রকিব হাসানের মহাপ্রয়াণ

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সেদিনটাও ছিল হেমন্তের। বিকেলের সোনালি আলোয় মাঠে বসে আছি। পাহারা দিচ্ছি গমখেত। পশ্চিম মাঠে গম বুনেছেন বাবা। সদ্য বোনা গম পাখিদের বড্ড পছন্দ। গমের বীজগুলো মুখে নিয়ে পালায়। তাই দিতে হয় পাহারা। বসে আছি আলের ওপর। উত্তরের হিমেল বাতাস ইছামতীর বুক ছুঁয়ে আরও শীতল হয়ে গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। রোমকূপে শিহরণ তোলে। তবে সেই শিহরণ আমার কাছে নস্যি। কারণ, অন্য একটা শিহরণ আমাকে পেয়ে বসেছে—তিন গোয়েন্দা। আলের ওপর পড়ছি ভূতের হাসি। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে রকি বিচের তিন কিশোর দুঃসাহসিক ও গা ছমছমে অভিযানে নেমেছে। আমি তাদের সঙ্গে মনশ্চক্ষু মেলে হইহই করে নেমে পড়েছি রহস্য সমাধানে।

সে এক অন্য রকম অনুভূতি, অন্য রকম আবেগ। এই অনুভূতি আজকালকার স্মার্টফোনে বুঁদ হওয়া ছেলেমেয়েরা কতটুকু বুঝবে, জানি না। পৃথিবী আজ তাদের মুঠোয়। সেকালে সেই অজপাড়াগাঁয়ের এক কিশোর, যে কিনা পত্রিকা আর রেডিওর কল্যাণে পৃথিবীটাকে খুব সামান্য চেনে, তার কাছে ক্যালিফোর্নিয়া, রকি বিচ—তেপান্তরের ওপারের কোনো এক রূপকথার রাজ্যই মনে হবে। তবে যে গল্প লেখক বলছেন, তা মোটেও রূপকথার অলৌকিকতায় মোড়া নয়। আমার গা ছমছম করে বটে, কিন্তু এক দুরন্ত বাঙালি কিশোর অবলীলায় ভূতের হাসির লৌকিক রহস্য সন্ধানে নেমে পড়েছে। এই রহস্যের যিনি রূপকার, যিনি থ্রিলারের সত্যিকারের শিহরণ আমার শিরদাঁড়ায় প্রথম এঁকে দিয়েছিলেন, যিনি সে সময় হয়ে উঠেছিলেন আমার স্বপ্নের নায়ক, ঠিক ২৪ বছর পর আরেক হেমন্তে তাঁর স্মৃতিচারণা করতে হচ্ছে। বড্ড ‘মন কেমন করা’ এক অনুভূতি চেপে ধরেছে। তবু বুকে পাথর চাপা দিয়ে সেই স্বপ্নের নায়কের কথা না লিখলেই নয়।

গমখেত পাহারা দিয়েছিলাম তিন দিন। ‘তিন গোয়েন্দা’র ‘ভলিউম ৩/২’ ওই তিন দিনে শেষ করে ফেলি।

এর আগেও ‘তিন গোয়েন্দা’র আরেকটা বই পড়েছি, মহাকাশে আগন্তুক—এটা ‘চিলার’ সিরিজের বই। তবু ফ্যান্টাসি আর সায়েন্স ফিকশনের মসলায় এখানেও ‘তিন গোয়েন্দা’ অপূর্ব চমক দিয়েছিল।

আরও পড়ুন

২.

