ইরান কি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্যে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র ভারী বোমা হামলা করেছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। ইসরায়েল-ইরান সংঘাত তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল কখনো বড় আকারে সামরিক পদক্ষেপ নেয়নি। তবে ১১ দিন ধরে চলা ইসরায়েল-ইরান পাল্টাপাল্টি হামলা নিয়ে পুরো বিশ্বের মানুষ চিন্তিত। সবার মনে প্রশ্ন জাগছে, ইরান এখন কী করবে?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান প্রতিশোধ নিতে পারে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ, যেখান দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের মোট তেল সরবরাহের এক–পঞ্চমাংশের বেশি সরবরাহ হয়। প্রতিদিন এই পথে দুই কোটি ব্যারেল তেল ও তরল গ্যাস নিয়ে জাহাজ চলাচল করে।
এই অঞ্চলে সংঘাত তৈরি হলে হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা বিশ্বজুড়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতে ইরান বেশ কয়েকবার হুমকি দিয়েছে, তারা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে। যদি তারা এটা করে, তাহলে সারা বিশ্বে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামতে পারে এবং তেলের দাম অনেক বেড়ে যেতে পারে। তবে ইরান কখনোই এই হুমকি, তথা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করেনি।
হরমুজ প্রণালি কী ও কোথায়
বিশ্ব মানচিত্রে হরমুজ প্রণালি একটি সরু পানিপথ। কিন্তু এর কৌশলগত গুরুত্ব এত বিশাল যে একে বিশ্ব অর্থনীতির লাইফলাইন বলা হয়। কারণ, হরমুজ প্রণালি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন পথগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি ভূকৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব অর্থনীতির চালিকা শক্তি তেলের অবাধ প্রবাহ এই প্রণালির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। প্রণালিটি ওমান ও ইরানের মধ্যে অবস্থিত। হরমুজ প্রণালি উত্তরের পারস্য উপসাগরকে দক্ষিণে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এর সবচেয়ে সংকীর্ণ স্থানে প্রণালিটি ৩৩ কিলোমিটার প্রশস্ত, তবে জাহাজ চলাচলের জন্য নিরাপদ মাত্র ৩ কিলোমিটার।
কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ
বিশ্বের মোট তেলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এই প্রণালি দিয়ে বিভিন্ন দেশে পরিবহন করা হয়। বিশ্লেষণ সংস্থা ভর্টেক্সার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শুরু থেকে গত মাস পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৭৮ লাখ থেকে ২০ দশমিক ৮ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল, কনডেনসেট ও জ্বালানি এই প্রণালি দিয়ে পরিবহন করা হয়েছে।
পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের সদস্যদেশগুলো হলো সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ইরাক। এদের বেশির ভাগ অপরিশোধিত তেল মূলত এই প্রণালি দিয়ে এশিয়ায় রপ্তানি করে। বাহরাইনে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত।
হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে কী হবে
হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে এর পরিণতি হবে মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সরাসরি অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে। এর ফলে তেলের দাম আকাশচুম্বী হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে প্রায় তাৎক্ষণিক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে।
তবে ইরান যদি এ পদক্ষেপ নেয়, এটি তাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। কারণ, ইরানের তেল রপ্তানির জন্যও একই পানিপথ ব্যবহৃত হয়। হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও তারা ইসরায়েলি আক্রমণের তীব্র সমালোচক, তবু নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য তাদের এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
বিশেষ করে, এই প্রণালি বন্ধ করলে চীনের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হবে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে চীন ইরানের তেল রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ ক্রয় করে। তবে এই তেল রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি নেই। এ বিষয়ে তাদের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ইরানকে এটি বন্ধ করা থেকে বিরত রাখতে চীনের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। তিনি ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘আমি বেইজিংয়ে চীনা সরকারকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য উৎসাহিত করছি, কারণ তারা তাদের তেলের জন্য হরমুজ প্রণালির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি তারা তা করে, তাহলে এটি হবে আরেকটি ভয়াবহ ভুল। যদি তারা এটি করে, তবে এটি তাদের জন্য অর্থনৈতিক আত্মহত্যা হবে।’
ইতিমধ্যে এমন খবর পাওয়া গেছে, যেখানে বলা হয়েছে, মার্কিন হামলার পর কিছু সুপারট্যাংকার বা তেলবাহী জাহাজ কৌশলগত এই পানিপথে ইউটার্ন করেছে বা ফিরে গেছে। এর কারণ, ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলা।
হরমুজ প্রণালি নিয়ে ইরান কী বলেছে
ইরানের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণমাধ্যম প্রেস টিভি জানিয়েছে, ইরানের সংসদ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার একটি পদক্ষেপ অনুমোদন করেছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ইরানের শীর্ষ নেতাদের ওপর। রোববার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস আরাঘচি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ট্রাম্পের ইরানে বোমা হামলার সিদ্ধান্তের চিরস্থায়ী পরিণতি হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে যোগদানের পর প্রথম মন্তব্যে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ইসরায়েল একটি গুরুতর ভুল করেছে এবং তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। তবে তিনি হরমুজ প্রণালি নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান