ডিউক জনের সায়েন্স ফিকশন—টাইমলাইন

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

এক

ঢাকা। ব্রহ্মপুত্রের তীরে স্বচ্ছ গম্বুজে ঢাকা আধুনিকতম নগরীটি যেন এক অলৌকিক নির্মাণ। গগনচুম্বী কাচের দালান আর ম্যাগলেভ উড়ালসড়কে বড় মনোরম দেখায় শহরটিকে।

কিন্তু এই সৌন্দর্যের উল্টো পিঠে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ ইতিহাস। হাজার বছর আগের এক মহাবিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল গোটা দুনিয়াই। বাংলাদেশও রক্ষা পায়নি। সভ্যতা আবারও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই বিপর্যয়ের রহস্য এখনো অমীমাংসিত।

আর এই না পাওয়া উত্তরই তাড়িয়ে বেড়ায় ষোড়শী আলিনা চৌধুরীকে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান পরিষদের শিক্ষানবিশ গবেষক সে। নিরাপদ গম্বুজের বাইরে নিষ্ফলা, মৃতপ্রায় ভূমির দিকে তাকালে ওর বুকের ভেতর উথলে ওঠে হাহাকার। মনে হয়, সমস্ত রহস্যের, সমস্ত প্রশ্নের জবাব রয়েছে অতীতের কোনো অন্ধকার কোণে।

এক সকালে আলিনাকে ডেকে পাঠালেন ওর অভিভাবক ও মেন্টর ড. রাশা তুলিসা।

‘আলিনা,’ কণ্ঠস্বরে অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য তাঁর, ‘গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলব তোমাকে। সময়ভ্রমণে যাচ্ছি আমি; এক হাজার বছর পেছনে। মহাবিপর্যয়ের আগের বাংলাদেশে।’

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল আলিনা, ‘সময়ভ্রমণ…সত্যিই?’

মৃদু হাসলেন তুলিসা, ‘অতীতের বহু রেকর্ড হারিয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখতে হলে সত্য জানা ছাড়া উপায় নেই। আমার হয়তো মাসখানেক লাগবে কাজ সারতে, কিন্তু তোমার কাছে মনে হবে কয়েক সেকেন্ড।’

চোখে জল এসে গেল আলিনার, ‘কিন্তু যদি…ফিরে না আসেন?’

ওর মাথায় হাত রাখলেন তুলিসা, ‘তাহলে তুমি থাকছ, তোমরা থাকছ। তোমাদের ওপরই রইল বিজ্ঞান পরিষদের দায়িত্ব।’

কিছু বলল না আলিনা, ওর মগজে তখন অন্য চিন্তা।

আরও পড়ুন

দুই

পরদিন ভোরে তুলিসা যখন গভীর ঘুমে, মহিলার বেগুনি লকেটটি হাত করল আলিনা। ওটা ছাড়া কেউই প্রবেশ করতে পারে না নিষিদ্ধ জিরো-জোনে। সময়প্রযুক্তির ল্যাবরেটরি রয়েছে সেখানে।

লকেট দেখাতেই সবুজ আলো জ্বলে উঠল স্ক্যানারে।

মাটির গভীরে, বিশাল গুহামতো চেম্বারে নেমে এল আলিনা লিফটে করে। সময়ের প্রবেশদ্বার তৈরি করা হয়েছে এখানে। চারদিকে গুঞ্জন। স্ট্যাটিকের খসখসে আওয়াজে বাতাস যেন শিউরে উঠছে।

ল্যাবের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রধান বিজ্ঞানী ড. মারজুক গনি, চেহারায় একই সঙ্গে দৃঢ়তা ও অনিশ্চয়তা। চমকে উঠলেন মেয়েটিকে দেখে, ‘আলিনা! তুমি কী করছ...?’

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই উজ্জ্বল নীল-সাদা আলোর বিস্ফোরণ ঘটল সময়দুয়ারে। দীর্ঘদেহী কে একজন ভোজবাজির মতো যেন উদয় হলো ল্যাবরেটরিতে। কালো বর্মে ঢাকা তার শরীর, চোখ দুটো লালচে, দস্তানায় বিচিত্র আঁকিবুঁকি।

একধাক্কায় বর্ষীয়ান বিজ্ঞানীকে সরিয়ে দিয়ে খপ করে হাত চেপে ধরল আলিনার, টেনে নিল নিজের দিকে। অন্য বিজ্ঞানীরা চিৎকার করে উঠলেও কেউই স্পর্শ করতে পারল না আগন্তুককে।

আলোর ঝলক দেখা গেল আবারও, পরক্ষণেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল দুজন।

আলিনাকে নিয়ে সময়ের ঘূর্ণিতে গায়েব হয়ে গেছে রহস্যময় চরিত্রটি!

আরও পড়ুন

তিন

রিকশার টুংটাং, বাসের পীড়াদায়ক হর্ন, মানুষের ভিড়ভাট্টা, শোরগোল, ধুলো, খাবারের দোকান থেকে ভেসে আসা ভাজাপোড়ার গন্ধ…সুদূরের কোনো এক কোলাহলময় অতীতে এসে হাজির হয়েছে, হুঁশ ফিরতেই বুঝতে পারল আলিনা। গরমে চিড়বিড় করছে গা। এক দোকানের সাইনবোর্ডে চোখ পড়ল; শাহ আলি স্টোর।

‘১৯৯৫ সালের ঢাকা এটা।’ ঘোষণা করল ওর সঙ্গী।

তার দিকে তাকাল আলিনা, ‘কে আপনি?’

একটু হাসল রহস্যময় মানুষটি, ‘নাম রুস্তম বেগ। বিজ্ঞান পরিষদের সদস্য ছিলাম আমিও। অতিরিক্ত কৌতূহলের কারণে বহিষ্কার করেছিল তুলিসা।’

‘ক্-কী চান আমার কাছে?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল আলিনা।

‘তেমন কিছু না। জানি, আমারই মতো কৌতূহলী তুমি। সে জন্যই নিয়ে এলাম আরকি।...হ্যাঁ, এখান থেকেই সূচনা মহা ধ্বংসযজ্ঞের।’

চার

পুরান ঢাকার চকবাজারের এক ভাঙাচোরা গোডাউনে নিয়ে এল আলিনাকে রুস্তম বেগ। ততক্ষণে রাত নেমে গেছে। চাঁদের আলো ঢুকছে গুদামঘরের টিনের চালের ফাঁকফোকর দিয়ে। গরম আর গুমোট গন্ধে হাঁসফাঁস লেগে উঠল আলিনার।

‘তুলিসা তোমাকে খুঁজতে আসবেই।’ হিসহিস করে উচ্চারণ করল বেগ, ‘আর তখনই শেষ করব তোমাদের চিফকে।’

‘ভয় দেখাচ্ছেন?’ দৃঢ়কণ্ঠে জবাব চাইল আলিনা।

শুনে থতমত খেয়ে গেল রুস্তম। অদ্ভুত আগুন মেয়েটির চোখে। ভয়-ডর কাকে বলে, জানে না যেন। মুহূর্তের জন্য দম আটকে এল তার।

আরও পড়ুন

পাঁচ

হঠাৎ আলোর ঝলকানি গুদামঘরের আবছা আঁধারে।

চমকে উঠল দুজন।

আলো ভেদ করে যে মানুষটি বেরিয়ে এলেন...

ড. তুলিসা!

হাতে তাঁর রক্তলাল আলোর তরবারি, দুচোখে কঠোর সংকল্প।

‘আলিনা, চলে এসো এদিকে!’ বললেন তিনি শাণিত কণ্ঠে।

নির্দেশ মানতে এক সেকেন্ডও দেরি করল না আলিনা।

এরই ফাঁকে মেঝে থেকে একখানা লোহার ডান্ডা কুড়িয়ে নিয়েছে রুস্তম বেগ।

শুরু হলো ধুন্ধুমার যুদ্ধ।

তুলিসার তরবারি আলোর তৈরি হলেও ইস্পাতের বাড়া। তলোয়ারবাজিতেও হাত পাকা তাঁর। বজ্রপাতের মতো আওয়াজ উঠছে লোহা আর আলোকাস্ত্রের সংঘর্ষে।

একপর্যায়ে তুলিসার কাছে পরাস্ত হতেই হলো বেগকে, মাটিতে ফেলে দিলেন তাকে বিজ্ঞান পরিষদের প্রধান।

মরিয়া হয়ে কোমরের বেল্টের বাকলে চাপ দিল এবার রুস্তম। সময়ের দরজা খোলার সুইচ আছে ওতে, তার নিজের আবিষ্কার। পালাতে চাইছে সে অন্য কোনো সময়ের বাঁকে।

পাশেই আবার ঝলসে উঠল আলো।

গড়ান দিয়ে সময়দ্বারের দিকে এগোতে চাইল রুস্তম বেগ।

প্রস্তুতই ছিলেন তুলিসা, লাফিয়ে ধরলেন বেল্টের বাকল।

রুস্তম ভাবল, তাকে আটকাতে চাইছেন মহিলা, ফলে সে-ও জোর খাটাল উল্টো দিকে। এদিকে প্রচণ্ড শক্তিতে টানছে তাকে আলোর দরজা। শেষমেশ টেনেই নিয়ে গেল শোঁও করে এবং পরমুহূর্তেই দপ করে নিভে গেল আলোটা।

সময়ের ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে গেছে রুস্তম বেগ!

কিন্তু তুলিসার হাতে রয়ে গেছে তার কোমরবন্ধনী।

‘কোথায় লুকাল বদমাশটা?’এ গিয়ে এসে জানতে চাইল আলিনা।

‘কে জানে, কোথায়!’ ক্লান্ত গলায় জবাব দিলেন তুলিসা, ‘আরও কয়েক শ বছর পেছনেও হতে পারে…আবার ভবিষ্যতেও।’

‘ইশ্‌, পালিয়ে গেল!’

‘হ্যাঁ, তা গেছে। তবে সময়ের ঘূর্ণিপাকে অনন্তকাল ঘুরে মরবে সে।’

‘মানে?’

বেল্টটা উঁচিয়ে দেখালেন তুলিসা, ‘এই যে…এটা ফেলে গেছে বেগ। সময়ের দ্বার খোলার চাবি। পাগলাটে হলেও দারুণ প্রতিভাবান ছিল লোকটা।’ শেষ বাক্যটা বলতে গিয়ে দুঃখ ঝরল তাঁর কণ্ঠে।

ক্ষণিকের নীরবতা।

‘এবার কি তাহলে ফিরে যাব আমরা?’ প্রশ্ন আলিনার।

‘উহুঁ।’ হাসলেন তুলিসা, ‘আমার কাজ তো বাকি এখনো। মহাদুর্যোগের রহস্য জানতে হবে না? তবে এবার দুজন মিলে খুঁজে ফিরব এর উত্তর। কী বলো!’

আরও পড়ুন