কোরিয়ান ডিএমজিতে ল্যান্ডমাইন যেভাবে প্রাণীর অভয়ারণ্য তৈরি করেছে
উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝখানে অবস্থিত সীমান্ত অঞ্চল কোরিয়ান ডিএমজি। এটি এমন এক ভূমি, যেখানে আছে কাঁটাতারের বেড়া আর ল্যান্ডমাইন। মানুষের জন্য এই স্থলমাইন আর বেড়া ভয়ংকর হলেও, প্রাণীদের জন্য তা যেন এক আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। কঠোর সামরিক নিষেধাজ্ঞার আড়ালে লুকিয়ে আছে ঘন বন। এখানে বাসা বেঁধেছে বিরল প্রজাতির সারস। নিরাপদে আছে হরিণ, ভালুকসহ প্রায় ৬,০০০ প্রজাতির প্রাণী।
ডিএমজি এলাকাটি একসময় ছিল বোমাবর্ষণের লক্ষ্য। গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখানকার প্রকৃতি বেড়ে উঠেছে নিজের মতো। দুই কোরিয়ার মাঝখানে এই ভূমিকে বলে ডিমিলিটারাইজড জোন। সংক্ষেপে ডিএমজি। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত চলা ধ্বংসাত্মক কোরীয় যুদ্ধের পর এই সুরক্ষিত সীমান্ত তৈরি করা হয়। কোরীয় যুদ্ধ শেষ হয়েছিল যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে। শান্তি চুক্তি হয়নি। ফলে দুই দেশের মধ্যে একটি বাফার জোন স্থাপন করা হয়। বাস্তবে যুদ্ধ শেষ হলেও প্রযুক্তিতে এখনো দেশদুটি যুদ্ধাবস্থায় রয়ে গেছে।
২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২.৪ কিলোমিটার চওড়া এই ডিএমজি আসলে নামেই বেসামরিক। এটি বিশ্বের অন্যতম সুরক্ষিত সীমান্ত। এখানে প্রচুর স্থলমাইন এবং দুই পাশেই অনেক সামরিক স্থাপনা আছে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৭২ বছর পর এই নিষিদ্ধ ভূমি হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক স্বর্গ। দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোলজি এখানে প্রায় ৬,০০০ প্রজাতির জীবজন্তুর সন্ধান পেয়েছে। যার মধ্যে ১০০টির বেশি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী আছে। এই সংখ্যা দক্ষিণ কোরিয়ার মোট বিপন্ন বন্যপ্রাণীর এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
প্রাণীগুলো ডিএমজির বিভিন্ন ভূখণ্ডে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এর পশ্চিমাঞ্চলের জলাভূমিতে বাসা করে পরিযায়ী সারস পাখি। রুক্ষ পূর্বাঞ্চলের পর্বতমালায় আছে দেশের সবচেয়ে বিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীরা। এখানেই নিরাপদে বাস করে সাইবেরিয়ান কস্তুরি হরিণ এবং এশিয়ান কালো ভালুক।
গবেষকেরা ২০ বছর ধরে এই অভয়ারণ্যের তথ্য সংগ্রহ করছেন। প্রতি সপ্তাহে বৃষ্টি হোক বা রোদ, তাঁরা এর ওপর নজর রাখেন। বিশ্বজুড়ে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু আছে এমন এলাকায় প্রচুর মানুষ বাস করে। এসব অঞ্চলে বড় বড় শহর গড়ে উঠেছে। এভাবে প্রকৃতিকে একা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এমন জায়গা আর কোথাও নেই।
ডিএমজি এবং এর আশেপাশের এলাকা দক্ষিণ কোরিয়ার মোট ভূমির ১০ শতাংশের কম জায়গাজুড়ে আছে। দেশটির ৩৮ শতাংশ বিপন্ন প্রজাতি এবং ৩০ শতাংশের বেশি উদ্ভিদ ও প্রাণী এখানে বাস করে। তবে দুঃখজনক হলো, মানুষকে ধ্বংসের জন্য যে অস্ত্র তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোই হয়ে উঠেছে বন্য জীবনের সবচেয়ে বড় রক্ষক।
এখানে গবেষণা করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। অঞ্চলটির বেশিরভাগ অংশ সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ। সামরিক বাহিনী কঠোরভাবে এখানে পাহারা দেয়। এর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত সিভিলিয়ান কন্ট্রোল জোনে প্রবেশাধিকার খুব সীমিত। সাধারণ নাগরিকদের এখানে যেতে সামরিক চেকপোস্ট পেরোতে হয়। এর জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ অনুমতি লাগে। কিছু এলাকায় সামরিক প্রহরাও লাগে।
রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়লেই সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সবার আগে সীমিত করে ফেলা হয়। অনুমতি থাকলেও তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ফোন আসে। বলা হয়, সীমান্তে হঠাৎ সামরিক কার্যকলাপের কারণে প্রবেশের অনুমতি বাতিল করা হয়েছে।
যুদ্ধ কিংবা শান্তি, দুটোই এই এলাকার জীবজন্তুর জন্য হুমকি। যেকোনো শান্তি চুক্তি হলেই এখানে উন্নয়ন হবে। তখন বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আর যুদ্ধে তো ক্ষয়ক্ষতি হয়ই। মানুষ যেমন মারা যায়, প্রাণীর জীবনও ধ্বংস হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে গবেষকেরা মনে করেন, ডিএমজেডের ভবিষ্যৎ কী হবে তা বর্তমান প্রজন্মের ঠিক করা উচিত নয়। বরং জীববৈচিত্র্যের প্রকৃত মূল্য বোঝে এমন একটি প্রজন্মের ওপর এর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়া উচিত।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান