একজন রকিব হাসান ও সেবা প্রকাশনীর গুগল

রকিব হাসান

কারও সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে বা লিখতে গেলে সবচেয়ে যেটা জরুরি, সেটা হলো তাঁকে ভালো করে জানা-শোনা, থাকা কিংবা দেখা হওয়া। রকিব হাসান সাহেবের সঙ্গে আমার জীবনে দেখা হয়েছে মোট তিনবার। কিন্তু এই লেখার জন্য আমার অবলম্বন হচ্ছে বাড়িতে মুখে মুখে শোনা তাঁর সম্পর্কে গল্প। যদিও তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়াটাই ছিল বেশি মজার। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম আমার ছোট ছেলে রামিনকে কোলে নিয়ে। রামিনের বয়স তখন ৮ কি ৯ মাস। রকিব হাসান সাহেব সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন ওপরের দিকে। চোখে বাদামি রোদচশমা। ওটাই আবার পাওয়ার্ড। আমাকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। চোখ থেকে ধাঁ করে সানগ্লাস খুলে বললেন,

‘আরে, কে রে এটা?’

আমিও অবাক তাঁর মুখে এমন কথা শুনে।

আমাকে কনফিউশন থেকে মুক্ত করে দিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন তিনি, ‘আমারে এক্কেরে চমকায়া দিছো, বউমা...আকাশ থেইকা পড়লাম জানি! এমনও হয়?’

আমি ওঁর কথা বুঝতে না পেরে হাঁ করে রইলাম কিছুক্ষণ।

‘বুঝলা না, তা-ই তো?...তোমার কোলেরটার কথা কই...এইডা রিংকুর (কাজী মায়মুর হোসেন) পোলা শিওর...কী কারবার...আমি ফির৵া গেছি সেই ১৯৭৭ সালে, যখন সেবা প্রকাশনীতে প্রথম আইছিলাম...এক চেহারা...এক বয়স...সমীরণের মায়ের (রিংকুর আয়া) কোলে সারা দিন ঘুরতাছে আর বিস্কুটের টিন থাপড়াইতাছে...পোলা দেহি বাপের পুরো ফটোকপি...’ বলে আবারও একগাল হাসলেন তিনি। কোলে নিয়ে একটু আদর করে চলে গেলেন অফিসে। ২০১১ সালের কথা সেটা।

কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল একেবারে আপন ভাইয়ের মতো। আব্বা তাঁকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। একসঙ্গে লেখালেখি, আড্ডা ছিল তাঁদের নিয়মিত রুটিন। সেবা প্রকাশনীতে তাঁর আগমনটা ছিল আকস্মিক এক ঘটনা।

আরও পড়ুন

১৯৭৫ সালের কথা। তুঙ্গে তখন ‘মাসুদ রানা’র জনপ্রিয়তা। দুই হাতে লিখে চলেছেন গোস্টরাইটাররা। কিন্তু যেহেতু বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে ‘মাসুদ রানা’ লেখা হতো, তাই ‘মাসুদ রানা’র বাজার ধরে রাখার জন্য গোস্টরাইটারসহ সবাই সেই ইংরেজি বইগুলোর সন্ধানে থাকতেন—যেটা দিয়ে লেখা যাবে নতুন ‘মাসুদ রানা’। ইংরেজি বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারা ছিল সেবা প্রকাশনীর লেখকদের নিয়মিত রুটিন। একটা ভালো বইয়ের সন্ধানদাতার জন্যও ছিল নির্দিষ্ট সম্মানী।

এভাবেই সেগুনবাগিচার কয়েকটি ইংরেজি বইয়ের দোকানের একটিতে বইয়ের সন্ধান করতে গিয়ে শেখ আবদুল হাকিম সাহেব দেখা পান রকিব হাসান সাহেবের।

একহারা, ফরসা ধবধবে ২৩ বছরের তরুণ। সদ্য পুলিশ ডিপার্টমেন্টের চাকরি ছেড়ে রুটিরুজির সন্ধানে নতুন একটা চাকরিতে জয়েন করেছেন তিনি। পুলিশের চাকরিতে মা-বোন তুলে ট্রেইনিংয়ের সময় কনস্টেবলদের গালাগাল মন ভেঙে দিয়েছিল তাঁর। উনি ঠিক করেছিলেন, এই চাকরি কোনোভাবেই করবেন না। এদিকে চারপাশে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দামামা।

