মানুষের তুলনায় দ্বিগুণ খাবার উৎপাদিত হয় পৃথিবীতে, তবু কেন খাবারের অভাব
প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে উৎপাদিত হয় প্রায় দ্বিগুণ খাবার। সব মানুষের যত খাবার প্রয়োজন, তার চেয়ে দ্বিগুণ খাবার উৎপাদিত হয়। আমাদের চাষিদের ধন্যবাদ দিতেই হবে। ২০২০ সালে পৃথিবীতে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হয়েছিল, তা দিয়ে কতজন মানুষকে খাওয়ানো যেত? উত্তরটা হলো ১ হাজার ৫০০ কোটি। বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যা মাত্র ৮০০ কোটি। কিন্তু ২০২০ সালের খাদ্য দিয়েই তো প্রায় দ্বিগুণ মানুষকে খাওয়ানো যেত। তবু কেন নানা দেশে খাদ্যাভাব দেখা যায়? প্রতিবছরই তো আমরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার উৎপাদন করি!
আসলে রহস্যটা অন্য জায়গায়। এই বিশাল পরিমাণ খাবারের মাত্র অর্ধেক গেছে মানুষের পেটে। হয়তো এখনই জিজ্ঞেস করবে, তাহলে বাকিটা কোথায় গেল?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। তিনি এবং তাঁর দল গবেষণা করে এই রহস্যের সমাধান করেছেন। তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল ওয়েস্ট। এ রহস্যের সমাধানের জন্য তাঁরা একটি অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তাঁরা খাবারের পরিমাণ ওজনে নয়, বরং ক্যালরিতে করেন। কারণ, ক্যালরিই হচ্ছে খাবারের আসল শক্তি। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য এই ক্যালরিই প্রয়োজন!
হিসাব বলছে, ২০২০ সালে মোট উৎপাদিত ক্যালরির ৪৫ শতাংশ হারিয়ে গেছে প্রাণীর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায়। পাশাপাশি জৈব জ্বালানি বায়োডিজেল আর ইথানল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে আরও ৫ শতাংশ।
যাহোক, শুরুতে বিজ্ঞানী পলের দলটি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য ঘাঁটা শুরু করলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৫০টি ফসলের তথ্য নিলেন। এই ৫০টি ফসল থেকেই পৃথিবীর মোট ক্যালরি উৎপাদনের ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ আসে। এর মধ্যে আছে ভুট্টা, সূর্যমুখীর তেল, কোকো, কলা, টমেটোসহ আরও অনেক কিছু।
গবেষণায় একটি চোখে পড়ার মতো ব্যাপার বেরিয়ে এল। ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে মোট ক্যালরি উৎপাদন বেড়েছে ২৪ শতাংশ। কিন্তু মানুষের খাওয়ার মতো ক্যালরির পরিমাণ বেড়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ। তাহলে বাকিটা গেল কোথায়?
এখানে একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। সেটা লুকিয়ে আছে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে। গরুর মাংসের প্রতি আমাদের অতিরিক্ত আকর্ষণই এই সমস্যার মূল কারণ। একটু বুঝিয়ে বলছি। একটি গরু থেকে এক কেজি মাংস পেতে হলে কতটুকু খাবার খাওয়াতে হবে? প্রশ্নটা হয়তো একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, সহজ করে দিই। একটা গরুর থেকে এক কেজি মাংস পাওয়ার জন্য যতটা খাবার দিতে হবে, মুরগি থেকে এক কেজি মাংস পাওয়ার জন্য কী তার থেকে কম খাবার খাওয়াতে হবে, নাকি বেশি? এবার হয়তো তুমি সহজেই বলে দেবে, মুরগিকে কম খাওয়াতে হবে। আসলেই তা–ই।
হিসাব বলছে, ২০২০ সালে মোট উৎপাদিত ক্যালরির ৪৫ শতাংশ হারিয়ে গেছে প্রাণীর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায়। পাশাপাশি জৈব জ্বালানি বায়োডিজেল আর ইথানল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে আরও ৫ শতাংশ। বিশেষ করে পাম তেলের ব্যবহার বেড়েছে আগের চেয়ে ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ যে ক্যালরি মানুষের পেটে যেতে পারত, তা শেষ পর্যন্ত গেছে গাড়ির ট্যাংকে। সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ খাবার গেছে প্রাণীর খাদ্য ও এসব জৈব জ্বালানিতে। শুরুতে যে বলেছিলাম, খাবারের বাকি অর্ধেক কোথায় গেল? এই সেই বাকি অর্ধেকের হিসাব!
তবে সবকিছু ক্যালরি দিয়ে মাপা যায় না। শরীরের জন্য দরকার প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজসহ আরও অনেক কিছু। তবে এই গবেষণার মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার, পৃথিবীতে খাদ্যের কমতি নেই।
তবে এই হিসাবে এখনো খাবারের অপচয় ধরা হয়নি। অথচ অপচয়ের হিসাব ধরলে ক্ষতির অঙ্কটা আরও বেড়ে যাবে। আর সব অপচয় তো আর সমান নয়। বিশেষ করে গরুর মাংসের মতো খাবার নষ্ট হলে ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়। কারণ, এটা উৎপাদনে ক্যালরি খরচ হয় সবচেয়ে বেশি।
তবে এ গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটা আশাব্যঞ্জক। যুক্তরাষ্ট্রের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হানা রিচি বলেছেন, ‘আমাদের সমস্যাটা আসলে খাবার উৎপাদনে নয়, বরং খাবার যেভাবে বণ্টন করি, তাতে।’
তাহলে সমাধান কী? সমাধান খুব সহজ। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। ক্যালরি সাশ্রয় হয় এমন খাবার খেতে হবে। খেতে হবে সবজি ও উদ্ভিজ্জ প্রোটিন। কমাতে হবে জৈব জ্বালানির ব্যবহার।
তবে সবকিছু ক্যালরি দিয়ে মাপা যায় না। শরীরের জন্য দরকার প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজসহ আরও অনেক কিছু। তবে এই গবেষণার মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার, পৃথিবীতে খাদ্যের কমতি নেই। সমস্যা হলো আমাদের পছন্দ ও সিদ্ধান্তে। প্রতিদিনের খাবারের প্লেটে আমরা কী খাই, সেটাই নির্ধারণ করছে পুরো পৃথিবীর খাদ্যনিরাপত্তার ভবিষ্যৎ!