সেবার সঙ্গে পরিচয় আমার রহস্য পত্রিকার সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সংখ্যা দিয়ে। আবিষ্কারের ছয় বছর পর সেটা পড়েছিলাম আর হাট করেই অজপাড়াগাঁয়ে এক আশ্চর্য পৃথিবীর দুয়ার খুলে গিয়েছিল। বিচিত্র সব ফিচার, দুর্দান্ত গল্প আর বিস্ময়কর সব অভিজ্ঞতাভিত্তিক লেখায় ভরা সেই পত্রিকাটি। সঙ্গে পাতায় পাতায় চুম্বকর্ষী সব বিজ্ঞাপন। অন্যগুলোর কথা বাদই দিলাম, শুধু তিন গোয়েন্দার জিনার সেই দ্বীপ, কুকুরখেকো ডাইনি—কী সব নামের বাহার! পাঠ্যবইয়ের বাইরে কিশোর সাহিত্য আগে তেমন পড়িনি বটে। তবে সবেধন নীলমণি হয়েছিল পাহাড়ে ফেলুদা বইটি, যাতে ছয়টি গোয়েন্দা কাহিনি ছিল।

সুতরাং গোয়েন্দা কাহিনি আমার কাছে একেবারে নতুন নয়। এবার ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়ব ভাবলাম, প্রথমেই ‘ভলিউম ১/১’-এর জন্য টাকা পাঠাই। কিন্তু ভুল করে ‘১/১’-এর বদলে ‘৩/২’ পাঠানো হলো। অগত্যা সেটাই পড়ে ফেললাম। অগত্যাই–বা বলি কেন, ‘কাকাতুয়া রহস্য’, ‘ছুটি’, ‘ভূতের হাসি’—টান টান উত্তেজনার তিন জমাট গল্প। যতটা গল্পের থ্রিল, ঠিক ততটাই পরিবেশে। রকি বিচে ওদের বাস, সেখানে একটা পুরোনো স্যালভিজ ইয়ার্ডের জঞ্জালের নিচে হেডকোয়ার্টার। বেশ কয়েকটা গোপন দরজা আছে সেখানে ঢোকার। কিন্তু সে পথের হদিস তিন গোয়েন্দা ছাড়া আর কেউ জানে না।

জায়গাটা আবার হলিউডের কাছে। টিভি ছিল না বাড়িতে, তাই হলিউডের কোনো মুভি দেখিনি। কিন্তু পত্রিকার কল্যাণে হলিউডের চরিত্রগুলোর অনেকের মুখ চিনি, নাম জানি। সেই হলিউডের এত কাছে থাকে তিন কাছের বন্ধু! হ্যাঁ, বন্ধুই। প্রথম বইটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কখন যে ওরা বন্ধু হয়ে গিয়েছে, টেরই পাইনি। রোমাঞ্চের শুরু সেখান থেকেই, একটা অজপাড়াগাঁয়ের নিঝুম বিকেলে, পড়তি আলোয় পড়া একটা বইয়ের পাতা থেকে সেটার শুরু।

আরও পড়ুন

এরপর রহস্য পত্রিকা নিয়মিত নিতে শুরু করি। ডাকযোগে। সেবার বইও কিনি, একইভাবে। একটা চিঠিও লিখি রহস্য পত্রিকায়। কোনোভাবে যদি রকিবদা, অর্থাৎ রকিব হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়! পাড়াগাঁয়ে তখনো মুঠোফোন আসেনি, ল্যান্ডফোন থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম চিঠি। সেই অভিপ্রায় জানিয়ে রহস্য পত্রিকার খোলাচিঠি পাঠানো হলো। চিঠিটা ছাপা হলো, তার নিচে ছোট্ট করে কাজীদা জবাব দিলেন। বললেন, আমার অভিপ্রায় রকিব হাসানকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঠিকানাও দিয়েছেন।

ওই পর্যন্তই। রকিবদার চিঠির অপেক্ষায় ছিলাম। কয়েক মাস। কিন্তু পাইনি। বছর দশেক পর তাঁর সঙ্গে সরাসরি দেখা হয়।

৩.

