সেসব অন্ধকার কি আজও আছে, যেখানে তেনাদের আনাগোনা অমলিন?

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বড্ড আলো চারপাশে। তাই তেনাদের তেমন সুবিধা হয় না ইদানীং। নিয়ন, সোডিয়াম অথবা এলইডি—সব রকম আলোই তেনাদের জন্য তেমন সুখকর নয়। তবে হারিকেন বা ল্যাম্ফো বা কুপির আলো চলতে পারে। কারণ, তেনারা যখন আবির্ভূত হবেন, তা দপ দপ করে নিভে যাবে। ঘরের ভেতরে বা বাঁশবনে অথবা রাত শনশন ফাঁকা মাঠে ছড়িয়ে থাকবে ক্ষীণ চাঁদের ফ্যাকাশে আলো। সেটুকু না থাকলে তেনাদের খেলা ভালো জমে না। কিন্তু এই রোশনাইয়ের যুগে সে আলোর দেখাই-বা মেলে কোথায়! তাই তেনাদের বেছে নিতে হয় ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাটবাড়ির নির্জন সিঁড়ি, অব্যবহৃত চিলোকোঠার আঁধারি অথবা বাথরুমের স্যাঁতসেঁতে নিরালা। এই তো, কদিন আগেও খাটের তলা ছিল তেনাদের প্রিয় জায়গা। বক্স খাটের আগমনের পরে সে জায়গাও গেছে। ফলে ভূতেদের ভবিষ্যৎ যে খুব জমকালো, সে কথা বলা যায় না।

অথচ আজ থেকে ৫০ বছর আগেও তেমনটা ছিল না। অলিগলিতে অন্ধকার ছিল, বেদম লোডশেডিং ছিল, পাড়ায় পাড়ায় মজা পুকুর আর তাকে ঘিরে ঝোপঝাড় মন্দ ছিল না। ফলে জোনাকি জ্বলা ঝুঝকো সন্ধ্যায় হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসে মাঝে মাঝে এটা-সেটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠতে হতো। অনেকেই বলতেন, সে আওয়াজের সবটুকু ‘প্রাকৃতিক’ নয়। রাতে ঘুম না এলে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গল্পে পড়া আলিনগরের কবর ফুঁড়ে জেগে ওঠা মড়াদের লটপট করে চলাফেরার শব্দের কথা মনে পড়ে বাথরুম যাওয়া মাথায় উঠত। কোনো রাতে আবার শন শন হাওয়ায় দুলতে থাকা দূরের তালগাছের মাথায় বহু ছোটবেলায় শোনা একানড়ের কথা মনে পড়ে যেত, কৈশোরেও কেমন যেন গা ছমছম করে উঠত।

আরও পড়ুন

কিন্তু সেদিন আর নেই। শহরে, মফস্‌সলে ঝাঁ–চকচকে শোরুম আর শপিং মলের দাপটে ভৌতিকতা উধাও। গ্রামেও কি আর তেমন আবডাল আছে? মুঠোফোনে কান লাগিয়ে ভূতের গল্পের পডকাস্ট শোনার অবকাশ থাকলেও জবরদস্ত ভয় পাওয়ার মতো পরিবেশ সম্ভবত আর নেই। অথচ এই সময়ে নাকি ভূতের গল্পের বিরাট চাহিদা। সে চাহিদার মূলে রয়েছে পডকাস্ট-ওয়ালাদের নিত্যনতুন কনটেন্ট জোগাড়ের চাপ। ভৌতিক সাহিত্যের পেছনে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে গজেন্দ্রকুমার মিত্র বা সাম্প্রতিক অতীতের হুমায়ূন আহমেদ বা এ সময়ের মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বা মুহম্মদ আলমগীর তৈমুরের মতো হাতে গোনা কয়েকজনের যে যত্নের ছাপ ছিল, তা অনেক দিনই উধাও।

অথচ বিশ্বব্যাপী হরর গল্পের ছবিটা এক্কেবারেই আলাদা। এডগার অ্যালান পো (সে অর্থে ‘ভূতের গল্প’ না লিখলেও) থেকে অ্যাম্ব্রোজ বিয়ার্স, অ্যালগারনন ব্ল্যাকউড থেকে স্টিফেন কিং হয়ে হাল আমলের জো হিল পর্যন্ত ভৌতিক সাহিত্যে যত্ন আর উদ্ভাবনী চিন্তার স্রোতকে বজায় রেখেছেন। পশ্চিমের ভৌতিক সাহিত্যের এই ঐতিহ্যগত প্রবাহটা সত্যিই অবাক করার মতো। মৌখিক গল্পগাছা বা রূপকথার কাহিনিতে ছড়িয়ে থাকা ভূতপ্রেত বা অতিপ্রাকৃত সত্তাদের গায়ে লেগে থাকা মশকরার ছালটি ছাড়িয়ে উনিশ শতকেই তৈরি হয় নিখাদ হরর সাহিত্য। ব্রিটিশ লেখক শেরিডান লা ফানু থেকে ব্রাম স্টোকার পর্যন্ত বিস্তৃত ভয়ের জগৎ যদি এই প্রারম্ভের একটি দিক হয়ে থাকে, তবে মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধের ওস্তাদ হাওয়ার্ড ফিলিপ লাভক্র্যাফট পর্যন্ত তার অন্য দিক। আবার বলা প্রয়োজন, পো কিংবা লাভক্র্যাফট সে অর্থে ‘ভৌতিক’ সাহিত্যের লেখক ছিলেন না। কিন্তু প্রথমজনের লেখায় উঠে এসেছিল মানুষের মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার আর দ্বিতীয় জন লিখতে সমর্থ হয়েছিলেন, সেই ভয়ের জগৎকে, যা আমাদের যাবতীয় কল্পনার বাইরে। লাভক্র্যাফট তাঁর নিজের রচনাকে বলেছিলেন ‘সুপারন্যাচারাল হরর’। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশ্বসাহিত্যে একটা বিশেষ ধারাই চিহ্নিত হয় ‘লাভক্র্যাফটিয়ান’ হিসেবে। সেই ধারায় যে সবাই ভয়ের গল্প লিখেছেন, তা নয়। কিন্তু তা আদতে জন্ম দেয় এমন এক যুক্তির জগতের, যা সে অর্থে ‘স্বাভাবিক’ বা আমাদের চেনা যুক্তির জগৎ নয়।

ভূতের গল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তার যে যুক্তির জগৎ তা আমাদের চেনা জগৎটিকে এসে ঘেঁটে দিয়ে যাচ্ছে। এই ঘেঁটে দেওয়ার কারণেই কি আমরা ভয় পাই? অতি যত্নে তিলে তিলে গড়ে তোলা যুক্তিকাঠামোটিকে গুবলেট করে দিতে পারে একমাত্র ভূতেরাই। কারণ, তারা ‘ইহলোক’-এর সীমানা পেরিয়ে গেছে। হুমায়ূন আহমেদের একাধিক রচনায় কবর থেকে উঠে আসা মানুষের কথা রয়েছে। কবরের নিশ্ছিদ্র আঁধারের দুনিয়া থেকে ফেরত আসা মানুষ কি আর ‘মানুষ’ থাকে? সে বোধ হয় মানবিক যুক্তির জগতের ধাপ থেকে অনেকটাই সরে যায়। আর সেই অজানাকেই আমরা ভয় পাই। লাভক্র্যাফট তাঁর ‘সুপারন্যাচারাল হরর ইন লিটারেচার’ প্রবন্ধের গোড়াতেই লিখেছিলেন, “মানবজগতের সব থেকে বড় ভয়টিই হলো অজানাকে ভয় পাওয়া।” আমাদের বাংলাতেও মনোবিদ্যার প্রথম পুরুষ গিরীন্দ্রশেখর বসু তাঁর ফ্যান্টাসি গ্রন্থ লাল কালো-তে লিখেছিলেন—“ওই বুঝি করে হাঁ নাহি যার নাম”। সেই নাম না–জানা বস্তুটিই ‘ভয়’। আসলে ‘ইহ’ লোক থেকে বেরিয়ে গেলে যে জগৎ, আমরা তাকে চিনি না, তাই তাকে ঘিরে ঘনিয়ে ওঠে ভয়। অজানাকে অভয়। অজ্ঞাতকে ভয়।

