নাবিল মুহতাসিমের অ্যাডভেঞ্চার গল্প—দ্বৈরথ

অলংকরণ: এস এম রািকব

বাজপড়া!

শব্দটা কোথায় শিখেছিলাম, মনে নেই। কিন্তু এই যে দ্বীপে আটকা পড়েছি ফাটা কপালের দোষে, তাকে এই একটা শব্দে সুন্দর বোঝানো যায়।

তোমরা এখনই জানতে চাইবে, কীভাবে এলাম দ্বীপটায়। এখনকার দিনে আবার কেউ জাহাজডুবির শিকার হয়ে দ্বীপে আটকা পড়ে নাকি? পড়ে, যদি সে কার্গো শিপে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি করে, আর তার জাহাজ যদি প্রশান্ত মহাসাগরের সাইক্লোনের মুখোমুখি হয়।

এটা নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। শুধু সাইক্লোন হলে একটা কথা ছিল, তার ওপর আমাদের জাহাজ ইঞ্জিনের সমস্যায় পড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে মাঝসমুদ্রে থেমে ছিল দেড় দিন। আমিই তো জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার, সমস্যাটা ধরার চেষ্টা করছিলাম আমার দুজন কলিগকে নিয়ে। হুট করে রেডিওতে ঝড়ের ঘোষণা; অস্বাভাবিক দ্রুত তৈরি হয়েছে সেটা এই মৌসুমে। এরপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। ঝড়ের প্রথম ঝাপটাতেই আমাদের বোঝাই জাহাজের দফারফা। কাত হয়ে ডুবতে শুরু করার পর একটা লাইফবোটে ওঠার চেষ্টা করছি, এটুকুই মনে আছে। জ্ঞান ফিরল যখন, এই ছোট্ট দ্বীপের লেগুনের নীল পানিতে দোল খাচ্ছে লাইফবোটটা, সেটার ওপরে পড়ে ছিলাম আমি। আমার দু–তিনজন সহকর্মী তো একই লাইফবোটে ওঠার চেষ্টা করছিল, অন্য লাইফবোটে ছিল আরও অনেকে। তাদের কী হলো? জাহাজের কী হলো?

জানা নেই। যেমন জানি না, দ্বীপটা ঠিক কোথায়। তা নিয়ে খুব একটা মাথাও ঘামাইনি অবশ্য। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অসংখ্য খুদে দ্বীপের অভাব নেই। বেশির ভাগই জনমানবহীন এবং সেটার কারণ খুব সহজ। প্রথম কারণ: জনবহুল দ্বীপগুলো থেকে এরা বহু দূরে। দ্বিতীয় কারণটা আমার বিপদের মূলে। এসব দ্বীপে বেঁচে থাকার উপকরণের বড্ড অভাব।

দ্বীপটার সামান্য বর্ণনা দিলেই বুঝতে পারবে। সাদা ধবধবে বালুর সৈকত, সেটা ছাড়িয়ে একটু সামনে গেলেই পাথর শুরু। গোটা দ্বীপটাই পাথুরে। এলোমেলো জঙ্গল আর ঝোপে ভর্তি দ্বীপটা, খালি দ্বীপের মাঝখানে মাথা উঁচিয়ে থাকা পাথুরে টিলাটা ছাড়া। জঙ্গলটা এলোমেলো লন্ডভন্ড হয়ে আছে ঝড়ে।

‘প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ’ শুনলেই মনে পড়ে বাতাসে দুলতে থাকা নারকেলের পাতা। এই দ্বীপে একটাও নেই সেই গাছ। পানি? চারপাশের নোনা সমুদ্র বাদ দিলে খাবার পানি সামান্যই, পাথরের খোঁদলে ঝড়ের সময় যা একটু জমেছিল। লাইফবোট থেকে কোনোমতে নেমে এ রকমই একটা গর্ত থেকে খানিকটা পানি খেয়ে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম আমি।

খাবার? এই প্রশ্নের জবাব তোমাদের কী দেব, পাঠক! আমিই খুঁজে মরছি। নারকেল নেই, থাকলে শাঁস খেয়ে বাঁচা যেত। পাখির বাসা নেই, থাকলে ডিমটিম খোঁজা যেত। বন্য কোনো প্রাণী চোখে পড়েনি, থাকলে শিকার করার চেষ্টা করে দেখতাম। গাছপালা বিশেষ চিনি না, কোনোটার ফল বা শিকড় খাওয়ার মতো কি না, জানা নেই।

