প্রেসিডেন্ট হয়েও থাকতেন টিনের ঘরে, কেমন ছিল হোসে মুহিকার জীবন

হোসে মুহিকা

উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা ছিলেন বিশ্বের ‘সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। নাগরিকেরা তাঁকে মনে রেখেছেন তাঁর প্রগতিশীল ও সংস্কারমূলক কাজের জন্য। শুধু দক্ষিণ আমেরিকায় নয়, বিশ্বজুড়েই তিনি প্রশংসিত ছিলেন। আজ ১৪ মে ২০২৫, তিনি ৮৯ বছর বয়সে মারা গেছেন।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে মুহিকা ছিলেন একজন গেরিলা যোদ্ধা। ‘পেপে’ নামে পরিচিত এই নেতা স্পষ্টবাদী ছিলেন এবং সোজাসাপ্টা কথা বলতে ভালোবাসতেন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি উরুগুয়ের বামপন্থী সরকারের নেতৃত্ব দেন। যদিও তাঁর অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেকের মনে দ্বিধা ছিল, কিন্তু তিনি ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হন যে তাঁর বিদ্রোহী অধ্যায় শেষ হয়েছে।

সাবেক টুইটার, বর্তমানে এক্স-এ উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওরসি লিখেছেন, ‘গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের সহযোদ্ধা পেপে মুহিকা মারা গেছেন।’ ব্রাজিল, চিলি ও মেক্সিকোর বামপন্থী রাষ্ট্রপ্রধানসহ আঞ্চলিক নেতারা তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর জীবনকে অনুকরণীয় বলে উল্লেখ করেছেন।

রাষ্ট্রপতি থাকাকালে মুহিকা প্রেসিডেন্ট ভবনে না থেকে মন্টেভিডিও শহরতলির নিজ ছোট্ট ফুলের খামারবাড়িতে থাকতেন। তিনি কখনোই স্যুট বা টাই পরতেন না। প্রায়ই তাঁকে তাঁর বিটল গাড়ি চালাতে দেখা যেত এবং শহরের সাধারণ রেস্তোরাঁয় অফিস কর্মীদের সঙ্গে খেতে দেখা যেত।

২০২৪ সালের মে মাসে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তাঁর পুরনো বিটল গাড়িটি এখনো ‘চমৎকার অবস্থায়’ রয়েছে। তবে তিনি যোগ করেন, ট্রাক্টর চালানো তাঁর কাছে আরও ‘মজার’, কারণ সেখানে ‘চিন্তা করার সময় পাওয়া যায়।’

৭৪ বছর বয়সে মুহিকা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন, যদিও অনেক ভোটার তাঁর বয়স ও অতীত নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে তিনি ছিলেন তুপামারোস বিদ্রোহী গোষ্ঠীর একজন নেতা।

লুসিয়া তোপোলানস্কি ছিলেন মুহিকার দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী, যাঁদের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল তুপামারোস যোদ্ধা থাকার সময়েই। তাঁরা ২০০৫ সালে বিয়ে করেন। তোপোলানস্কি ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ক্ষমতা ছাড়ার পরও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাঁরা নিয়মিত লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন।

পরে তাঁরা ফুল চাষ বন্ধ করে দিলেও নিজেদের ছোট খামারে সবজি চাষ চালিয়ে যান। তাঁদের উৎপাদিত টমেটো লুসিয়া প্রতি মৌসুমে আচার বানিয়ে সংরক্ষণ করতেন।

হোসে মুহিকার জন্ম সনদে তাঁর জন্ম সাল ১৯৩৫ লেখা থাকলেও তিনি দাবি করতেন, তাঁর প্রকৃত জন্ম সাল ১৯৩৪। মাত্র ৯ বা ১০ বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। ছোটবেলায় মাকে সাহায্য করতে তিনি ফুল চাষ, মুরগি ও গরু পালনের কাজ করতেন।

রাজনীতিতে তিনি যোগ দেন এমন এক সময়ে, যখন উরুগুয়ের বামপন্থীরা দুর্বল ও বিভক্ত ছিল। প্রথমদিকে তিনি ডানপন্থী ন্যাশনাল পার্টির একটি প্রগতিশীল অংশে যুক্ত ছিলেন। পরে ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি মার্ক্সবাদী তুপামারোস গেরিলা আন্দোলনে যোগ দেন। এই সংগঠন ছিনতাই, রাজনৈতিক অপহরণ ও বোমা হামলার মতো কার্যকলাপের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করত। মুহিকা দাবি করেন, তিনি কখনো কাউকে হত্যা করেননি, তবে পুলিশের সঙ্গে অনেক সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন এবং একবার ছয়টি গুলি লেগেছিল তাঁর।

১৯৭৩ সালে উরুগুয়ে সামরিক শাসনের আওতায় আসে এবং তুপামারোদের দমন করে। শুরু হয় ১২ বছরের স্বৈরশাসন, যেখানে প্রায় ২০০ জনকে অপহরণ ও হত্যা করা হয় এবং হাজার হাজার মানুষকে জেলে পাঠিয়ে নির্যাতন করা হয়।

মুহিকা প্রায় ১৫ বছর কারাবন্দি ছিলেন। এর বড় একটি সময় তিনি একাকী একটি পুরনো আস্তাবলে কাটিয়েছেন। সেখানে তাঁর সঙ্গী ছিল কেবল পিঁপড়া। তিনি দুইবার জেল থেকে পালাতে সক্ষম হন, একবার মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে। শেষ জীবনে তিনি বলতেন, তাঁর সবচেয়ে বড় ‘অভ্যাস’ ছিল নিজে নিজে কথা বলা—এটা ছিল কারাবন্দি অবস্থার নিঃসঙ্গতার প্রতিফলন।

১৯৮৫ সালে যখন উরুগুয়ে আবার গণতান্ত্রিক পথে ফিরে আসে, মুহিকা মুক্তি পান এবং রাজনীতিতে ফিরে আসেন। তিনি ধীরে ধীরে বামপন্থীদের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। তিনি একাধারে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ও পরে প্রেসিডেন্ট। তবে তিনি বিরোধীদের সঙ্গেও সংলাপ চালিয়ে যেতেন, এমনকি তাঁদের নিজের বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী বারবিকিউয়ের আমন্ত্রণ জানাতেন।

শেষ বয়সেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত আশাবাদী। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি তরুণ প্রজন্মকে বলতেন, ‘জীবন সুন্দর’।