আজকালকার ছেলেমেয়েরা প্রিয় লেখককে স্যার বলে। আমরা বলি ভাই, সেবার রীতি ছিল নামের সঙ্গে ‘দা’ জুড়ে দেওয়ার। যেমন কাজীদা, হাকিমদা ও রকিবদা। এই তিনজন তখন সেবার রহস্য পত্রিকার সম্পাদনার টেবিল সামলাচ্ছেন। কাজীদা আমৃত্যু সম্পাদক ছিলেন। আমাদের সময় সহকারী ছিলেন রকিবদা আর হাকিমদা, অর্থাৎ শেখ আবদুল হাকিম।

রহস্য পত্রিকায় মাঝেমধ্যে আমার লেখা ছাপা হয়। প্রতিটা লেখা ছাপা হওয়ার পর বুকের ছাতিটা যেন এক-দুই ইঞ্চি করে বাড়ে। তখন কাজীদার ‘মাসুদ রানা’ পড়ছি, হাকিমদার সব মাস্টারপিসও একে একে পড়তে শুরু করেছি। কিন্তু বন্ধুত্বটা সবচেয়ে বেশি কিশোর, মুসা আর রবিনের সঙ্গে।

কখনো তাঁদের সঙ্গে পাড়ি দিচ্ছি আমাজনের ভীষণ অরণ্য, কখনোবা অথই সাগরে তাদের বুদ্ধির ঝিলিকে বিমোহিত হচ্ছি। কঙ্কাল দ্বীপ কিংবা জিনার সেই দ্বীপে চলছে অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার। কখনো কুকুরখেকো ডাইনি, সবুজ ভূত, রুপালি মাকড়সা, কখনোবা দুর্ধর্ষ পোচার, রত্নদানোর মুখোমুখি হয়ে তিন গোয়েন্দার ক্যারিশমায় হাঁপ ছাড়ছি।

যে ছেলেটা এসএসএসির আগপর্যন্ত ১৬ বছরে মাত্র দুটি বই পড়েছে, সেই ছেলেটায় পরের দুই বছরে কয়েক শ বই পড়ে ফেলে ‘সেবা’র কল্যাণে। গ্রাম ছেড়ে একসময় যশোরে আসি, সেখানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে বই নিই নিয়মিত। বিশ্বসাহিত্যের আজব জগতের সুলুক সন্ধান করছি, শার্লক হোমস চলছে, পড়ছি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘অদ্ভুতুড়ে’ সিরিজ, তার ফাঁকে ফাঁকে ‘তিন গোয়েন্দা’ গিলছি গোগ্রাসে। তবে ‘তিন গোয়েন্দা’র একনিষ্ঠ ভক্তরা যেভাবে একটা পড়ে পুরো সিরিজ শেষ করে ফেলে, আমি সেভাবে পড়িনি।

কয়েক মাস বিরতি দিয়ে একটা করে ভলিউম পড়ি। তবু রকিব হাসানের লেখা ৬০টি ভলিউম এখনো শেষ করিনি। ইচ্ছা করেই। বয়স বাড়ছে, তবু মাঝেমধ্যে কৈশোরে ফিরে যেতে মন চায়। তখন ‘তিন গোয়েন্দা’র না পড়া বইগুলো একটা বের করে পড়ি। এখনো সেই কৈশোরের মতোই বিভোর হয়ে যাই। মনে হয়, কিশোর, মুসা, রবিনের মতো আমার বয়সও থমকে আছে কৈশোরেই।

আমি সব সময় বৈচিত্র্য বজায় রেখে বই পড়ার চেষ্টা করি। আমাদের মাঝেমধ্যে যেমন মিষ্টি খেতে মন চায়, মাঝেমধ্যে পায় ঝালের তেষ্টা, কখনো আবার টকের—আমার বই পড়ার গতিকও তেমন। কখনো কোনো ফিকশন পড়তে ইচ্ছা করে, কখনো নন-ফিকশন। কখনো ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিক পড়তে মন চায়, কখনো বাংলার চিরায়ত উপন্যাস, কখনো ‘তিন গোয়েন্দা’, ‘মাসুদ রানা’, কখনো ঐতিহাসিক কাহিনি, কখনো সায়েন্স ফিকশন। এই বিচিত্র তৃষ্ণার কারণে আজও কিছু ‘তিন গোয়েন্দা’ রেখে দিয়েছি রসিয়ে রসিয়ে পড়ব বলে। কোথাও ভ্রমণে গেলে ‘তিন গোয়েন্দা’র বই রাখি। আকারে ছোট, সহজেই ব্যাগের এককোণে এঁটে যায়। ভ্রমণে আমার সাথি হয় কিশোর-মুসা-রবিন।

আরও পড়ুন

৪.

