যোগ্য হয়েও নিজেকে অযোগ্য ভাবছ না তো

ইমপোস্টার সিনড্রোম মানে হলো, নিজের সাফল্যকে বিশ্বাস করতে না পারাছবি: পেক্সেলস ডটকম

ধরো, তুমি পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করলে কিংবা স্কুলে কোনো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেলে। সবাই তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, কিন্তু তোমার মনে হচ্ছে, ‘আরে না, আমার কেবল ভাগ্য ভালো ছিল দেখে হয়ে গেছে, না হলে আমি কখনোই পারতাম না!’ এ রকম কি কখনো মনে হয়েছে? মনে হয়েছে যে আমাকে যেসব কারণে সবাই ভালো বলছে বা প্রশংসা করছে, আমি সেসবের যোগ্য নই? যদি হয়ে থাকে, তবে তুমি একা নও। অনেকেরই মনে আসে এমন সব চিন্তা। এই অনুভূতির নাম ইমপোস্টার সিনড্রোম।

ইমপোস্টার সিনড্রোম মানে হলো, নিজের সাফল্যকে বিশ্বাস করতে না পারা। মনে হওয়া যে তুমি হয়তো অন্যদের বোকা বানাচ্ছ। অন্যরা যতটা ভাবছে, তুমি ততটা ভালো নও। ১৯৭৮ সালে দুজন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী পলিন ক্ল্যান্স আর সুজান আইমস প্রথম এই শব্দ ব্যবহার করেন। তাঁরা লক্ষ্য করেন যে অনেক বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী মানুষই নিজের অর্জন নিয়ে সন্দেহে ভোগেন।

আরও পড়ুন

এই অনুভূতি যে শুধু বড়দের মধ্যেই থাকে, তা নয়। ছোট–বড় যে কারও মধ্যেই থাকতে পারে। কেউ কেউ হয়তো ভাবে, ‘আমি ভাগ্যক্রমে জিতে গেলাম’, ‘অন্যরা আমার চেয়ে বেশি যোগ্য’, বা ‘একদিন সবাই বুঝে ফেলবে যে আমি আসলে ততটা ভালো নই’। কিন্তু সত্যিটা হলো, এ ধরনের ভয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবলই ভুল ধারণা।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগলে মানুষ নিজের সাফল্যকে ছোট করে দেখে, আবার নিজের ভুলগুলো বড় করে তোলে। এতে আত্মবিশ্বাস কমে যায়। নতুন কিছু করার সাহসও হারিয়ে ফেলে। তবে সুখবর হলো, এটা এমন কিছু নয় যা সারা জীবন সঙ্গে থাকবে। কিছু সহজ কৌশল মানলেই একে ধীরে ধীরে জয় করা যায়।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে, ভয় পাওয়া মানেই তুমি অযোগ্য নও, বরং তুমি শেখার পথে আছ। বড় বড় বিজ্ঞানী, লেখক, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা আর মার্কিন কবি মায়া অ্যাঞ্জেলোর মতো মানুষও বলেছেন, তাঁরাও কোনো না কোনো সময় নিজেদের নিয়ে সন্দেহে ভুগেছেন। তবু তাঁরা থেমে যাননি।

আরও পড়ুন

তাই ইমপোস্টার সিনড্রোম থাকলেও ভয় নেই। কিছু সহজ অভ্যাস গড়ে তুললেই বদলে যেতে পারে আমাদের মানসিকতা। চলো, জেনে নিই এমন কিছু উপায়, যা তোমারও কাজে লাগতে পারে।

১. নিজের ভয়গুলো লিখে রাখো

যখনই মনে হবে ‘আমি পারব না’, তখনই চিন্তাটা লিখে ফেলো। তারপর দেখো, সত্যিই কি এমন কিছু ঘটে কি না। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, আমরা যেসব ভয় কল্পনা করি, সেগুলো বাস্তবে ঘটে না। পরে সেই লেখা পড়লে তুমি বুঝবে যে ভয় পেলেও তুমি কাজটা করার চেষ্টা করেছিলে আর শেষ পর্যন্ত ঠিকই সফল হয়েছিলে। এভাবে নিজের লেখা পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে তোমার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

