ইরানের সীমান্তবর্তী দেশগুলো কে কোন পক্ষে
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্যে ইরানে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভারী বাংকার বোমা ফেলেছে ইরানের তিনটি স্থানে। এই বোমা হামলায় ৭টি শক্তিশালী বি-টু বিমান ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিমানগুলোকে সহায়তার জন্য আরও ১১৮টি বিমান মিশনে অংশ নিয়েছে।
জবাবে গত ২৩ জুন সোমবার ইরান মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি আল-উদেইদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এ পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, মধ্যপ্রাচ্য হয়তো দীর্ঘমেয়াদি এক যুদ্ধের মুখোমুখি মধ্যপ্রাচ্য। এই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও উভয়দেশ তা মানেনি। তবে আপাতত সংঘর্ষ থেমেছে।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য দীর্ঘমেয়াদি এই যুদ্ধের মুখোমুখি যেন না হয়, তার লক্ষ্যে যুদ্ধবিরতির কার্যকর করতে ভূমিকা রেখেছে ইরান সীমান্তবর্তী দেশগুলো। ইরানের সীমান্তবর্তী দেশগুলো কে কোন পক্ষে কাজ করছে, তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য আগামীতে বেশ গুরুত্ব বহন করবে।
দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বিশাল একটি দেশ ইরান। ভূ-রাজনৈতিকভাবে দেশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ১৭তম বৃহত্তম দেশ ইরান। এর আয়তন প্রায় ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ১৯৫ বর্গকিলোমিটার।
ইরানের ১৩টি সার্বভৌম দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে, যা স্থল ও সমুদ্র উভয় ক্ষেত্রে বিস্তৃত। ইরানের সঙ্গে স্থলসীমানা রয়েছে ইরাক, তুরস্ক, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের। এই সীমানা প্রায় ৫ হাজার ৮৯৪ কিলোমিটার।
এছাড়া, উপকূলরেখাসহ আরও ৬টি দেশের সঙ্গে সামুদ্রিক সীমানা রয়েছে ইরানের। এর মধ্যে রয়েছে কুয়েত, সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমান। ইরানের দক্ষিণে রয়েছে ওমান উপসাগর, হরমুজ প্রণালি এবং পারস্য উপসাগর। পশ্চিমে এর প্রতিবেশী দেশ ইরাক ও তুরস্ক।
ইরানের প্রধান মিত্রদের মধ্যে রয়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি আন্দোলন, গাজা উপত্যকার হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ, সেই সঙ্গে ইরাকের কিছু মিলিশিয়া যেমন পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস (পিএমএফ), যা আল-হাশদ আল-শাবি নামেও পরিচিত। এছাড়া, ইরান রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক এবং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হলেও, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তবে তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায় না। শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও আজারবাইজানের সঙ্গে ইসরায়েলের সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেশ শক্তিশালী। ইসরায়েল আজারবাইজানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে এবং এর ভূখণ্ড ইরানের ওপর নজরদারির জন্য ব্যবহার করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আর্মেনিয়ার সঙ্গে ইরানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আজারবাইজানের সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আর্মেনিয়া সাধারণত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে নিরপেক্ষ ছিল, তবে ইরানের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থিতিশীল। তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক মূলত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক। তারা সাধারণত ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে। সরাসরি কোনো পক্ষ নেয়নি।
আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের পর ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক জটিল হয়েছে। তাদের মধ্যে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও শরণার্থী সমস্যা বিদ্যমান। তালেবান ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না, তবে তাদের ইরানকে সরাসরি সমর্থন করার সম্ভাবনা কম। পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্ক ভালো। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে কিছু উত্তেজনার ঘটনা ঘটলেও, আন্তর্জাতিক ভাবে পাকিস্তান প্রায়শই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানায় এবং ইরানকে সরাসরি শত্রু মনে করে না। তারা সাধারণত বড় সংঘাতে নিজেদের নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করে।
সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ইত্যাদি আরব দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী। ইরানের প্রভাবকে তারা হুমকি মনে করে। সৌদি আরব ও বাহরাইন সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রেখেছে। তারা ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এই দেশগুলো এই ইস্যুতে তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখে। তারা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করে।
মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের অনেক দেশ ইরানের বর্তমান শাসকদের পছন্দ করে না। প্রকাশ্যে তারা ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানালেও তাদের প্রকৃত চাওয়া ভিন্ন। রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যই তারা এসব নিন্দা জানায়। ইরানকে দুর্বল করাটাই অনেক উপসাগরীয় দেশের প্রকৃত চাওয়া।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, উইকিপিডিয়া