টিভির সাইজ ৪০ না হয়ে ৪৩ ইঞ্চি হয় কেন
কখনো বাবা-মায়ের সঙ্গে নতুন টিভি কিনতে গিয়েছ? দোকানে গেলে দেখবে নানা সাইজের টিভি দিয়ে সাজানো। কোনোটা ৩২ ইঞ্চি, কোনোটা ৪৩ ইঞ্চি, আবার ৫৫ বা ৬৫ ইঞ্চির দেখাও পাবে। কিন্তু ৩০, ৪০, ৫০ বা ৬০ ইঞ্চির মতো রাউন্ড ফিগারের টিভি সাধারণত চোখে পড়ে না। কেন এমন অদ্ভুত সাইজের টিভি বানানো হয়? ৪০ ইঞ্চির পরিবর্তে ৪৩ ইঞ্চি হলে কি বিশেষ কোনো সুবিধা আছে, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো রহস্য?
অনেকেই ভাবতে পারো, এটা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য কোম্পানিগুলোর একটা ব্যবসায়িক কৌশল। এই ধারণাটি আংশিক সত্যি। তবে এর পেছনে আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত কারণও রয়েছে।
এর মূল কারণ হলো টিভির পর্দা তৈরির প্রক্রিয়া। টিভির পর্দাগুলো কিন্তু একটি একটি করে বানানো হয় না। ‘মাদার গ্লাস’ নামে বিশাল আকারের একটি কাচের পাত থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো পর্দা কেটে নেওয়া হয়। কাচের এই পাতেরও বিভিন্ন প্রজন্ম বা জেনারেশন থাকে। যেমন, জেন ৮ বা জেন ১০। নির্মাতাদের লক্ষ্য থাকে, এক ইঞ্চি কাচও যেন নষ্ট না হয়। তারা এমনভাবে পর্দাগুলো কাটে, যাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পর্দা বের করে আনা যায়। হিসাব করে দেখা গেছে, বর্তমানে টিভির পর্দার যে ১৬:৯ অনুপাত রয়েছে—একে আমরা বলি ওয়াইডস্ক্রিন—তাতে ৪৩ ইঞ্চি সাইজের পর্দা কাটলে কাচের অপচয় সবচেয়ে কম হয়। কিন্তু ৪০ ইঞ্চি করে কাটতে গেলে অনেক কাচ নষ্ট হয়।
টিভির সাইজ কীভাবে মাপা হয়, তাও জানা জরুরি। আমরা যখন ‘৪৩ ইঞ্চি টিভি’ বলি, তখন এর পর্দার এক কোণা থেকে বিপরীত কোণার দূরত্ব বোঝানো হয়। তবে অনেক সময়ই এই মাপটি একেবারে কাঁটায় কাঁটায় হয় না; কোম্পানিগুলো দশমিকের পরের সংখ্যাকে রাউন্ড আপ করে বলে। তাই ৪২.৫ ইঞ্চি পর্দার টিভিকে ৪৩ ইঞ্চি হিসেবেই বাজারজাত করা হয়। তবে এই মাপ মানে কিন্তু টিভির দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ নয়, বরং এর কোনাকুনি দূরত্ব।
কাগজে-কলমে ৪০ ইঞ্চি এবং ৪৩ ইঞ্চি টিভির মধ্যে পার্থক্যটা কম মনে হতে পারে। ৪০ ইঞ্চি টিভির স্ক্রিন প্রায় ৮৯ সেন্টিমিটার চওড়া, আর ৪৩ ইঞ্চি টিভি ৯৫ সেন্টিমিটার। কিন্তু ‘মাদার গ্লাস’ থেকে পর্দা কাটার সময় এই কয়েক সেন্টিমিটারের পার্থক্যই উৎপাদন খরচে বড় প্রভাব ফেলে। মজার ব্যাপার হলো, তোমার সামনে একটি ৪০ ইঞ্চি ও একটি ৪৩ ইঞ্চি টিভি রাখলেও চোখের দেখায় বড়-ছোট আলাদা করা কঠিন হয়ে যাবে।
এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি। আগেকার দিনের সেই বক্সের মতো দেখতে পুরনো টিভিগুলোর কথা মনে আছে? সেগুলোর পর্দা ছিল কিছুটা চারকোনা। মানে ওগুলো ৪:৩ অনুপাতের। কিন্তু এখনকার টিভিগুলো হয় আয়তাকার, মানে ১৬:৯ অনুপাতের। প্লাজমা এবং এলসিডি টিভির যুগে ৪২ ইঞ্চি খুব জনপ্রিয় সাইজ ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি আরও উন্নত হয়েছে, 4K রেজ্যুলেশন এসেছে এবং সেই ৪২ ইঞ্চি সাইজটাই উৎপাদন সুবিধার জন্য একটু পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে আজকের ৪৩ ইঞ্চি। অর্থাৎ, ৪৩ ইঞ্চি হলো সেই জনপ্রিয় ৪২ ইঞ্চি সাইজেরই আধুনিক রূপ।
তাহলে বোঝা গেল, টিভির এমন অদ্ভুত সাইজ বানানো হয় যাতে কাচের অপচয় কম হয়। একই হিসাব ৫৫ বা ৬৫ ইঞ্চির মতো অন্যান্য জনপ্রিয় সাইজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে মূল কারণ শুধু এটুকুই নয়। উৎপাদন পদ্ধতির পাশাপাশি ক্রেতার মনস্তত্ত্ব নিয়েও একটি খেলা রয়েছে।
আমাদের মধ্যে বড় জিনিসের প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ কাজ করে। ৪০ ইঞ্চির চেয়ে ৪৩ ইঞ্চি শুনলেই মনে হয়, বাহ্, এটা বেশ বড়! যদিও বাস্তবে পার্থক্যটা খুব বেশি নয়, কিন্তু এই ‘৩ ইঞ্চি বেশি’ কথাটাই ক্রেতাদের অনেক বেশি আকর্ষণ করে। তাই কোম্পানিগুলো ৩২ ইঞ্চির পর আর ৩৩-৪২ ইঞ্চির টিভি না বানিয়ে সরাসরি ৪৩ ইঞ্চির টিভি বানায়।
তাছাড়া, ৪৩ ইঞ্চি পর্দার খরচ যেহেতু প্রায় ৪০ ইঞ্চির মতোই, তাই কোম্পানিগুলো সামান্য বেশি দামে এটি বিক্রি করতে পারে। ক্রেতারাও ভাবে, অল্প কিছু টাকা বেশি দিয়ে যখন বড় পর্দা পাওয়া যাচ্ছে, তখন সেটাই নেওয়াই ভালো। এভাবেই উৎপাদন খরচ এবং ক্রেতার মনস্তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে ৪৩ ইঞ্চি টিভি বাজারে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছে।
এখানে আরও একটি বৈজ্ঞানিক দিক আছে। টিভি দেখার সময় চোখের আরামের জন্য একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে বসতে হয়। 4K রেজল্যুশনের টিভিগুলো এখন অনেক জনপ্রিয়। এত বেশি পিক্সেল থাকার কারণে পর্দা একটু বড় হলেও ছবি ঝাপসা লাগে না। তাই ৪০ ইঞ্চির বদলে ৪৩ ইঞ্চি নিলেও দেখতে কোনো সমস্যা হয় না।
তবে ৪৩ ইঞ্চির টিভি সব জায়গায় মানায় না। ছোট ঘরে বা সংকীর্ণ জায়গায় হয়তো এটা অনেক বড় মনে হতে পারে। কিন্তু তবুও উৎপাদনকারীরা আলাদা করে ৪০ ইঞ্চি বানালে খরচ বেড়ে যাবে, আর বিক্রিও হবে কম। সে কারণে প্রায় সব ব্র্যান্ডই ৪০ ইঞ্চি বাদ দিয়ে ৪৩ ইঞ্চির টিভি বানায়।
সূত্র: ডিসপ্লে নিনজা, টেক রাডার, সিনেট ও কনজুমার রিপোর্টস