তবে ইহলোক থেকে বেরিয়ে যাওয়া লোকজন, মানে ভূতেরা যে সর্বদা ভয়ের বস্তু হয়ে থাকে, তা নয়। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় থেকে লীলা মজুমদার হয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত ভৌতিক জগতে ভূতেরা বেশ ফুরফুরে, মোলায়েম। ত্রৈলোক্যনাথের ‘লুল্লু’ যত বদমায়েশই হোক না কেন, সে ভয় দেখায় না। তেমনই লীলা মজুমদারের কলম থেকে বেরোনো ভূত কমজোরিকে অঙ্ক শেখায়, বিচ্ছু বন্ধুদের শায়েস্তা করে। ওদিকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ নিধিরাম তো অঙ্কে তেরো পাওয়া বুরুনকে যাবতীয় কাজেই সাহায্য করে। সেদিক থেকে দেখলে বাংলা ভৌতিক সাহিত্যে উপকারী, ভালো মানুষ ভূতেদের আনাগোনা কম নয়। পশ্চিমের হাড় হিম করা ভূতেদের চেয়ে তারা ঢের বেশি বন্ধুবৎসল, ঢের বেশি আপনজন। যদি হুমায়ূন আহমেদের ‘গোবর বাবু’ গল্পের গোবরকেই দেখা যায় তো টের পাওয়া যাবে, সে ভূতসমাজের রত্নবিশেষ। এসব কাহিনির উৎসে পৌঁছাতে গেলে আমাদের প্রাক্-ব্রিটিশ পর্বের দেশীয় মৌখিক সাহিত্যের খোঁজ করতে হবে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘কুঁজো আর ভূত’ বা সবচেয়ে বেশি পঠিত ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর ভূতেদের শিকড় ছড়ানো ছিল দেশীয় মৌখিক সাহিত্যেই। গ্রামাঞ্চলে ‘ভূত’ ব্যাপারটা যে প্রাক্-ব্রিটিশ পর্বে সর্বদা ভয়ের ব্যাপার ছিল না, বরং তার মধ্যে মিশে ছিল দুর্বল বা দরিদ্র মানুষের ইচ্ছেপূরণের কাহিনিও, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

আরও পড়ুন

কিন্তু উপনিবেশের সূত্র ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে খানিক কড়া ধাঁচের ভূত। তারা উপকারী তো নয়ই, বরং তারা একান্ত অচেনা কিছু সত্তা। গ্রামবাংলায় যেখানে গ্রামে একজন বামুন, একজন জোলা, একজন চোরের পাশাপাশি বেলগাছে একজন ব্রহ্মদৈত্য বা শেওড়াগাছে একজন পেত্নীর মিলেমিশে থাকাটা ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপার ছিল, সাহেবদের ভৌতিক ধারণায় মোটেই তেমনটা ছিল না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যে সময়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এই উপমহাদেশে, তখন ব্রিটেনের ভৌতিক সাহিত্যে উইল্কি কলিন্স, আর্থার কোনান ডয়েলের যুগ। সমসময়ে না হলেও তার কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়ে বের হবে ক্ষুধিত পাষাণ, মণিহারা, নিশীথে-র মতো গল্প, যাকে আক্ষরিক অর্থে ‘ভৌতিক’ না বললেও অজানা ভয়ের গোত্রে তো ফেলাই যায়! ঠিক তার পরবর্তী সময়ে জমজমাট ভৌতিকতা নিয়ে হাজির ছিলেন বিভূতিভূষণ, প্রমথনাথ বিশী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের প্রত্যেকের গল্পেই হালকা অথবা ভারী রকমের ছায়া রয়েছে ডয়েল কিংবা কলিন্সের মতো সাহিত্যিকের। বিভূতিভূষণই সম্ভবত প্রথম সাহিত্যিক, যিনি আমাদের দেশজ শিকড়ের মধ্যে আকাঁড়া ভয়ের সন্ধান করেন। তাঁর লেখা তারানাথ তান্ত্রিকের দুটি গল্প তার প্রমাণ। আবার সমান্তরালে ‘পেয়ালা’র মতো গল্পে ভূত প্রত্যক্ষভাবে না এলেও ভয় এসেছে অজানার সূত্র ধরে। বিভূতিভূষণ পড়তে বসে কেউ যদি লাভক্র্যাফটের অতিজাগতিক হররের কথা মনে করে বসেন, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই যে বিভূতিভূষণ লাভক্র্যাফটের সমসাময়িক হলেও তাঁর রচনা পড়েননি। সস্তার ম্যাগাজিনে গল্প লিখে কায়ক্লেশে টিকে থাকা লাভক্র্যাফটকে কুলীন সাহিত্যিকের মর্যাদা পেতে আরও অর্ধশতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

আজকের বাংলা সাহিত্যে যে ভৌতিকতার বা হররের রমরমা, তার চেহারা-ছবি যে খুব সুবিধার, তা বলা যায় না। সত্যজিৎ রায়ের পর বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো হাতে গোনা সাহিত্যিক ছাড়া ভৌতিক সাহিত্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কাউকে দেখা যায় কি? অথচ এপার আর ওপার—দুই বাংলাতেই হরর সাহিত্য প্রায় একটা ইন্ডাস্ট্রির চেহারা নিয়েছে। সেই ইন্ডাস্ট্রি থেকে সবই যে খারাপ লেখা বার হচ্ছে, তা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ লেখার মধ্যেই কেমন যেন যত্ন, পারম্পর্য ইত্যাদির অভাব রয়ে যাচ্ছে। মিসির আলির মতো প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর ধাঁচের চরিত্র বাংলা সাহিত্য আগে দেখেনি। তাঁর সমান্তরালে সত্যজিতের তারিণীখুড়োকে রাখা যেতে পারে বড়জোর। কিন্তু তারিণীখুড়ো সাধ করে ভৌতিকতায় জড়িয়ে পড়ার মানুষ নন, যেখানে মিসির আলি তাঁর বিটকেল কৌতূহলের কারণে (বা অকারণে) একের পর এক অতিপ্রাকৃত গোলমালে জড়িয়ে পড়েন। তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারানাথ তান্ত্রিকও খানিকটা তা–ই। কিন্তু তান্ত্রিকদের জগতে গা–ছমছমে সব আবছায়ার অস্তিত্ব তো অনিবার্য। বিভূতিভূষণের তারানাথ আর তারাদাসের তারানাথ আবার এক চরিত্র হলেও তাঁদের রকমসকম আলাদা। কিন্তু তাঁরা কেউই মিসির আলি নন। বাংলায় ‘তান্ত্রিক হরর’-এর বন্যা বয়ে গেলেও সেসব কাহিনি দেশজ শিকড়কে হয় ভালো করে জানে না, নয়তো তন্ত্র আর হররকে মেশাতে গিয়ে ঘরেও নয়-পাড়েও নয় গোছের কিছু একটা হয়ে থমকে থাকে। বাংলাদেশে আবার বিশ্বসাহিত্যের নামজাদা ভৌতিক কাহিনির বঙ্গীকরণ নিয়মিত হয়ে চলেছে। অনুবাদের চেয়ে তার রস আলাদা। কিন্তু খাঁটি দেশজ শিকড়ের যে সন্ধান সিনেমা পরিচালক নুহাশ হুমায়ূন তাঁর ওয়েব সিরিজ পেট কাটা ষ বা ২ষ-এ করেছেন, তার ছায়া সাহিত্যে পড়ছে কি? বাংলাদেশ বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের হরর ছবি একটা ভিন্নমাত্রা পেলেও সাহিত্য তা থেকে সমৃদ্ধ হচ্ছে না বললে বোধ হয় খুব ভুল বলা হবে না।

আরও পড়ুন

তবে সাহিত্য নিয়ে অতখানি হতাশ হওয়ার কারণও এখন পর্যন্ত ঘটেনি। পশ্চিমবঙ্গে সৈকত মুখোপাধ্যায় অতিপ্রাকৃত গল্প লিখছেন বেশ জমিয়েই। রাজর্ষি গুপ্ত কিছুদিন আগে অনুবাদ করেছেন এম আর জেমসের গল্প। শুধু তা-ই নয়, তার সঙ্গে লিখেছেন পাতা পঞ্চাশেকের এক দীর্ঘ ভূমিকা। জেমসের রচনাকে আলোচকেরা ‘প্রত্নতাত্ত্বিক হরর’ বলে চিহ্নিত করেন। তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্পেই থাকে কোনো না কোনো পুরাবস্তুকে ঘিরে থাকা অপ্রাকৃত রহস্যের জাল। বাংলাদেশে এ ধরনের কাহিনি লেখেন মুহাম্মদ আলমগীর তৈমুর। তাঁর নভেলা ‘হাকিনী’ দুই বাংলাতেই সাড়া ফেলেছে। এই কাহিনির তন্তুতে মিশে আছে তন্ত্রের বীজও। সেভাবে দেখলে এমন একটা সম্ভাবনা চোখে পড়ে যে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো জেমস বা ব্ল্যাকউড বা লাভক্র্যাফটের সূত্র ধরেই এখানে খোঁজ পড়তে পারে বাংলার সংস্কৃতির শিকড়ে নিহিত হরর উপাদানগুলোর। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে অধুনা প্রয়াত মারাঠি সাহিত্যিক রত্নাকর মটকরির গল্পকে। রত্নাকর সে অর্থে ‘বিদেশি’ সূত্র অনুসরণ না করেই লিখে গেছেন একের পরে এক ভৌতিক কাহিনি। সম্প্রতি সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ ডার্কনেস নামে প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ করার ব্যাপার এই যে এসব গল্পে তান্ত্রিক বা পৈশাচিক অথবা ইবলিশি মারপ্যাঁচ একেবারেই ব্যবহৃত হয়নি। মানুষের দৈনন্দিনের যাপনের ভাঁজেই ঢুকে থাকা ভয়ের সুতাগুলোকে টেনে এনে রত্নাকর লিখেছিলেন আশ্চর্য সব ভৌতিক কাহিনি। তাঁর সঙ্গে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার সাযুজ্য লক্ষণীয়। সেই সূত্রগুলোকে কি আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা কি কেউ করছেন না?

