মহাকাশেও বেঁচে থাকতে পারে এমন প্রাণী এই প্রথম পাওয়া গেল

ছবিটি দেখে মনে হতে পারে, এটি ভালুকের মতো দেখতে কোনো কার্টুন চরিত্র। তবে মজার ব্যাপার হলো, এটি কোনো কাল্পনিক প্রাণী নয়। মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখা যায় এদের অদ্ভুত চেহারার আটটি পা। এই ছোট প্রাণীর ক্ষমতা শুনলে তুমি চমকে যাবে। এমন একটি প্রাণী কি কল্পনা করা যায়, যা প্রচণ্ড তাপ, হিমশীতল ঠান্ডা, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, এমনকি মহাশূন্যেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে? এটি কল্পনা মনে হলেও, এটাই বাস্তব। এই অসাধারণ প্রাণীর নাম টার্ডিগ্রেড। কিন্তু কীভাবে এরা এই অবিশ্বাস্য ক্ষমতা পেল?

টার্ডিগ্রেডদের সাধারণত ‘পানি ভাল্লুক’ নামে ডাকা হয়। ১৭৭৩ সালে জার্মান বিজ্ঞানী জোহান অগস্ট এফ্রাইম গোয়েজ প্রথম এই প্রাণীকে আবিষ্কার করেন। তিনি এদের অদ্ভুত চেহারা ও ধীরগতির জন্য ‘ছোট পানি ভালুক’ নাম দেন। এর তিন বছর পর ইতালীয় জীববিজ্ঞানী লাজারো স্পালানজানি এদের ধীরগতি দেখে এই গ্রুপের নামকরণ করেন ‘টার্ডিগ্রেড’, যার অর্থ ধীরগতির পদচারী। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৩০০ প্রজাতির টার্ডিগ্রেড শনাক্ত করেছেন।

আরও পড়ুন

টার্ডিগ্রেড নিঃসন্দেহে পৃথিবী ও মহাকাশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাণীদের একটি। এসব পানি ভালুকগুলো হিমালয়ের চূড়া থেকে গভীর সাগরের তলদেশ পর্যন্ত সব ধরনের কঠিন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে পারে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, যেমন প্রচণ্ড তাপ, তীব্র ঠান্ডা বা শুষ্ক পরিবেশে টার্ডিগ্রেডরা নিজেদের শরীর থেকে প্রায় সব পানি বের করে দেয়। এতে এরা একটি শুকনো গুটিতে পরিণত হয়। এই বিশেষ অবস্থাকে বলা হয় ‘টন’। এ অবস্থায় এদের বিপাকক্রিয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যতক্ষণ না পরিস্থিতি আবার অনুকূল হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এরা এ অবস্থায় থাকতে পারে। এরপর চারপাশের পরিবেশে সামান্য পানি পেলেই এরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। বিজ্ঞানীরা আগেই জানতেন যে টার্ডিগ্রেডরা ‘টন’ নামক এক বিশেষ অবস্থায় গিয়ে চরম পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু তাঁরা জানতেন না, কীভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বিজ্ঞানীরা অবশেষে সেই রহস্যের সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। ২০২৪ সালের ১৭ জানুয়ারি প্লস ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় এ–সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জানান হয়। গবেষণাপত্রে জানান হয়েছে, যখন কোনো প্রতিকূল পরিবেশে পড়ে, তখন টার্ডিগ্রেডের কোষ থেকে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। এসব পদার্থ সিস্টাইন নামের একটি অ্যামিনো অ্যাসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, যা টার্ডিগ্রেডের প্রোটিনের গঠন পরিবর্তন করে। এই পরিবর্তনের ফলেই প্রাণীটি সেই বিশেষ ‘টন’ অবস্থায় প্রবেশ করে, যা এটিকে চরম পরিস্থিতিতেও বাঁচিয়ে রাখে।

আরও পড়ুন

টার্ডিগ্রেডকে খালি চোখে দেখা গেলেও এদের আকার এতই ক্ষুদ্র যে তা সহজে চোখে পড়ে না। ওয়ার্ল্ড টার্ডিগ্রেডা ডেটাবেজ অনুসারে, এরা সাধারণত ০.০১ থেকে ১ মিলিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এই ছোট্ট প্রাণীর পুরো শরীর গঠিত মাত্র এক হাজার কোষ দিয়ে। যেখানে মানুষের শরীরে রয়েছে অসংখ্য ট্রিলিয়ন কোষ।

তুমি যদি মাইক্রোস্কোপ দিয়ে টার্ডিগ্রেড দেখো, তাহলে এর ক্ষুদ্র দেহে কোনো হাড় দেখতে পাবে না। হাড়ের বদলে এদের একটি তরলে পরিপূর্ণ অংশ থাকে, যাকে বলে হিমোলিম্ফ। মানুষের রক্তের মতোই, এই হিমোলিম্ফ পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। এদের মেরুদণ্ড না থাকলেও সম্পূর্ণ স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে, যা মস্তিষ্ক থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে সংকেত পাঠায়। এটি মেরুদণ্ডী প্রাণীর মেরুদণ্ডের মতোই কাজ করে। এদের সম্পূর্ণ পরিপাকতন্ত্র থাকলেও কোনো সংবহন বা শ্বাসযন্ত্র নেই। পানি থেকে অক্সিজেন সরাসরি এদের ত্বকের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। শরীরের ভেতর পুষ্টি ও অক্সিজেন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এরা পেশিগুলো সংকুচিত করে।

আরও পড়ুন
টার্ডিগ্রেডের এই ক্ষমতা শুধু পৃথিবীর পরিবেশেই সীমাবদ্ধ নয়
ছবি: পপুলার মেকানিকস

টন অবস্থায় থাকা টার্ডিগ্রেডরা মাইনাস ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এরা বিকিরণ, ফুটন্ত তরল এবং সাগরের গভীরতম অংশের চেয়ে ছয় গুণ বেশি চাপ সহ্য করতে পারে। টন অবস্থায় থাকা কিছু টার্ডিগ্রেডকে উচ্চগতির বন্দুক থেকে গুলি করেও দেখা গেছে যে এরা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৯০০ মিটার বেগে ছুটে যাওয়ার পরও বেঁচে থাকে।

টার্ডিগ্রেডের এই ক্ষমতা শুধু পৃথিবীর পরিবেশেই সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে এরা মহাকাশের ভয়ংকর অবস্থা সহ্য করতে পারে। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইসার) ২০০৭ সালে ফোটন-এম৩ নামের একটি মহাকাশ অভিযানে হাজার হাজার টার্ডিগ্রেডকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এদের মহাকাশের শূন্যে, তীব্র সৌর বিকিরণ ও মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। বিজ্ঞানীরা বিস্মিত হয়ে দেখেন যে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর এদের বেশির ভাগই বেঁচে আছে। এমনকি বংশবৃদ্ধিও করেছে। পানিশূন্য অবস্থায় কিছু টার্ডিগ্রেড পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ১০ দিন পর্যন্ত টিকে ছিল।

বেশির ভাগ টার্ডিগ্রেড উদ্ভিদ, শৈবাল ও ছত্রাকের কোষ থেকে তরল শুষে খেয়ে জীবন ধারণ করে। তবে কিছু প্রজাতির টার্ডিগ্রেড আছে যারা নেমাটোড এবং অন্য টার্ডিগ্রেডের মতো ক্ষুদ্র প্রাণীদেরও খায়। এদের নিয়ে এখনো গবেষণা শেষ হয়নি।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, সায়েন্টিফিল আমেরিকান, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

আরও পড়ুন