মানুষ কেন তেলাপোকা, সাপ, টিকটিকি, মাকড়সা ভয় পায়?
মহাবীর নেপোলিয়ন ভয় পেতেন বন্ধ দরজাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংলিন রুজভেল্ট ভয় পেতেন ১৩ নম্বরকে। এভাবে তুমিও হয়তো কিছু একটা দেখে ভয় পাও। ধরো, তুমি রাত জেগে পড়ছ, ঘরটা ঠান্ডা হয়ে আছে। মাথার ওপর ঘুরছে ফ্যান। হঠাৎ টেবিলের নিচে চকচকে কিছু একটা ছুটে গেল। তুমি চমকে উঠলে। দেখলে একটা তেলাপোকা দ্রুত ছুটে গেল। তোমার বিরক্ত লাগতে পারে। মনে হতে পারে, ‘ধুরু, তেলাপোকা’।
আমাদের ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন থাকলেও মাঝেমধ্যে এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। শহরের সাজানো ফ্ল্যাটেও হঠাৎ তেলাপোকা, ইঁদুর, টিকটিকি বা মাকড়সা দেখা যায়। কিন্তু কথা হলো, এদের দেখলেই আমরা কেন লাফিয়ে উঠি? কেন ভয় পাই?
এসব প্রাণীকে আমাদের আশপাশে দেখলে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র মুহূর্তেই ‘সতর্ক’ অবস্থায় চলে যায়। এই ভয়কে আমরা সাধারণত ‘বিরক্তিকর’ বা ‘অযৌক্তিক’ বলে উড়িয়ে দিই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই প্রতিক্রিয়ার পেছনে আছে আমাদের টিকে থাকার স্মৃতি, বেঁচে থাকার অভ্যাস। কখনো কখনো বস্তব বিপদের মধ্যেও এর উত্তর লুকিয়ে আছে।
গবেষকেরা বলছেন, প্রকৃতিতে মানুষের টিকে থাকার জন্য ভয় হলো প্রাচীনতম অ্যালার্ম সিস্টেম।
তেলাপোকাকে কেন ভয় পাই
তেলাপোকাকে নিয়ে আমাদের অস্বস্তির অনেক কারণ আছে। তেলাপোকা দেখলে আমাদের মনে হয়, ঘর নোংরা হয়ে আছে। পাশাপাশি একে ভয় পাওয়াটা আমাদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য। তেলাপোকা এমন এক প্রাণী, যাকে আমরা কখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এরা অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে। আলো দেখলে দৌড়ে পালায়। কখনো আবার ডানা ঝাপটে ছুটে আসে। এসব অনিয়মিত, অপ্রত্যাশিত আচরণ আমাদের মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করে। আর আমাদের মস্তিষ্ক যে জিনিসকে আগে থেকে অনুমান করতে পারে না, সেটাকে খুব সহজেই হুমকি হিসেবে ধরে নেয়।
পাশাপাশি তেলাপোকা প্রচণ্ড বিরূপ পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। এরা নিজেদের শরীরের ওজনের ৯০০ গুণ চাপও সহ্য করতে পারে। তাই তেলাপোকা দেখলে কেউ যদি হাতে থাকা কিছু একটা দিয়ে বাড়ি দেয়, দেখা যায় তেলাপোকাটা মরেনি। এদের বেঁচে থাকার ক্ষমতা অসাধারণ। দ্রুতগতিতে চলাচল আর ছোট ছোট পা আমাদের মস্তিষ্কে থাকা ‘পেস্ট অ্যালার্ম’কে সক্রিয় করে বলেই আমরা ভয় পাই। এই ভয়ের বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাটসারিডাফোবিয়া (Katsaridaphobia)
ইঁদুর দেখে আতঙ্ক
ইঁদুরকে ভয় পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা বাস্তব। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ইঁদুর রোগ ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম। সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া, ফুড পয়জনিং, এমনকি ভয়াবহ প্লেগের সঙ্গে ইঁদুরের নাম জড়িয়ে আছে। আমাদের মস্তিষ্ক এসব ঐতিহাসিক তথ্য মনে রাখে। মস্তিষ্ক ধরে নেয়, ইঁদুর মানেই ঝুঁকি।
এ ছাড়া রান্নাঘরের ডাস্টবিন, খাবারের দোকান বা ড্রেনের পাশে মাঝেমধ্যেই ইঁদুর দেখা যায়। আমরা কী করছি, আমরা আছি কি নেই, ইঁদুর এসবে পাত্তা দেয় না। তারা হুটহাট চলাফেরা করে। আমাদের শান্তি নষ্ট করে। ইঁদুর হঠাৎ আমাদের পায়ের কাছে ছুটে এলে মুহূর্তেই আমাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। আমরা ভয় পাই। এটা আমাদের স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া। এই ভয়ের নাম মুসোফোবিয়া (Musophobia)।
অবশ্য যারা শহরে থাকে, তারা খুব বেশি ইঁদুর দেখে না। তবে যখন দেখে, মস্তিষ্ক হুট করে পুরোনো দিনের বিপদের কথা ভেবে সতর্ক হয়ে যায়।
সাপ কেন ঘিনঘিনে, কেন ভয় পাই
মানুষের আদিম শত্রুদের একটি হলো সাপ। রাস্তায় অন্ধকারে সামান্য একটা দড়ি দেখলেও আমাদের পিলে চমকে ওঠে। এই বুঝি সাপ এল। আমরা লাফিয়ে উঠি। এই ভয় অমূলক নয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা হাজার হাজার বছর বনে জীবন কাটিয়েছে। সে সময় তারা প্রতিনিয়ত বিষাক্ত সাপের কামড় খাওয়ার আশঙ্কা বা ঝুঁকির মধ্যে থেকেছে। তাই সাপ দেখে ভয় পাওয়াকে আমাদের মস্তিষ্ক খুব জরুরি একটি প্রতিক্রিয়া হিসেবে মনে রাখে। বেঁচে থাকার জন্য এটি জরুরি।
সাপ দেখতে লিকলিকে। এর চলাফেরা, বিশেষ করে চুপচাপ চলাফেরা আমাদের স্নায়ুকে বিভ্রান্ত করে। এর এমনিতে পা নেই। তার ওপর চলে দ্রুত। আক্রমণের সময় ফোঁসফোঁস শব্দ করে। আবার মুখের মধ্যে দ্বিখণ্ডিত জিব আছে, সব মিলে এটা যেন ‘অচেনা ও বিপজ্জনক’ একটা প্যাকেজ। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে কমবেশি সাপ দেখা যায়। রাস্তার পাশে বা পানিতে সাপ দেখলে মানুষ আতঙ্কিত হয়। বিষয়টা অস্বাভাবিক নয়। সাপভীতিকে বলে ওফিডিওফোবিয়া (Ophidiophobia)। এই ফোবিয়ার পেছনেও আছে আমাদের টিকে থাকার স্মৃতি। তাই কখনো সাপ দেখলে এটি থেকে দূরে থাকো। জীবনের ঝুঁকি কমবে।
আট পায়ের মাকড়সাকে কেন ভয় পাই
মাকড়সার এমনিতে আট পা, তার ওপর দ্রুত নড়াচড়া করে। মাকড়সার ক্ষেত্রে কিছু মানুষ কম ভয় পায়। কেউ কেউ প্রচণ্ড ভয় পায়। অথচ মাকড়সা আকারে ছোট। অবশ্য দেখতে বিদ্ঘুটে। গবেষণায় দেখা গেছে, খুব ছোট শিশুরাও মাকড়সার ছবি দেখে ভয় পায়। এ থেকে বোঝা যায়, ভয়টা আমাদের শেখা নয়, জন্মগত হতে পারে।
মাকড়সার পা লম্বা, বড় চোখ, হুটহাট নড়াচড়া করে। এসব আমাদের মস্তিষ্কে বিশেষ ধরনের সংকেত পাঠায়। প্রাণীদের মধ্যে এমন আকৃতি কম দেখা যায়। তাই মস্তিষ্ক এটাকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে ধরে নেয়।
আবার মাকড়সা সাধারণত কোণে লুকিয়ে থাকে। হঠাৎ বেরিয়ে আসে আবার দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। এমন আচরণও ভয়ের কারণ। এই ভয়ের নাম আরকনোফোবিয়া (Arachnophobia)। তবে মনে রেখো, বেশির ভাগ মাকড়সাই মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
হুলের ভয় কার না আছে
ভয় পাই, এমন আরেক পোকা মৌমাছি। মৌমাছিকে ভয়ের কারণ আছে। এরা চলাফেরার সময় একটা আস্ত অস্ত্র নিয়ে ঘোরে। এদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো হুল। যাদের অ্যালার্জি আছে, তাদের জন্য মৌমাছির হুল বিপজ্জনক হতে পারে। এ কারণে মস্তিষ্ক খুব দ্রুত আমাদের সতর্ক করে। মৌমাছি দেখলেই আমাদের মনে তাড়না তৈরি হয়। আমাদের মস্তিষ্ক বলে, ‘পালাও’ ‘সরে যাও’।
মৌমাছিকে পাওয়া ভয়কে বলে অ্যাপিওফোবিয়া (Apiophobia) বা মেলিসোফোবিয়া (Melissophobia)। তবে মজার ব্যাপার হলো, মৌমাছি মানুষকে আক্রমণ করতে চায় না। এরা ফুল খুঁজে বেড়ায়। ফুলের পরাগ অন্য ফুলে নিয়ে যায়। নিজের কাজে ডুবে থাকে। তুমি যদি ওদের কাছাকাছি না যাও, বিরক্ত না করো, এরা কিছুই বলবে না।
দেয়ালে সেঁটে থাকা টিকটিকিকে কেন ভয় পাই
টিকটিকি আসলে মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। ঘরের মশা-মাছি খেয়ে এরা পরিবেশকে স্বাস্থ্যকর রাখে। সমস্যা হলো, বেশির ভাগ সময় এরা খুব নীরব থাকে। দিনের পর দিন অদৃশ্য থাকে। তবে হঠাৎ ঘরের দেয়ালে এদের দৌড়ে যেতে দেখা যায়। তখন আমাদের মনে অজান্তে ভাবনা তৈরি হয়। যা আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, হুট করে হাজির হয়, সেটা সন্দেহজনক। এই মানসিকতা থেকেই আসে ভয়। ঘর পরিষ্কার রাখলে, খাবার ঢেকে রাখলে ঘরে টিকটিকি কমে যায়।
একেকটি প্রাণী একেকভাবে আমাদের মস্তিষ্কে উদ্দীপনা জাগায়। কোনোটির চেহারা দেখে, কোনোটির গন্ধ শুঁকে, কোনোটির আচরণ দেখে আমাদের বিপদের স্মৃতি জেগে ওঠে। এটাই আমাদের ভয়ের কারণ। আধুনিক কোনো শহরে বাস করলেও এই ভয় একদম দূর হয়ে যায় না।
তেলাপোকা, সাপ, মাকড়সা বা ইঁদুরকে আমরা অযথা ভয় পাই না। এই ভয় আছে বলেই আমরা বেঁচে থাকার তাড়না বোধ করি।