মাছগুলো কেটেকুটে একটা পাত্রে নোনাপানিসমেত চড়িয়ে শুকনা ডালপাতার আগুনে স্যুপের মতো কিছু একটা বানিয়ে খাওয়া সারলাম। ভাগ্যিস, দেশলাইটা ওয়াটারপ্রুফ।

বড় একটা সমস্যা বারবার তাড়া করছে। গাছপালা সবই ভেঙেচুরে গেছে সাইক্লোনের ঝাপটায়। এই ঝড়েই গাছ থেকে পাখির বাসাটাসা উড়ে গেছে, ফলমূল কিছু থেকে থাকলে সেগুলোও গায়েব হয়ে গেছে। অন্য সময় হলে হয়তো টুকটাক খাবার কুড়িয়েটুড়িয়ে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে এক–দুই মাস বাঁচা যেত প্লেন বা জাহাজযোগে কোনো সাহায্য পৌঁছানোর আশায়, কিন্তু এখন একেকটা দিন পার করাই অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

ঝড়ের ঠিক পরপর নয়, বরং ভালো আবহাওয়ার সময় যদি আটকা পড়তাম, তাহলে কিন্তু বেশ কিছুদিন রবিনসন ক্রুসোগিরি করা যেত। লাইফবোটে কোনো খাবারদাবার না আনতে পারলেও একটা ইমার্জেন্সি টুলবক্স রয়ে গেছে বাঁধা অবস্থায়। সেটায় পেয়েছি বেশ কিছু দরকারি জিনিস: সিগন্যাল দেওয়ার আয়না, একটা ফ্লেয়ার গান—পাবজি গেমে যেমন দেখেছ, নোনাপানি সূর্যের তাপে বাষ্প করার একটা যন্ত্র, ফ্ল্যাশলাইট, দেশলাই, পানির খালি পাত্র, ব্যান্ডেজ-আয়োডিন-কাঁচিসহ সামান্য ওষুধপত্র। একটা ছুরি, খানিকটা দড়ি, একটা তাঁবু। বড়শি আর সেটার সুতা।

আরও পড়ুন

বিশেষ করে শেষের কটা জিনিস পেয়ে ধড়ে প্রাণ ফিরেছিল, বুঝতেই পারছ। তাঁবু খাটাতে পারলে রোদের তাপ থেকে মাথা বাঁচানো যায়। বড়শি আর সুতা থাকলে ছিপ বানাতে কতক্ষণ? লেগুনটায় মাছ ধরে খেয়ে বাঁচা যাবে। নোনাপানি রোদের তাপ দিয়ে বাষ্প করে আবার জমিয়ে মিষ্টি পানি বানিয়ে খেয়ে কষ্টেসৃষ্টে জীবনটা রক্ষা করা যাবে।

তাঁবুটা খাটালাম গাছপালার ধারে একটা জায়গায়। পানি বাষ্প করার যন্ত্রটা বালু খুঁড়ে বসিয়ে সেটাতে সাগরের পানি ঢাললাম। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা মোটামুটি চলনসই চারা গাছের কাণ্ড ছেঁটে ছিপ বানালাম। এবার একবুক আশা নিয়ে এগোলাম স্বপ্নের মতো সুন্দর লেগুনটার দিকে; রুই কাতলা, থুড়ি, মুলেট আর গোটফিশ ধরতে।

কোমরসমান স্বচ্ছ পানিতে ঝাড়া তিন ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে শরীরের অর্ধেক ভিজিয়ে আর বাকি অর্ধেক রোদে পুড়িয়ে দুটো পুঁচকে মাছ ধরার পর বুঝলাম, মৎস্য শিকার সহজ নয়, অসীম ধৈর্য দরকার। টোপ হিসেবে দিয়েছিলাম ঝিনুকের মাংস। ভাগ্যিস, শামুক–ঝিনুকের অভাব নেই ছোট্ট সৈকতে। মাছ ধরার পরিকল্পনা ঠিকমতো কাজ না করলে ওগুলোকেই খাবারের উৎস হিসেবে বেছে নিতে হবে।

মাছগুলো কেটেকুটে একটা পাত্রে নোনাপানিসমেত চড়িয়ে শুকনা ডালপাতার আগুনে স্যুপের মতো কিছু একটা বানিয়ে খাওয়া সারলাম। ভাগ্যিস, দেশলাইটা ওয়াটারপ্রুফ। লাইফবোটে থাকা অবস্থায় পানিতে ভিজলেও খুব একটা ক্ষতি হয়নি।