বাড়িতে ফিরে এসে আর কখনো পুলিশের সেই চাকরিতে জয়েন করেননি। চাকরি নেন ঘোড়াশালের বিশাল এক জুট মিলে, অফিশিয়াল কাজ। প্রচুর ইংরেজি বই পড়েন অবসরে। সেই বইয়ের সন্ধানেই তিনি এসেছিলেন বইয়ের দোকানে। সেখানেই যখন জানলেন, শেখ আবদুল হাকিম সাহেব সেবা প্রকাশনীর, খেদ ঝাড়লেন মনের সুখে। ‘আপনারা কিন্তু আমার মতো বইপড়ুয়াদের সর্বনাশ করে দিচ্ছেন এই বিদেশি কাহিনি অবলম্বন করে বাংলায় বই লিখে।’

রীতিমতো অপ্রস্তুত হলেন শেখ আবদুল হাকিম সাহেব। বললেন, ‘আমরা আবার কী করলাম?’

‎‎‘সেবা প্রকাশনীর বই পড়ি আমি। কিন্তু যে ইংরেজি বই-ই পড়তে যাই, দেখি ওটা আমি আগেই পড়ে ফেলেছি,’ অভিযোগের সুরে বললেন তরুণ।

শেখ আবদুল হাকিম সাহেব তো এবার অবাক। ‎বলে কী এই তরুণ! ‎কত বই পড়ে সে?

‘কী বলেন, তা–ই নাকি? এত ইংরেজি বই পড়েন আপনি?’

‎এরপর শেখ আবদুল হাকিম সাহেব জানলেন যে শত শত ইংরেজি বই পড়ে ফেলেছে এই তরুণ। একদিন তিনি কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার দাওয়াত দিয়ে বসলেন তরুণ ছেলেটাকে। ‎রকিব হাসান সাহেব দ্বিধায় পড়ে গেলেন। কিছুটা ভয় নিয়ে ভাবলেন, এটা আবার কোনো ফাঁদ নয় তো! ‎আমি তো আবার এদের গালমন্দ করলাম।

‎সেদিন বিদায় নিলেন প্রখ্যাত লেখক শেখ আবদুল হাকিম আর হবু লেখক রকিব হাসান। কয়েক দিন পর মনে দ্বিধা নিয়ে সেগুনবাগিচা প্রেসে এলেন তিনি। টিনের বড় অফিস। পরে দেখেছেন ভেতরের দিকে চারকোনা একটা ঘরে কাটিং মেশিন। সামনে চওড়া এক দরজা পেরোলে আমেরিকান বহু পুরোনো একটি ট্রেডল মেশিন। বাঁয়ে কম্পোজ সেকশন।

যা–ই হোক, ম্যানেজারের সঙ্গে কথা হওয়ার পর রকিব সাহেবকে দেখিয়ে দেওয়া হলো ছোট্ট টিনের ঘরটা। ম্যানেজার নিজেই তাঁকে পৌঁছে দিলেন ওখানে। সত্যি সত্যি কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেবের সাক্ষাৎ পেয়ে ‎অবাক হলেন রকিব হাসান। টেবিলের এদিকে দুই চেয়ার, আর টেবিলের ওদিকে গম্ভীর চেহারায় বসে আছেন সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার।

কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব ও তাঁর দুই পুত্র সারা জীবন স্বীকার করে গেছেন যে সেদিন শেখ আবদুল হাকিম সাহেবের সঙ্গে যদি রকিব হাসান সাহেবের দেখা না হতো, আর রকিব হাসান সাহেব সেবা প্রকাশনীর জন্য এত বই বাছাই না করে দিতেন, তা হলে সেবা প্রকাশনীর অনুবাদের ভান্ডার এত সমৃদ্ধ হওয়া খুব কঠিন হয়ে উঠত।

একটু আগে বা পরে হাজির হয়ে গেছেন শেখ আবদুল হাকিম। তিনজনের আলাপ শুরু হলে কিছুক্ষণের ভেতর কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব বুঝে গেলেন—এই তরুণ যা বলেছে, তা আসলেই সত্যি। রাত-দিন বইয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে ছেলেটা।

কথায় কথায় তরুণ জানালেন যে তাঁর কাছে অনেক ইংরেজি বই আছে, যেগুলো দিয়ে সেবা প্রকাশনীর ‘মাসুদ রানা’ হতে পারে।

