বিশ্বের শুষ্কতম মরুভূমি হঠাৎ কেন ভরে উঠেছে বিরল বন্যফুলে

সাধারণত এই ফুলের মেলা বসন্তকালে দেখা যায়রয়টার্স

উত্তর চিলিতে অবস্থিত আতাকামা মরুভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক স্থানগুলোর একটি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মরুভূমির যে বালু এত দিন ছিল একেবারে অনুর্বর ও প্রাণহীন, বর্তমানে সেখানেই সাদা ও বেগুনি রঙের বিরল মরুভূমির ফুলে ভরে উঠেছে। দেখলে মনে হবে, মরুভূমিতে যেন রঙের একটি চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী কারণে সেখানে এমন হলো?

আতাকামা মরুভূমিতে যখন এত ফুল ফোটে, তখন স্থানীয় মানুষজন এটিকে ডেসিয়েরতো ফ্লোরিডো বলে ডাকেন। এই নামের মানে ফুলের মরুভূমি। এটি কিন্তু নিয়মিত ঘটে না। বরং কয়েক বছর পরপর এই অবাক করা প্রাকৃতিক ঘটনা দেখা যায়।

এই ঘটনার রহস্য লুকিয়ে আছে মরুর মাটির গভীরে। এমনটা হয় যখন দীর্ঘ অপেক্ষার পর বৃষ্টির পরিমাণ ও তাপমাত্রা ঠিক যেমনটি দরকার অর্থাৎ সঠিক পরিমাণে এক হয়। তখনই মাটির নিচে থাকা মরুভূমির ফুলের বীজগুলো হঠাৎ প্রাণ ফিরে পায়। এরপর এরা সবাই একসঙ্গে অঙ্কুরিত হয়ে ফুল ফোটানো শুরু করে। আর রাতারাতি পুরো মরুভূমি রঙিন ফুলে ঢেকে গিয়ে এক অসাধারণ দৃশ্যের সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন

সাধারণত এই ফুলের মেলা বসন্তকালে দেখা যায়। কিন্তু এবার ফুল ফুটেছে অস্বাভাবিকভাবে তাড়াতাড়ি। দক্ষিণ গোলার্ধের শীতের মাঝামাঝি সময়েই। এর প্রধান কারণ হলো এল নিনো। এটি একটি প্রাকৃতিক জলবায়ুজনিত ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে। এর কারণেই অসময়ে বৃষ্টিপাত হয়।

সাধারণত এল নিনোর কারণে এই অঞ্চলের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। তাপমাত্রা বাড়লে একদিকে যেমন জলীয় বাষ্প দ্রুত বাষ্পীভূত হয়, ঠিক তেমনি বৃষ্টিপাতও বেশি হয়। এই অকাল ও অপ্রত্যাশিত অতিরিক্ত বৃষ্টিই রুক্ষ মরুভূমির মাটির নিচে থাকা সুপ্ত বীজগুলোকে অঙ্কুরিত করেছে।

আসলে আতাকামা মরুভূমিতে বছরে গড়ে মাত্র দুই মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়, যা অত্যন্ত কম। কিন্তু সম্প্রতি এখানে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। কিছু উঁচু অঞ্চলে জুলাই ও আগস্ট মাসেই ৬০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এই অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির ফলেই এখন চিলির ল্যানোস ডি চ্যালে জাতীয় উদ্যানটি এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে সেজে উঠেছে। পর্যটকরা জানিয়েছেন, উদ্যানজুড়ে ফুশিয়া ফুলের এক বিশাল গালিচা যেন বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

আরও পড়ুন
চিলির ল্যানোস ডি চ্যালে জাতীয় উদ্যানটি এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে সেজে উঠেছে
রয়টার্স

চিলির পন্টিফিকাল ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখিয়েছিল, গত ৪০ বছরে এই আতাকামা মরুভূমিতে মাত্র ১৫ বারের মতো এমন ফুলের দেখা মিলেছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে মরুভূমির এই ফুলের দেখা খুব বেশি মেলে না। এটি সত্যিই এক বিরল দৃশ্য!

এ ঘটনাকে আরও অস্বাভাবিক বলার হচ্ছে কারণ, ইদানীং যেন এই ফুলের মেলা কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে চলছে না। আগে সাধারণত কয়েক বছর পরপর এ ঘটনা ঘটত। যেমন ২০১৫ সালে একবার বড় আকারের ফুল ফুটেছিল। এরপর আবার ২০১৭ সালে। তারপরেরটি ঘটেছিল ২০২২ সালে। গবেষকরা জানিয়েছেন, অস্বাভাবিকভাবে ফুল ফোটার কারণ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব।

বর্তমানে চিলির আন্দ্রেস বেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই ফুশিয়া রঙের ফুল নিয়ে জেনেটিক সিকোয়েন্সিং পরীক্ষা করছেন। তাঁদের লক্ষ্য, এই ফুল কীভাবে গ্রহের অন্যতম কঠোর পরিবেশে যেখানে পানির অভাব ও তাপমাত্রা চরম, সেখানে বেঁচে থাকার মতো অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করল, তা খুঁজে বের করা।

আরও পড়ুন

এই গবেষণার মূল লক্ষ্য, ফুলটির মধ্যে থাকা খরাসহনশীল বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্ত করে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফসলে তা প্রয়োগ করা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা এখন কৃষি, আমাদের দেশ ও পুরো বিশ্বের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠছে। বর্তমানে এমন উদ্ভিদ তৈরি করা দরকার যেগুলো সেই খরা সহজে সহ্য করতে সক্ষম।

চিলি এখন পানিসংকটের মুখোমুখি। ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট চিলিকে বিশ্বের সবচেয়ে পানিসংকটপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে স্থান দিয়েছে। গবেষণায় সতর্ক করা হয়েছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে চিলির উর্বর কেন্দ্রীয় উপত্যকাজুড়ে চরম খরা দেখা যেতে পারে। উপত্যকাটি ফল, পশুপালনসহ দেশটির কৃষি রপ্তানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই গবেষণা চিলির ভবিষ্যৎ কৃষির জন্য খুবই জরুরি।

সূত্র: সিএনএন, রয়টার্স, বিবিসি

আরও পড়ুন