শরীরে খানিকটা শক্তি ফিরে এসেছে। জাহাজ, সহযাত্রী, দেশ—এসব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে রেখেছি জোর করে। যে পরিস্থিতিতে আছি, সেটা নিয়ে ভাবা যাক বরং। সবার আগে, দ্বীপটা ভালোমতো ঘুরে দেখি। কাজের কিছু পাওয়া যেতে পারে, আরও ভালো কোনো জায়গাও পাওয়া যেতে পারে তাঁবু খাটানোর জন্য।

সবকিছু দেখতে দেখতে এগোলাম জঙ্গলের ভেতরের দিকে।

দ্বীপের মাঝখানে পাথরের টিলাটার গোড়ায় গিয়ে আবিষ্কার করলাম, এই দ্বীপে আমি একা নই।

টিলাটা খাড়া উঠে যায়নি, এখানে–ওখানে বেরিয়ে আছে পাখির বিষ্ঠায় সাদা হয়ে যাওয়া পাথর। তারই একটার ওপর বসে আছে লোকটা; মাটি থেকে ফুট বিশেক উঁচুতে। আমাকে দেখছে শান্ত চোখে। বোঝা যাচ্ছে, আমার অস্তিত্বের ব্যাপারে আগে থেকেই জানে।

অনেকক্ষণ কোনো কথা ফুটল না আমার মুখে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি লোকটাকে। খালি গা, পরনে একটা হাফপ্যান্ট শুধু। রোদে পোড়া তামাটে একহারা দড়ির মতো শক্ত শরীর, দুই হাতজুড়ে ট্যাটু করা। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা, কালো। চোখের দৃষ্টিতে বোঝা যায়, কঠিন ধাতুতে গড়া লোক। বয়স আমার চেয়ে বছর পাঁচেক বেশি হবে, মানে পঁয়ত্রিশের মতো।

‘হ্যালো,’ বলল লোকটা। কথার টানে বোঝা যাচ্ছে, ইংরেজি তার মাতৃভাষা নয়। কিন্তু লোকটা নিশ্চিত ইউরোপীয়। তাহলে—

আমি তখনো কথা বলতে পারার মতো অবস্থায় আসিনি, তাই জবাব দেওয়া হলো না। সেই বিরতিতে লোকটা অনিশ্চিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘ওলা? কোমো এস্তাস?’

বিকেল হয়ে এসেছে। রাতের খাবার জোগাড়ের জন্য মাছ শিকারে নামলাম এবং আরেকবার বুঝলাম পরিস্থিতি ঠিক কতটা খারাপ। সকালে তা–ও কিছু মাছ পেয়েছিলাম, এবার যে কয়টা ধরতে পারলাম ঘণ্টা তিনেকের মেহনতে, তাতে পেটের সিকিও ভরবে না।

সেই অবস্থায়ও বুঝলাম, আমার দক্ষিণ এশীয় চেহারা দেখে মেক্সিকান বা লাতিন আমেরিকান ভেবে ভুল করেছে লোকটা। আর এটা তার নিজের ভাষাও বটে, স্প্যানিশ। জড়তা ভেঙে বললাম, ইংরেজিতেই, ‘হ্যালো। আমার নাম রূপু। আমি বাংলাদেশি। আপনি?’

‘মিগেল দেলগাদো।’ লোকটার কথায় এমন একটা ভাব, যেন নাম শুনলেই চিনব। একমুহূর্ত থেমে যোগ করল, ‘আমি স্প্যানিশ। পৃথিবীর নানা দুর্গম জায়গায় ঘুরি আর সেগুলো নিয়ে বই লিখি, ভিডিও বানাই। খানিকটা বিখ্যাতও হয়ে উঠেছি এর মধ্যে। একটা স্কুনারে করে বেরিয়েছিলাম সারা দুনিয়া একা চক্কর দেব বলে। খবরে বেরিয়েছে, আপনি হয়তো দেখেননি। আমার ইচ্ছা, পুরো যাত্রা শেষ হওয়ার পর জম্পেশ একটা বই লিখব। অর্ধেক দুনিয়া পেরোনোর পর আপাতত সেই স্কুনার ঝড়ের ঘায়ে সমুদ্রের তলায়। কোনোমতে এই দ্বীপে এসে উঠেছি।’

‘আমি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। আমার জাহাজ ডুবে যাচ্ছিল, কোনোমতে একটা লাইফবোটে করে এসেছি এখানে,’ আমি বললাম। কেন যেন মনে হচ্ছে, লোকটার সঙ্গে বেশি কথা না বলাই ভালো। অথচ দ্বীপে আরেকজনের দেখা পেয়ে কি আমার খুশি হওয়ার কথা নয়?

সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিল না দেলগাদো। শুকনো ঠোঁট জিব বুলিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ‘তোমার একটা বোট আছে, বললে?’

‘আছে, কিন্তু সেটায় করে কত দূর যেতে পারব, তাতে সন্দেহ আছে। নিশ্চিতভাবে কোনো দ্বীপের অবস্থান যদি জানতে পারতাম ধারেকাছে, তাহলে একটা কথা ছিল। তবু কঠিন ব্যপার। প্রচুর খাবারদাবার সঙ্গে না নিয়ে বোটে ওঠা মানে মৃত্যুর দরজায় নিজে থেকে হাজির হওয়া,’ বললাম আমি। একটু বেশিই বোধ হয় বলে ফেললাম। লোকটার উপস্থিতি কেমন অস্বস্তির জন্ম দিচ্ছে মনে।

‘দ্বীপটা বড্ড ছোট, আর খাবারও নেই।’ দেলগাদো ঠান্ডা বাদামি চোখে আমাকে মাপতে মাপতে বলল। ‘আশা করি, আমাদের দুজনকে...কোনো রকম অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে হবে না।’

আরও পড়ুন

‘আমিও তা–ই আশা করি,’ বললাম আমি। বাইরে হয়তো বুঝতে দিচ্ছি না, কিন্তু মাথার ভেতর যে চিন্তার ঝড় চলছে, সেটার গতিবেগ গতকালকের সাইক্লোনের চেয়ে বেশি। এতক্ষণ কথা বললাম, কিন্তু পাথরের টিলা থেকে নামার কোনো লক্ষণ দেখায়নি দেলগাদো। পাশের পাথরের ওপর কী রেখেছে সে ওটা, একটা খাপে পোরা ভোজালি না? ম্যাশেটি বলে যাকে। এ রকম সারভাইভাল পরিস্থিতিতে খুবই কাজে দেয়, আবার কাউকে ঘায়েল করতেও এর জুড়ি নেই।

দেলগাদোর শীতল আচরণ আর ভোজালির চেয়ে যেটা বেশি নাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে, সেটা চোখে পড়েছে চলে আসার সময়। কোনো রকম বিদায় সম্ভাষণ না করেই ঘুরে চলে আসছি, খেয়াল করলাম দেলগাদোর হাফপ্যান্টের পকেট থেকে উঁকি মারছে একটা যন্ত্রের মতো কী যেন, খাটো অ্যান্টেনাসহ। সাগরে সাগরে বেড়াই, ওই জিনিস আমার চেনা। বহনযোগ্য জিপিএস ইউনিট।

তাঁবুতে ফিরে এসে ঘোরের মধ্যে বসে থাকলাম খানিকক্ষণ। জিপিএস আছে দেলগাদোর কাছে। আমার আছে নৌকা। হোক ছোট, হোক কোনো ইঞ্জিন বা পাল বা বইঠা নেই সেটার সঙ্গে। তাঁবু দিয়ে পাল বানানো যাবে, গাছের ডাল কেটে বানানো যাবে বইঠা। দেলগাদোর জিপিএস দেখে সবচেয়ে কাছের অন্য কোনো দ্বীপে চলে যাওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব হওয়ার কথা নয়। তাহলে?

আমাকে দেখেই অমন আচরণ কেন করল দেলগাদো, যেন আমি তার জাতশত্রু?

বিকেল হয়ে এসেছে। রাতের খাবার জোগাড়ের জন্য মাছ শিকারে নামলাম এবং আরেকবার বুঝলাম পরিস্থিতি ঠিক কতটা খারাপ। সকালে তা–ও কিছু মাছ পেয়েছিলাম, এবার যে কয়টা ধরতে পারলাম ঘণ্টা তিনেকের মেহনতে, তাতে পেটের সিকিও ভরবে না। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে মাছ ভেগেছে? নাকি সৈকতের কাছাকাছি কখনোই সহজে মাছ পাওয়া যায় না? জানি না। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের এসব শেখানো হয় না। অথচ আগেকার দিনের নাবিকদের এগুলো না জানলে চলত না, জীবন–মরণের ব্যাপার ছিল এসব জ্ঞান।

আমার জন্যও তা–ই, তিক্তমুখে ভাবলাম আমি কয়েকটা অদ্ভুত চেহারার মাছ বড়শিতে পেয়ে। এগুলো খাওয়া যায়? নাকি খেলে ভেদবমি করতে করতে অক্কা? নাকি খেতেও হবে না, হাত দিয়ে ধরলেই বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হব? নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। আপাতত ঠিক করলাম, বিদ্‌ঘুটে চেহারার কোনো মাছ না ছোঁয়াই ভালো।

মাছগুলো আগের মতো রান্না করে খাওয়া সারলাম সন্ধ্যার পরপর। খাওয়া শেষ, রাত নেমেছে, মাথার ওপর তারার চাঁদোয়া। আমি যে আগুনের সামনে কেন বসে রইলাম অত রাত পর্যন্ত, নিজেই জানি না। নাকি জানি? এত সতর্কতার সত্যি কি দরকার আছে?

পরদিন সকালে মাছ পেলাম আরও কম। একে তো তেল–মসলাহীন অচেনা মাছ খেতে জান বেরিয়ে যাচ্ছে, তার ওপর আবার পরিমাণে ঘাটতি। এ রকম চলতে থাকলে পুরোদমে শামুক–ঝিনুক খাওয়া শুরু করতে হবে।

আরেকটা উপায় আছে। দুপুরের দিকে ভেবে ভেবে বের করলাম। ঝামেলাটা হয়েছে কী, আমার লাইফবোট যেখানে ভিড়েছে, সেই সৈকতেই আমি ঘুরপাক খাচ্ছি। আজ দ্বীপের অন্য কোনো দিকে যাওয়া ভালো। সমস্যা তো নেই, একটা দ্বীপের চারধারেই সৈকত থাকে। অন্য কোনো দিকে ভাগ্য বাজিয়ে দেখা যাক।

দ্বীপের উল্টো দিকে যেতে হলে মাঝখান দিয়ে যাওয়াই সুবিধা। আপনমনে সেদিকে যেতে গিয়ে অবধারিতভাবে এসে পড়লাম দ্বীপের মাঝখানের টিলাটার কাছে।

সবচেয়ে উঁচুতে পা ছড়িয়ে বসে আছে দেলগাদো। কালকের মতোই ভঙ্গি, কালকের মতোই খালি গা, চোখে শীতল দৃষ্টি। আমার সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়েছে, অথচ তার অবস্থানের যেন কোনো নড়চড় হয়নি।

আরও পড়ুন

কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। দেলগাদোই বলতে শুরু করল, চোখে চোখ রেখে, ‘আমার মনে হয়, আমাদের দেখা না হওয়াই ভালো। তুমি দ্বীপের কিনারার দিকটা নাও, চারপাশটা, আমি মাঝখানটা নিচ্ছি। গাছপালা যেখান থেকে শুরু হয়েছে, সেখান থেকে। ভেবে দেখো, তোমার সুবিধা বেশি। পানি থেকে মাছ শিকার করতে পারবে। সমুদ্রের জল থেকে কোনোভাবে মিষ্টি পানি বের করার বন্দোবস্ত থাকলে সেটাও করতে পারবে। শুধু আমার এলাকায় পা দিয়ো না, তাহলেই আমাদের ভেতর কোনো ঝামেলা হবে না। এই দ্বীপ... বুঝতেই পারছ, দুজন মানুষের টিকে থাকার মতো বড় নয়। এলাকা ভাগ না করলে দুজনেরই বিপদ।’

বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে আমার গায়ের জামা। বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই দিগন্ত পর্যন্ত।

‘আমরা কি একে অন্যকে সাহায্য করতে পারি না?’ অবশেষে প্রশ্ন করলাম আমি।

জবাব নেই।

‘তোমার জিপিএস, আমার লাইফবোট। আশপাশের কোনো ভালো দ্বীপে চলে যাওয়া যায় না? খাবার পাব, সভ্য জগতেও ফেরা যাবে।’ প্রস্তাব দিলাম আমি।

‘প্রচুর খাবার ছাড়া বোটে ওঠা যাবে না, সেটা তুমিও জানো, আমিও জানি। দুজনের খাওয়ার মতো খাবার আমাদের নেই...এখনো।’ বলল দেলগাদো। খেয়াল করলাম, রোদে পুড়ে আরও ট্যান হয়েছে তার চামড়া। চোখের কোণে কালি।

‘আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাই না।’ সোজাসাপটা গলায় বললাম আমি। ‘আমরা মিলেমিশে...’

