ভালুকের আক্রমণ ঠেকাতে মাঠে নামছে জাপানি সেনা
সাধারণত বন্যা, ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিপর্যয় সামাল দিতে সামরিক বাহিনীকে নামতে দেখা যায়। কিন্তু যখন দেশের সেনাবাহিনী নামছে মারাত্মক বন্য ভালুকের উপদ্রব সামলাতে, তখন পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ, তা সহজেই আন্দাজ করা যায়।
জাপানে এখন শরৎকাল। এই সময়ে সাধারণত সেখানকার মানুষ প্রাণবন্ত রঙিন পাতার সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকেন। তবে এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাপানের সর্বত্রই এখন ভালুকের আক্রমণে ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটছে। সুপারমার্কেট থেকে শুরু করে কৃষকের জমি, বাড়ির সামনে কিংবা হট স্প্রিং রিসোর্ট কোথাও এখন আর নিরাপদ না।
ইতিমধ্যেই এ বছর ভালুকের আক্রমণে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ১০০ জনের বেশি মানুষ আহত এবং ১১ জন মারা গেছেন। বিশেষ করে উত্তর জাপানের পাহাড়ি অঞ্চল আকিতা প্রিফেকচারে মানুষজন প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
চরম এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় শিকারি বা পুলিশ আর একা সামাল দিতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে দেশের নাগরিকদের জীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাপান সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভালুকের আক্রমণ ঠেকাতে এবার সামরিক বাহিনী কাজ করবে।
গত ২৮ অক্টোবর, মঙ্গলবার জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উত্তর জাপানের পাহাড়ি অঞ্চল আকিতা প্রিফেকচারে সেনাসদস্য পাঠানো হবে। সৈন্যরা মূলত ভালুক ধরার ফাঁদ বসানো ও মৃত ভালুকের দেহ সরিয়ে স্থানীয় শিকারিদের সাহায্য করবে। তবে সৈন্যদের ভালুক মারার কথা নয়। এই কাজ স্থানীয় শিকারিদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা ভালুকের আক্রমণের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে দুটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বনাঞ্চলে ভালুকদের প্রিয় খাবার বিচগাছের বাদামের অভাব দেখা দিয়েছে। পেটে খাবার না থাকায় ক্ষুধার্ত ভালুকেরা তখন লোকালয়ের দিকে আসতে বাধ্য হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জাপানের গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণেও সমস্যাটি বেড়েছে। একসময় যে গ্রামগুলো মানুষের ভিড় থাকত, এখন সেখানে মানুষ কম থাকায় ভালুকেরা সহজেই সেসব জনশূন্য এলাকায় প্রবেশ করছে।
বর্তমানে এশিয়ান কালো ভালুক ও বাদামি ভালুক এই দুই প্রজাতির ভালুকের সংখ্যাই ক্রমে বাড়ছে। পরিস্থিতি এত খারাপ হয়েছে যে ভালুকেরা আর শুধু পাহাড়ের ভেতরে থাকছে না। টোকিওর বাইরের এলাকাগুলোসহ বিভিন্ন মানুষের বসতিতেও এরা এখন মনমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক নিয়মে ভালুকেরা সাধারণত শীতনিদ্রায় যাওয়ার আগে, বিশেষ করে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে খাবারের খোঁজে খুব আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এই সময়েই আক্রমণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে।
সাম্প্রতিক ভালুকের আক্রমণের কিছু ঘটনা জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ভালুকেরা স্কুলের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ছে। এরা ট্রেনের ট্র্যাক দিয়ে দৌড়াচ্ছে। এমনকি বাসস্টপে একজন পর্যটককে আক্রমণ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। উত্তর জাপানের ইওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ক্যাম্পাসে ভালুক দেখে নিরাপত্তার কারণে দুদিনের জন্য ক্লাস বাতিল করতে বাধ্য হয়।
প্রায় ৮ লাখ ৮০ হাজার মানুষের আবাসস্থল আকিতা প্রিফেকচারে। এই বছর শুধু আকিতাতেই ৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন এবং দুজন মারা গেছেন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন একজন ৭৩ বছর বয়সী নারী। যিনি আবর্জনা ফেলতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হন। আরেক জন ৩৮ বছর বয়সী পুরুষ। যিনি অফিসে যাওয়ার সময় নিহত হন।
জাপানের উত্তরাঞ্চলের আকিতা প্রিফেকচারে ভালুকের আক্রমণের ঘটনা এখন চরম আকার নিয়েছে। এই মারাত্মক পরিস্থিতি স্থানীয় প্রশাসন বা শিকারিদের একার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই আকিতার গভর্নর কেন্টা সুজুকি বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সামরিক বাহিনীর সাহায্য চেয়েছেন। তিনি মনে করেন, এই মুহূর্তে সামরিক বাহিনীর সাহায্য ছাড়া সাধারণ মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী শিনজিরো কোইজুমি বলেছেন, সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। তবে আইন অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ভালুক মারার অনুমতি নেই। তারা শুধু মৃত প্রাণী পরিবহন করতে পারে। তাই প্রাথমিকভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভালুকের উপদ্রব মোকাবিলার জন্য একটি বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করতে আকিতায় সেনা কর্মকর্তাদের একটি দল পাঠাবে। পরে সেনারা সেখানে ভালুক ধরার জন্য বাক্স ফাঁদ বসাতে এবং অন্যান্য সহায়ক কাজ করতে সাহায্য করবে। জনগণের জীবন হুমকির মুখে থাকায় সরকার কিছু না করে বসে থাকতে পারে না। তবে সামরিক বাহিনীর অন্যান্য জরুরি কাজে যেন কোনো বাধা না আসে, সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান