স্ক্র্যাচ ৩.০ ঘোষণা করে। স্ক্র্যাচ ৩.০-এর চূড়ান্ত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২ জানুয়ারি ২০১৯ সালে। পরবর্তীতে ২৮ জুন ২০২৩ তারিখে স্ক্র্যাচ ওয়েবসাইটের হেডার ও লিংকের রং নীল থেকে বেগুনি করা হয়, এবং রং অন্ধত্ব (color blindness) রয়েছে এমন ব্যবহারকারীদের জন্য নতুন হাই-কনট্রাস্ট ব্লকের রঙের বিকল্প যুক্ত করা হয়।

২০১৩ সালে Scratch Foundation (পূর্ব নাম: Code-To-Learn Foundation) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১১ মার্চ ২০১৯ সালে স্ক্র্যাচ টিম MIT মিডিয়া ল্যাব থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে স্বাধীনভাবে Scratch Foundation–এর অধীনে চলে যায়। তবে MIT মিডিয়া ল্যাব এখনো স্ক্র্যাচ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করছে।

আরও পড়ুন