মরুভূমির সিংহ এখন সমুদ্রের সিল শিকার করে বাঁচে
নামিবিয়ার একদল ‘ডেজার্ট লায়ন’ (মরুভূমির সিংহ) পুরোনো শিকারভূমি ছেড়ে চলে এসেছে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে।
তারা আগে শুধু শুকনা মরুভূমিতেই বাঁচত। কিন্তু খাদ্যের খোঁজে তারা মরুভূমি ছেড়ে এসে পরিণত হয়েছে বিশ্বের একমাত্র সমুদ্রতটের সিংহে।
বেলজিয়ামের আলোকচিত্রী গ্রিয়েট ভ্যান মালডেরেন এই সিংহের অবিশ্বাস্য অভিযোজনের মুহূর্ত ধারণ করেছেন তাঁর ক্যামেরায়।
এ যেন সিনেমার দৃশ্য—নামিবিয়ার পাথুরে সৈকতে এক সিংহী দূরে তাকিয়ে আছে। পেছনে উত্তাল ঢেউ। তার সামনে পড়ে আছে শিকার—সদ্য মৃত একটি কেপ ফার সিল।
ছবির সিংহীটির নাম গামা। নামিবিয়ার বিখ্যাত ডেজার্ট লায়নদের একজন সে। তারা প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য শিখে নিয়েছে নতুন এক জীবনযাপন। ছবিটি লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের আয়োজিত মর্যাদাপূর্ণ এক প্রতিযোগিতায় ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
ভ্যান মালডেরেন বলেন, ‘সত্যিই অবিশ্বাস্য, কীভাবে তাদের আচরণ বদলে যাচ্ছে!’
মরুভূমি থেকে উপকূলে
স্কেলেটন কোস্টে এখন এমন মরুভূমির সিংহ আছে মাত্র ১২টি। আর সারা নামিবিয়ায় তা আছে প্রায় ৮০টি।
খাদ্যাভাব দেখা দিলে ২০১৭ সালে তারা মরুভূমি ছেড়ে আটলান্টিক উপকূলে চলে আসে। তারা সম্পূর্ণ নতুন এক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়। সিল শিকার করে টিকে থাকতে শিখে যায়।
ভ্যান মালডেরেন বলেন, তাঁর তোলা ছবিটি দেখায়, সিংহগুলো কতটা সহনশীল। বাঁচার জন্য তারা নিজেদের আবাস বদলেছে। জীবন মানেই সংগ্রাম। এখানে টিকে থাকাই মূল কথা।
ভ্যান মালডেরেন গামাকে ছোটবেলা থেকেই দেখছেন। তিন মাস বয়সে প্রথম দেখেছিলেন। এখন তার বয়স সাড়ে তিন বছর। এখন সে এক দুর্ধর্ষ শিকারি। এক রাতে ৪০টি সিল ধরতে সক্ষম সে।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষক ন্যাটালি কুপার বলেন, ‘আমরা সাধারণত সিংহকে সাভানায় বা পাথরের ওপর শুয়ে থাকতে দেখি। কিন্তু সৈকতে সিংহ দেখা সত্যিই অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য দৃশ্য।’
অনন্য সহনশীলতা
বিজ্ঞানী ফিলিপ স্ট্যান্ডার ১৯৮০ সাল থেকে নামিবিয়ার এই সিংহদের পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, গামা এই প্রজাতির নতুন প্রজন্মের সদস্য। সে সমুদ্রতটে জন্ম নিয়েছে। প্রথম থেকেই উপকূলে বড় হয়েছে।
ফিলিপ স্ট্যান্ডারের মতে, ভ্যান মালডেরেনের ছবিটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ছবিটি গামার সমুদ্রতটে একা কাটানো, প্রথম একক শিকারের দিনকে তুলে এনেছে।
১৯৮০-এর দশকে এই সিংহগুলো স্কেলেটন কোস্টে থাকত। কিন্তু খরা ও কৃষকদের সঙ্গে সংঘাতের জেরে তারা সরে যায় মরুভূমিতে। এখন আবার তারা সেই সমুদ্র উপকূলেই ফিরে এসেছে।
স্ট্যান্ডার বলেন, সিংহগুলো বসবাস করে পৃথিবীর সবচেয়ে অনুর্বর জায়গায়। কোনো গাছ নেই, পানি নেই। তবু তারা বেঁচে আছে। তারা যেন প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ অ্যাথলেট। তারা পানির ওপর নির্ভর না করে খাবার থেকেই আর্দ্রতা পায়, যা তাদের অনন্যভাবে টিকে থাকতে সাহায্য করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
২০১৫ সালের ভয়াবহ খরায় যখন ওরেক্স, অস্ট্রিচ ও স্প্রিংবকের মতো শিকার বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ে, তখন এই সিংহগুলো সমুদ্রের দিকে আসে। সিল, ফ্লেমিঙ্গো আর সামুদ্রিক পাখি হয়ে ওঠে তাদের নতুন শিকার।
ভ্যান মালডেরেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এই সিংহগুলোকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে। ফলে তারা বাঁচার জন্য সমুদ্রতটের দিকে চলে এসেছে। সমুদ্রতীরই এখন তাদের আশ্রয়। আগের প্রজন্মের সিংহীরা জিরাফ শিকার করত। আর এখন তাদের উত্তরসূরিরা শিখছে সিল ধরতে। প্রকৃতির এই বিবর্তন নিজের চোখে দেখা সত্যিই বিস্ময়কর।
২০২৫ সালের মার্চে উপকূলে জন্ম নিয়েছে দুটি সিংহশাবক। গবেষকেরা বলছেন, তাদের বেড়ে ওঠা দেখলে বোঝা যাবে, এই অভিযোজন কতটা স্থায়ী হতে পারে।
সুরক্ষা জরুরি
স্ট্যান্ডার বলেন, যদিও এদের সংখ্যা কম, কিন্তু যদি ঠিকভাবে রক্ষা করা যায়, তাহলে তারা আবার শক্তিশালী প্রাণীর গোষ্ঠীতে পরিণত হবে।
মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে ‘ভার্চ্যুয়াল ফেন্সিং সিস্টেম। সিংহ কোনো গ্রাম বা পর্যটন এলাকায় ঢুকলেই সতর্কবার্তা যায়। প্রয়োজনে আতশবাজি দিয়ে দূরে সরানো হয়।
ভ্যান মালডেরেন বলেন, ‘আমার ছবির লক্ষ্য শুধু সৌন্দর্য দেখানো নয়; মানুষকে বোঝানো, এই প্রাণীরা কতটা নাজুক। তাদের টিকে থাকার শক্তি আমাদের শেখায়, পরিবর্তনের মুখোমুখি হলে মানিয়ে নিতেই হবে।’
সূত্র: বিবিসির প্রতিবেদন অবলম্বনে