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম অবশ্যই করা প্রয়োজন। তন্দ্রা আবার সম্পর্কে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনি। তবে তাঁর লেখায় দাদুর ছাপ নেই। তন্দ্রা বরং এমন এক অপ্রাকৃত জগৎকে তাঁর গল্পে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে আনেন, যা আমাদের চেনা ভৌতিক পরিমণ্ডল নয়। সেখানে ভয় আসে এক্কেবারে অজানিতের হাত ধরে। এই জগৎটি তাঁর বিভিন্ন গল্পে ঘুরেফিরেই আসে। একটি গল্পের চেয়ে অন্য গল্পটি হয়তো একচুল আলাদা। এভাবেই গল্প থেকে গল্পান্তরে হেঁটে যায় আখ্যান। পাঠকের তাতে একবিন্দুও যাকে বলে ‘বোর’ লাগে না, এমনই সেই গল্পমালার টান। এই গল্পমালার বাইরেও তন্দ্রা ভূতের গল্প লেখেন, তা কখনো কৌতুকের, কখনোবা মন খারাপ করে দেওয়া মায়াবী। সেখানে কখনো কখনো তিনি লীলা মজুমদারের উত্তরসূরি। ভারি পেলব সেসব কাহিনি। মন কেমন করে সেসব পড়ার পর।

আরও পড়ুন

একসময়ে বাংলার নামী লেখকেরা প্রায় সক্কলেই ভূতের গল্প লিখেছেন। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তোয়াক্কা না রেখেই লিখে গেছেন অতিপ্রাকৃত কাহিনি। সেই তালিকায় বুদ্ধদেব বসু থেকে, মনোজ বসু বা গজেন্দ্রকুমার মিত্র—কে নেই? আরও একটা আশ্চর্য বিষয়, এসব ভৌতিক কাহিনিকে তাঁরা আলাদা করে গ্রন্থভুক্ত করেননি। আর পাঁচটা সামাজিক গল্পের সঙ্গেই সংকলনে রেখেছেন। প্রশ্ন জাগে, বিভূতিভূষণ বা প্রমথ চৌধুরী কি ভৌতিক পরিমণ্ডলকেও সামাজিকতার মধ্যেই দেখতেন? মনে করতেন, বিদেহী আত্মারাও আমাদের সমাজ-পরিবারেরই একটু দূরে সরে থাকা সত্তামাত্র? একসময় বাংলার মৌখিক গল্পগাছায় ব্রহ্মদৈত্য বা মেছোপেতনি গ্রামসমাজেরই অংশ ছিল। ভূতে-মানুষে একটা সহাবস্থানে থাকার মতো বোঝাপড়াও ছিল। মনে হয় সেই বোঝাপড়াটা তৈরি করে দিত আমাদের শিকড়, তাতে লেগে থাকা অন্ধকার। আজ সেসব গল্প পড়তে বসে মনে হয়, এই অন্ধকারটা একটা লম্বা ব্যাপার। যা আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষদের সামাজিকতা আর তার সীমানা পার করে দিশাহীন এক ঘুমঘুমির মাঠের মধ্য দিয়ে নিরুদ্দেশে চলে গেছে। সেই মাঠের বেলগাছে বসত করে ব্রহ্মদৈত্য, জলায় দপ করে জ্বলে ওঠে আলেয়া, শেওড়াগাছে শাঁকচুন্নি থাকেই আর সেই মাঠেরই মাঝখানে পোড়ো বাড়িতে বাস করে মিসেস কুমুদিনী চৌধুরীর মতো রক্তচোষা, তারই এক প্রান্তের শ্মশানে শবসাধনা করতে গিয়ে বিভীষিকা দেখেন তারানাথ তান্ত্রিক। এরা সবাই আমাদের আপনজন। খালি মনের ভিতরকার আলোগুলোকে একটু কমিয়ে পড়তে বসলেই এরা ধরা দিতে পারে যখন-তখন। সেই অন্ধকারটাকে কেউ না কেউ বুকের মধ্যে লালন করে চলেছেনই। আর তাই কখনো কখনো নিশুতি রাতে ঘোর বাদলার দিনে বিদ্যুতের চমকানির মতো মনে পড়ে, ভূতেদেরও ভবিষ্যৎ আছে। নইলে ধুস্! এই বাঙালি বাঙালি খেলা থেকে আব্বুলিশ বলে পালিয়ে যাব।

আরও পড়ুন