ইস্টার আইল্যান্ডের ভারী মূর্তিগুলো সরানো হয়েছিল যেভাবে, ৫০০ বছরের রহস্য সমাধান করলেন গবেষকেরা
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছোট্ট একটি দ্বীপের নাম ইস্টার আইল্যান্ড। দ্বীপটি বিখ্যাত তার বিশাল বিশাল পাথরের মূর্তির জন্য। এদের নাম মোয়াই। শত শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না, কীভাবে প্রাচীন রাপা নুই নামের জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা এত ভারী মূর্তিগুলোকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল? কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এই ৫০০ বছরের পুরোনো রহস্যের সমাধান করেছেন। তাঁরা বলছেন, মূর্তিগুলোকে সরানো হতো না। মূর্তিগুলো নিজেরাই ‘হেঁটে হেঁটে’ যেত! নিশ্চয়ই হেঁটে যাওয়ার কথা শুনে অবাক হচ্ছ। ভাবছ, পাথর আবার হাঁটে কীভাবে! চলো, আসল রহস্যটা জেনে নিই।
কীভাবে ‘হাঁটত’ পাথরের মূর্তি
যুক্তরাষ্ট্রের বিংহামটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী কার্ল লিপো এবং অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টেরি হান্ট এই ‘হাঁটার’ তত্ত্বটি দিয়েছেন। তাঁরা প্রায় এক হাজার মূর্তি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁরা বলছেন, প্রাচীন মানুষেরা মূর্তিগুলোর গায়ে দড়ি বেঁধে সেগুলোকে এক পাশ থেকে আরেক পাশে দোলাত। এতে মূর্তিগুলো হেলেদুলে জিগজ্যাগ ভঙ্গিতে সামনের দিকে এগিয়ে যেত।
আরেকটু খোলাসা করে বলি। আমরা যখন কোনো ভারী ফ্রিজ বা আলমারি একা একা সরানোর চেষ্টা করি, তখন কী করি? প্রথমে এক কোনা সামনে ঠেলি, তারপর আরেক কোনা। এভাবে হেলেদুলে জিনিসটা ঠিকই একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যায়। মোয়াইগুলোকেও ঠিক এভাবেই ‘হাঁটানো’ হতো!
নৃবিজ্ঞানী কার্ল লিপো বলেন, ‘একবার দুলতে শুরু করলে মূর্তিগুলোকে সরানো মোটেও কঠিন ছিল না। এরপর ওই মূর্তি সরাতে শক্তিও লাগত কম, আবার বেশ দ্রুত সামনে এগোত।’
তত্ত্বের প্রমাণ
বিজ্ঞানীরা একটা তত্ত্ব দিলেন, আর আমরা তা বিনা যুক্তিতে বিশ্বাস করে নেব, তা তো হয় না! তত্ত্বের প্রমাণ তো থাকা লাগবে। তত্ত্বটি প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রথমে মূর্তিগুলোর কম্পিউটার থ্রিডি মডেল তৈরি করেন। তাঁরা দেখেন, মূর্তিগুলোর নিচের দিকটা ইংরেজি ‘D’ অক্ষরের মতো চ্যাপটা। আর পুরো মূর্তিটাই সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে থাকে। এই বিশেষ গঠনের কারণেই মূর্তিগুলোকে দোলানো এবং হাঁটানো খুব সহজ ছিল।
এরপর তাঁরা বাস্তবে এটা পরীক্ষা করে করেন। ৪ দশমিক ৩৫ টন ওজনের একটি নকল মোয়াই তৈরি করেন। অর্থাৎ, ওই নকল মোয়াইটার ওজন ছিল প্রায় তিনটি গাড়ির সমান। তারপর মাত্র ১৮ জন মানুষ মিলে দড়ির সাহায্যে মূর্তিটিকে হাঁটাতে শুরু করেন! মাত্র ৪০ মিনিটে ওই মূর্তিটিকে তাঁরা ১০০ মিটার দূরে নিয়ে যান। একটি ফুটবল মাঠের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ মিটার।
এই হাঁটার তত্ত্বের পক্ষে আরও একটি বড় প্রমাণ হলো, দ্বীপের প্রাচীন রাস্তাগুলো। এই রাস্তাগুলো ভেতরের দিকে কিছুটা বাঁকানো। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই বাঁকানো রাস্তাই হাঁটার সময় বিশাল মূর্তিগুলোকে সোজা রাখতে এবং পড়ে যাওয়া থেকে আটকাতে সাহায্য করত।
রাপা নুই মানুষদের প্রতি সম্মান
গবেষণাটি রাপা নুইয়ের প্রাচীন মানুষদের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার প্রতি সম্মান জানায়। অনেকেই আজগুবি সব গল্প বানিয়েছিল। কেউ বলত, ভিনগ্রহের প্রাণীরা এসে এই মূর্তি বানিয়ে দিয়ে গেছে! কিন্তু এই গবেষণা প্রমাণ করে, কোনো অলৌকিক শক্তি নয়, বরং সেখানকার মানুষেরাই নিজেদের জ্ঞান এবং প্রকৌশলগত দক্ষতা দিয়ে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন।
লিপো বলেন, ‘এটি দেখায় যে রাপা নুইয়ের মানুষেরা অবিশ্বাস্য রকমের বুদ্ধিমান ছিলেন। তাঁরা তাঁদের সীমিত সম্পদ দিয়েই এই কাজটি করার উপায় বের করেছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।’
সুতরাং ইস্টার আইল্যান্ডের মূর্তিগুলো কীভাবে সরানো হয়েছিল, সেই রহস্যের আর কোনো ধোঁয়াশা রইল না। বিজ্ঞান প্রমাণ করে দিল, সেখানকার মানুষেরাই ছিলেন আসল প্রকৌশলী। তাঁরা পাথরকেও হাঁটাতে পারতেন! এই গবেষণা ‘জার্নাল অব আর্কিওলজিক্যাল সায়েন্স’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
সূত্র: সায়েন্স ডেইলি ডটকম