এভাবেই শুরু হলো সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে রকিব হাসান সাহেবের সম্পর্ক। উনি বই বাছাই করে দিতে শুরু করলেন ‘মাসুদ রানা’ ও অন্যান্য সিরিজের জন্য। তারপর একসময় নিজেই শুরু করলেন লেখালেখি।

প্রথম লেখা বই কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব দেখে দিয়ে বললেন, ‘আপনি যা লিখে এনেছেন, তা তো ইংরেজির আড়ষ্ট অনুবাদ। আপনি বরং আপনার নিজের ভাষায় বইটি লিখে আনুন।’

বই জমা দেওয়া শেষে মেরামত হওয়ার পর ওটা থেকে এল ১ হাজার ৭০০ টাকার বেশি, যা জুট মিলে রকিব সাহেবের বেতনের কয়েক গুণ বেশি। এতে নড়েচড়ে বসলেন তাঁর অফিসের কলিগরা। কেউ বললেন, ‘ভাই, এই চাকরি আপনার জন্য না...আপনি লেখালেখিতে মন দিন...ওখানেই আপনার হাত খুলবে।’

আবার সিনিয়র কলিগদের কেউ কেউ বললেন, ‘তুমি যা পেয়েছ, সেটা তো তোমার বেতনের চেয়ে অনেক বেশি। তুমি এখানে পড়ে আছ কেন?’

কিন্তু তাঁর মনে বারবার এল নানান ধরনের দ্বিধা। পরে যদি আর সেবা প্রকাশনীতে লিখতে না পারি? তবু সাতপাঁচ ভেবে অবশেষে চাকরি ছেড়ে দিলেন তিনি। আবুল কাশেম মোহাম্মদ আবদুর রকিব সাহেবের বুক নেম ‘রকিব হাসান’ দিয়েছিলেন বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী। শুরু করলেন রকিব হাসান নামে একের পর এক লেখা। শুধু নিজেই লিখলেন, তা–ই নয়...রাত-দিন বইয়ের নেশায় থাকতেন বলে রকিব হাসান সাহেব অন্য লেখকদেরও বাছাই করে দিতেন নানান ধরনের বই। সেই সময় সেবা প্রকাশনীর লেখকেরা সবাই যেন ছিলেন একটা বড় পরিবার। এভাবেই চলতে লাগল রকিব হাসান সাহেবের লেখালেখি। কখনো তাঁর লেখা বই মেরামত করেন কাজী আনোয়ার হোসেন আবার কখনো করেন স্বনামধন্য কবি সাযযাদ কাদির সাহেব।

আরও পড়ুন
রকিব হাসানের সঙ্গে লেখক,
ছবি: লেখকের ফেসবুক থেেক নেওয়া

একসময় তিনবারের চেষ্টায় রকিব হাসান সাহেবের হাত দিয়ে যে বইটি এল আর যে ভাষারীতি দাঁড়াল, সেটা দিয়েই উনি মুগ্ধ করে গেছেন সেবা প্রকাশনীর পাঠকদের সারা জীবন। ’৮৪ সালের দিকে রকিব হাসান সাহেবের হাতে এসেছিল ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটর’ সিরিজ। বইগুলো পড়ে উনি এলেন কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেবের সঙ্গে আলাপ করতে। ‘“মাসুদ রানা” তো বড়দের সিরিজ...বাচ্চাদের জন্য একটা সিরিজ করলে কেমন হয়?’

এবার সবাই মিলে চলল নতুন সেই সিরিজ নিয়ে আলোচনা। কিশোর, রবিন, মুসাসহ সব নাম ঠিক করা হলো। শুরু হলো ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের শুভসূচনা। ওদিকে সবাইকে বই বাছাই করে দেওয়ার কাজটা নিজের উদ্যোগেই করে গেলেন রকিব হাসান সাহেব।

কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব ও তাঁর দুই পুত্র সারা জীবন স্বীকার করে গেছেন যে সেদিন শেখ আবদুল হাকিম সাহেবের সঙ্গে যদি রকিব হাসান সাহেবের দেখা না হতো, আর রকিব হাসান সাহেব সেবা প্রকাশনীর জন্য এত বই বাছাই না করে দিতেন, তা হলে সেবা প্রকাশনীর অনুবাদের ভান্ডার এত সমৃদ্ধ হওয়া খুব কঠিন হয়ে উঠত। এখন ইন্টারনেটের যুগ, চাইলেই অনেক কিছু হাতের নাগালে পাওয়া যায়, কিন্তু সেই আমলে এমন একজন বইপড়ুয়া মানুষই যেন ছিল সেবা প্রকাশনীর জন্য আস্ত এক বিশাল গুগল। উনি ছিলেন সেবা প্রকাশনীর বড় একটা অংশ। কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেবের সঙ্গে ছিল তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক। কাজী মায়মুর হোসেন সাহেবের কাছেও শুনেছি, একসঙ্গে পাখি শিকারে যেতেন কাজী আনোয়ার হোসেন, রকিব হাসান, হুমায়ুন খান ও তিনি। শিকারে শীতকালে গেলে রকিব হাসান সাহেবের স্ত্রীর হাতের মোরগভুনা আর ছিটা রুটি ছিল সবার কাছে সত্যিকারের অমৃতের মতো কিছু। মায়মুর সাহেবের ভীষণ প্রিয় ছিল তাঁর স্ত্রীর হাতের রান্না। তাঁর স্ত্রী এটা জানতে পেরে নিজের হাতের মায়াভরা সেই রান্না মস্ত এক টিফিন ক্যারিয়ারে করে পাঠিয়েছিলেন মায়মুর সাহেবের জন্য। রকিব হাসান সাহেব সেই টিফিন ক্যারিয়ার নিজের হাতে অফিসে এনে বলেছিলেন, ‘লও, এইটা তোমার চাচি তোমার জন্যে পাঠাইছে।’

এত আন্তরিক সম্পর্ক, এই প্রতিভাকে ধ্বংস করার জন্য একসময় এসেছিল স্বার্থান্বেষী একদল মানুষ, যারা চেয়েছিল তাঁর এই প্রতিভাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে। প্রতিনিয়ত রকিব হাসান সাহেবকে ভুল বুঝিয়ে সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে সম্পর্কটা নষ্ট করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল তারা। শুরুতে রকিব হাসান সাহেব বুঝতে না পারলেও একসময় বুঝতে পারেন। কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেবের কাছে খুলে বলেন সব। কিন্তু পরিস্থিতি তখন এমনই ছিল যে উনি চাইলেও সেই নোংরা রাজনীতির খেলা থেকে আর এই জীবনে বের হতে পারেননি পুরোপুরি।

আরও পড়ুন

আসলে সব তো প্রকাশ্যে খুলে বলা যায় না। কিন্তু উনি অসুস্থ হলে আমি যখন তাঁর জন্য আর্থিক সহযোগিতার পোস্ট দিই, তখন অনেকেই আমার কাছে জানতে চান যে তাঁর সারা জীবনের লেখালেখির আয় আসলে কোথায় গেল। আর্থিক অবস্থা এমনটা হলো কেন। আমি তাঁদের বলতে পারিনি যে যারা তাঁকে নিয়ে নোংরা খেলা খেলেছিল, তারাই আসলে দায়ী এই অবস্থার জন্য। সব বলা যায় না, কিন্তু কিছু তো একটা ছিলই। আমি আমার জায়গা থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তাঁর পাশে থাকার জন্য। কতটুকু করতে পেরেছি জানি না, কিন্তু চেষ্টার কমতি ছিল না আমার। কমতি ছিল না আমার প্রতি তাঁর সন্তুষ্টিরও। চলে যাওয়ার আগে আমার মাথায় হাত রেখে উনি দোয়া করে গেছেন।

সেটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট পাওয়া।

চোখের সামনে সেই চেহারাটা আমার এখনো ভাসে, সেই সরল হাসি, ‘আমারে এক্কেরে চমকায়া দিছো, বউমা... আমি তো ফিরা গেলাম সেই ’৭৭ সালে...’

পরপারে উনি ভালো থাকুন সেই কামনা করি অন্তর থেকে। একটা সমুদ্র হতে চাওয়া মানুষকে যারা আটকে দিয়েছিল নিজেদের স্বার্থের বাঁধে, এলোমেলো করে দিয়েছিল ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে লেখালেখির জগৎ, আটকে দিয়েছিল তাঁর বিকাশের প্রশস্ত পথ, সে রকম কোনো স্বার্থান্বেষী মহল তাঁকে আর স্পর্শ করবে না কখনোই।

মাসুমা মায়মুর

উপদেষ্টা, সেবা প্রকাশনী

আরও পড়ুন