‘মিথ্যে কথা!’ খেঁকিয়ে উঠল দেলগাদো। ‘আমি তোমার চেয়ে বেশি দেখেছি দুনিয়াটা, রূপু। খিদে, তেষ্টা আর বাঁচার আকুতি মানুষকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায়, সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। কিন্তু আমি নিজ চোখে দেখেছি সেটা। মৌরিতানিয়ায় যখন আমাদের দলের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল সাহারা মরুভূমির মাঝখানে, যখন একে একে মরতে শুরু করল সবাই, তখন একঢোঁক পানির দখল নেওয়ার জন্য এক বন্ধু আরেক বন্ধুর গলা টিপছে, এই দৃশ্য দেখেছি আমি। এভারেস্টে চড়ার সময় অসুস্থ সঙ্গীকে পথের পাশে ফেলে রেখে এগিয়ে গেছি আমি নিজেই!’ থেমে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল দেলগাদো। ‘আমি চাই না এমন কিছু হোক। আজ তুমি বন্ধুত্বের কথা বলছ, খাবারে টান পড়লে কালই আমার মাথায় বাড়ি মারতে চাইবে। তার চেয়ে ভালো, এলাকা আলাদা করে ফেলা।’

‘এখানে তুমি কী খাবে? সাগরের তীরে বরং মাছটাছ ধরতে পারবে,’ বললাম আমি।

‘আমার খাবারের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না,’ ক্লান্ত গলায় বলল দেলগাদো। ‘পানিও খানিকটা আছে পাথরের খাঁজে...বাদ দাও। ভাগ্য যদি ভালো হয় আমাদের, কোনো রেসকিউ প্লেন বা জাহাজ চলে আসবে। আর না এলে...’

কথা শেষ করল না দেলগাদো। আমিও শোনার অপেক্ষায় রইলাম না। ঘুরে চলে এলাম ‘নিজের এলাকায়’, সৈকতে। হেঁটে খানিকটা দূরে গিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করতে লাগলাম।

মাথা কাজ করছে না। মনের ভেতর একটা অংশ বলছে, দেলগাদোর স্রেফ পাগলামি এসব। আবার আরেকটা অংশ বলছে, দেলগাদো আমার চেয়ে দুনিয়া দেখেছে অনেক বেশি। ভেবেচিন্তেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।

দেলগাদো অমনভাবে পাথরের ওপর বসে আছে কেন, তা বুঝতে পারছি এখন। ওটাই তার কাছে কৌশলগত নিরাপদ অবস্থান। আমাকে সরাসরি শত্রু ভাবছে সে। আমারও কি তা–ই ভাবা উচিত?

মাছ পাচ্ছি না এখানেও। রোদে চড়চড় করছে সারা গা। দুটো হাস্যকর রকমের ছোট মাছ ধরার পর কয়েকটা ঝিনুক নিয়ে উঠে এলাম। আপাতত এগুলো খেয়েই থাকতে হবে। সন্ধ্যায় আবার নামতে হবে রাতের খাবারের খোঁজে।

দুটো দিন কেটে গেল। মাছ ধরায় কোনো আহামরি সাফল্য পাচ্ছি না, আবার কমছেও না। কয়েকটা মাছ, কয়েকটা ঝিনুক আর পানি খেয়ে জীবনধারণ। অবসর সময়টা কাটাই তাঁবুর ছায়ায় বসে দিগন্তে পানির ঝিলিমিলির দিকে তাকিয়ে।

কোনো জাহাজের ছায়া পড়ে না সেখানে। আকাশেও দেখি না কোনো উড়োজাহাজের অবয়ব।

আরও তিনটা দিন কেটে গেল। বোটের ইমার্জেন্সি টুলকিটে পাওয়া জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখি মাঝেমধ্যে। ঠিকঠাক সারভাইভাল ট্রেনিং থাকলে মনে হয় অনেক কিছু করে ফেলতে পারতাম এসব দিয়ে! হয়তো দেলগাদো পারবে। কিন্তু আমি ভয় পাই দেলগাদোকে, আর সে আমাকে।