আরও পড়ুন

২. নিজের সাফল্যগুলো মনে রাখো

প্রতিদিন চেষ্টা করো, নিজের তিনটি ভালো কাজ লিখে রাখতে। হয়তো আজ একটা কঠিন গণিতের সমস্যার সমাধান করেছ, কিংবা বন্ধুকে সাহায্য করেছ, এই ছোট ছোট জয়ই তোমাকে মনে করিয়ে দেবে যে তুমি পারো। অনেক সময় আমরা নিজের প্রতি অতিরিক্ত কঠোর হই। তাই নিজের অর্জনগুলোও একটু উদ্‌যাপন করা দরকার। তুমি চাইলে ছোট ছোট স্টিকি নোটে সুন্দর অর্জনগুলো লিখে একটা কাচের জারে জমিয়েও রাখতে পারো। মন খারাপ কিংবা দ্বিধার মুহূর্তে সেই জার থেকে দুই–একটা কাগজ তুলে পড়লে নিজের অজান্তেই মনে সাহস ফিরে পাবে।

আরও পড়ুন

৩. তুলনা করা বন্ধ করো

আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই নিজেদের সেরা দিকটাই দেখায়। কেউ ব্যর্থতা, চেষ্টা বা কষ্টের কথা বলে না। ফলে অন্যদের দেখে আমাদের মনে হয়, সবাই ঠিকঠাক চলছে, শুধু আমিই পারছি না। কিন্তু এটা ভুল। প্রত্যেকের জীবনের পথ আলাদা, সবার জীবনেই অনেক কষ্ট আছে, যা দেখা যায় না। তাই অন্যদের সঙ্গে তুলনা না করে তুমি কেবল তোমার গতিতেই চলবে, অন্যের গতিতে নয়।

৪. প্রশ্ন করতে ভয় পেয়ো না

সবকিছু না জানাটা কোনো দোষ নয়। বরং প্রশ্ন করা, জানার চেষ্টা করা, এই মানসিকতাই শেখার প্রকৃত চাবিকাঠি। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর ‘নোটবুক অব থিংস আই ডোন্ট নো অ্যাবাউট’-এ লিখতেন, তিনি কী কী জানেন না। এর মধ্য দিয়েই তিনি আরও বড় আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

৫. নিজের গল্পটা নিজের মতো করে গড়ো

সবাই সব সময় আত্মবিশ্বাসী নয়। কিন্তু চেষ্টা করলে আত্মবিশ্বাস শেখা যায়। কেউ কেউ ইংরেজিতে বলে, ফেক ইট টিল ইউ মেক ইট। কিন্তু আসলে সত্যি পথটা হলো, ফেস ইট টিল ইউ মেক ইট। পথে যত বাধাই আসুক না কেন, এড়িয়ে না গিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। ভয়, সন্দেহ কিংবা ছোটখাটো ভুলকে ভয় না পেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই আসল সাহসিকতা।

মনে রেখো, ইমপোস্টার সিনড্রোম থাকা মানে তুমি দুর্বল নও, বরং তুমি যত্নবান। তুমি নিজেকে নিয়ে সচেতন। তুমি চাও কাজটা ভালোভাবে করতে, এ জন্যই মাঝেমধ্যে নিজের ওপর সন্দেহ জাগে। মূলত প্রত্যেক সফল মানুষই একসময় এই অনুভূতির ভেতর দিয়ে গেছেন। পার্থক্য একটাই যে তাঁরা থেমে যাননি।

তাই যখন পরেরবার মনে হবে, আমি কি সত্যিই এতটা ভালো, তখন নিজেকে বোলো, হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করছি, আমি শিখছি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, সাইকোলজি টুডে, দ্য ইমপোস্টার কিউর (ড. জেসামি হিবার্ড), ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা রিসার্চ আর্কাইভ

আরও পড়ুন