২০১০ সালে ঢাকায় আসি৷ ২০১২ সালে আমার বন্ধু সুজন ছায়াবীথি নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলেন। তিনি আমাকে একটা পাণ্ডুলিপি দিলেন পড়তে। বুনো পশ্চিমের গল্প—বইয়ের নাম। আসলে এক অনবদ্য ওয়েস্টার্ন উপন্যাস। লেখক রকিব হাসান। দুই দিন তাতে বুঁদ হয়ে রইলাম। অসাধারণ কাহিনি। ছায়াবীথি থেকে বইটা বেরোল।

সে বছর বইমেলায় একদিন ছায়াবীথির স্টলের সামনে প্রকাশক বন্ধু পরিচয় করিয়ে দিলেন এক লেখকের সঙ্গে। আমাকে বললেন, ‘ওনাকে চেনেন?’

আমি চিনেও যেন চিনতে পারছিলাম না। বন্ধুটি বললেন, ইনিই রকিবদা। রকিবদা নিজেই হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। কথা হলো, আড্ডা হলো। তাঁকে বুঝতে দিলাম না, কিন্তু আমার রোমকূপে তখন শিহরণ বয়ে চলেছে। বছর ১১ আগে যে কিশোর ছেলেটা, অজপাড়াগাঁেয়র গমখেত পাহারা দিতে গিয়ে ‘তিন গোয়েন্দা’য় বুঁদ হয়ে থাকত। আজ সেই আমি কিনা সেই লোকটার সঙ্গে আড্ডা মারছি। ওই লোকটা কি বুঝতে পারছে, আমার ভেতরটা তোলপাড় করা আবেগটা!

তারপর পরের দুই মেলায় আরও দু-তিন দিন রকিবদার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ম্যারাথন আলাপ। আমার একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন, সঙ্গে সমাজ, পৃথিবী, এমনকি মহাবিশ্ব সম্পর্কেও আওড়ে যাচ্ছেন নিজের সরল দর্শন। এলিয়েনদের নিয়ে লেখা দানিকেন থেকে প্রভাবিত বইয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, যৌবনে অতি উৎসাহী হয়ে এসব বই লিখেছি। এখনকার মতো মানসিক অবস্থা থাকলে ওসব ছাইপাঁশ লিখতামই না।

সমাজের কুসংস্কার নিয়ে কথা বললেন, উষ্মাও প্রকাশ করলেন। এই রকিবদা আমার কাছে সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন। আমি জানতাম, তিনি জনসমক্ষে নিজের চেহারা দেখাতে চান না। এ জন্যই বইয়ের প্রচ্ছদে কিংবা পত্রিকায় ছবি ছাপা হয় না। তাই বইমেলায় চরম তিন গোয়েন্দাভক্তও তাঁকে দ্রুত চিনতে পারে না। আমি কয়েকজনকে চিনিয়ে দিলাম, তারা গিয়ে রকিবদাকে ছেঁকে ধরল। রকিবদাও প্রাণ খুলে ওদের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে গেলেন।

এরপর ফোনে যোগাযোগ হতো মাঝেমধ্যে। কথা হতো।

৫.

রকিবদা চলে গেলেন। একটু আগেভাগেই গেলেন। একজন তরতাজা, প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বিছানাগত হলেন। আর উঠলেন না, বিছানা থেকে লড়াই চালিয়ে গেলেন অসুখের সঙ্গে, অসীম প্রাণশক্তি নিয়ে নিয়মিত লিখেও যাচ্ছিলেন কিশোর আলোয়। কিন্তু জীবনপথের সব পথিককেই একসময় থামতে হয়, রকিবদাও থামলেন। আর চিরতরে বন্ধ হলো পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের গুপ্ত দরজাগুলো। সেগুলোর চাবি যে রকিবদা চিরদিনের জন্য নিয়ে গেছেন মর্ত্যলোক থেকে স্মৃতিলোকে। কিশোর, মুসা, রবিন তাই অভিভাবকহারা হয়ে কালের গর্ভে ইতিহাস হয়ে রইল।

আরও পড়ুন