ইদানীং রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে না। বারবার চমকে জেগে উঠে তাঁবু সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে কি না। স্বপ্নে দেখি, দেলগাদোর ভোজালি ধরা হাত উঠে যাচ্ছে আকাশে, তারপর নামছে বিদ্যুৎবেগে। তারপর আমার লাইফবোট চুরি করে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে দেলগাদো। ঘেমেনেয়ে জেগে উঠি ধড়মড় করে।

স্বপ্নটা পুরোপুরি অমূলক মনে হয় না। গতকাল রাতে আগুন নেভাতে যাব, হঠাৎ কী ভেবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম গাছপালার সীমানার দিকে। গাছের আড়ালে ওটা কী দেখলাম? একটা মানুষের ছায়া দাঁড়িয়ে আছে... খালি গা... হাফপ্যান্ট পরনে... হাতে লম্বা ওটা কী? চোখ পিটপিট করে আবার তাকালাম, চোখে পড়ল না কিছু। সত্যি দেখেছি, না চোখের ভুল?

আরও পড়ুন

দেলগাদো আমার ওপর নজর রাখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমিও নজর রাখছি তার ওপর। গত পরশু ঘোর সন্ধ্যায় পা টিপে টিপে গাছপালার আড়ালে-আড়ালে চলে গিয়েছিলাম দ্বীপের অনেকটা ভেতরে। তেরছা একটা দিক ধরে গিয়েছিলাম। দেখেছি, টিলার ওপরে ঠিক আগের মতোই বসে আছে মিগেল দেলগাদো। না, একটু ভুল হলো। ঠিক আগের মতো নয়। পিঠটা যেন একটু কুঁজো হয়ে গেছে, একটা বোতল খুলে যখন পানি খাওয়ার চেষ্টা করল, ছিপি খুলতে যেন অস্বাভাবিক বেশি সময় লাগল তার। বোতলের তলার দুই আঙুল পানি খেয়ে আবার একদিকে হেলে পড়ল দেলগাদো। বোঝাই যাচ্ছে, দুর্বল হয়ে পড়ছে সে।

আমিও কি ঠিক আছি? হাঁটার জোর পাই না। মাছ ধরতে গিয়ে এক ঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না কোমরপানিতে। আজ কেবল একটা মাঝারি আকারের মাছ পেয়েছি, বাকি খাবারের জোগাড় করতে হয়েছে একটা ছোট কাঁকড়া আর ঝিনুক দিয়ে।

আজ আবার মেঘ করেছে। দমকা হাওয়াও বইছে থেমে থেমে। লাইফবোটটা একটা খুঁটিতে বেঁধে রেখেছি, বেশ দুলছে ওটা। একটা সাইক্লোন হয়ে যাওয়ার কত দিন পর আরেকটা আসে? আবার একটা হবে নাকি?

পরিষ্কার বুঝতে পারছি, বাইরের সাহায্য আসার সম্ভাবনা খুব কম। বোটটা নিয়ে রওনা দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হতো, যথেষ্ট শক্তি শরীরে অবশিষ্ট থাকতে। কিন্তু বোটে বেশ অনেকটা খাবার আর পানি বোঝাই করতে হবে আগে। আর লাগবে একটা পাল, একটা হাল আর একটা বইঠা। তার চেয়ে বেশি দরকার: মানচিত্রের জ্ঞান। জানতে হবে, সবচেয়ে কাছের কোন দ্বীপে গেলে সাহায্য পাওয়া যাবে, আর সে দ্বীপ কত দূরে। দেলগাদোর জিপিএসে আছে সে তথ্য। কিন্তু দেলগাদো সাহায্য করবে না আমাকে, আর সেটার কারণটাও বেশ পরিষ্কার। দুজন লোকের বেশ কয়েক দিন চলার মতো খাবার আর পানি পাব কোথায়? ওসব ছাড়া বোটে ওঠা মানে খোলা আকাশের নিচে ক্ষুধা–তেষ্টায় ধুঁকে ধুঁকে শেষ হওয়া।

ছিপ আর বড়শি নিয়ে কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম এসব। ফাতনায় বেমক্কা টান পড়তে বাস্তবে ফিরলাম। পরমুহূর্তেই শুরু হয়ে গেল রশি টানাটানির খেলা। বোঝা যাচ্ছে, বেশ বড়সড় একটা মাছ পড়েছে বড়শিতে।

মিনিট বিশেকের চেষ্টায় মাছটা ডাঙায় তুলতে পারলাম যখন, আমার হাসি দুকান ছুঁয়েছে। প্রায় আড়াই ফুট লম্বা একটা ধুমসো মাছ, ওজন কমসে কম আট–নয় কেজি তো হবেই। ধূসর রং, বিরাট মাথা আর মুখ। নিরীহ এই মাছ খেতেও দারুণ হবে, সন্দেহ নেই। আর বিষের ভয়? এমন সাদামাটা চেহারার মাছ বিষাক্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

মাছটা কেটেকুটে নিয়ে বেশ কয়েকটা টুকরো করলাম। মাথাটা দিয়ে বানাব স্যুপ, আর বাকি খানিকটা এখন সেদ্ধ করে খাব, আর খানিকটা ধোঁয়ায় শুকিয়ে জমিয়ে রাখব পরে খাওয়ার জন্য।

খাওয়াটা হলো জম্পেশ।

একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলাম খাওয়ার পর। চোখ লেগে আসছিল, এমন সময় খেয়াল করলাম সমুদ্রটা দুলতে শুরু করেছে। টেবিল নড়ালে গ্লাসের পানি যেমন এদিক–ওদিক দোলে, তেমনি করছে সাগরের নীল পানি।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। তখনই বুঝলাম, সাগর নয়, দুলছে আমার মাথা। সামলানোর সময় পেলাম না, দমকে দমকে বমিতে ভাসিয়ে দিলাম চারপাশ।

কাঁপা হাতে খানিকটা পানি খাওয়ার পরে ভেবেছিলাম, বমির ভাবটা কেটে গেছে। খালি পেটে বেশি খাওয়ার জন্য হয়েছে এমনটা, ধরেই নিয়েছি। পরের দফা বমি শুরু হলো ঠিক তখনই।

বমিটা যে স্বাভাবিক নয়, সেটা বুঝলাম দুটো কারণে। প্রথম কারণ, বমি থামছেই না। দ্বিতীয় কারণ, হাত–পায়ে জোর পাচ্ছি না একদমই। বমির জন্য হচ্ছে না এমনটা, পেট খারাপ হলে এ রকম গা ঝিম ঝিম করে অবশ হয়ে আসতে শুরু করে না পুরো শরীর।

ব্যাখ্যা একটাই। মাছটা খেয়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি আমি।

তাঁবুর ভেতর অর্ধেক শরীর আর রোদে অর্ধেকটা রেখে পড়ে আছি আমি, নড়ার ক্ষমতা নেই। একটু আগে পর্যন্ত পানি খেতে পারছিলাম, এখন সেটাও আর সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন

এ–ই ছিল কপালে! মনে মনে হাসছি আমি, তেতো হাসি। জাহাজডুবি থেকে বাঁচলাম, বিষাক্ত মাছ খেয়ে মরার জন্য? তবে তা–ই হোক। দেলগাদো, তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী আর অবশিষ্ট রইল না। দ্বীপের সব ‘সম্পদ’ এখন তোমার। আমি টেঁসে গেছি, এটা টের পাওয়ার পর বোটটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে আর কোনো বাধা নেই তোমার।

মুখের ওপর একটা ছায়া পড়ল। কোনোমতে চোখের পাতা খুললাম। অভিযাত্রিক দেলগাদো ছাড়া আর কে! পাথরের মতো ভাবলেশহীন চোখে দেখছে আমাকে। বলতে চাইলাম, কষ্ট করে মারতে হবে না আমাকে, নিজেই মরছি। কিন্তু ততক্ষণে আরেক দিকে সরে গেছে দেলগাদো। আমার শেষ সম্বল থালা-বাটি-কম্বল নেড়েচেড়ে দেখছে বোধ হয়, কোনগুলো মেরে দেবে। যা ইচ্ছা নিক, আমার তো আর দরকার পড়বে না সেগুলো।

আবার আমার কাছে ফেরত এসেছে দেলগাদো। হাতে লম্বা কী যেন। ভোজালিটা নাকি?

‘মাছটা কতক্ষণ আগে খেয়েছ?’ নিশ্চয়ই মাছের অবশিষ্টাংশ চোখে পড়েছে তার। কিন্তু এই তুচ্ছ প্রশ্ন জানার জন্য এত আগ্রহ কেন? আবার করল প্রশ্নটা। আমি কোনোমতে ঘড়ঘড়ে গলায় বলতে পারলাম, ‘ঘ-ঘণ্টাখানেক...’

আবার সরে গেল দেলগাদো। হতেও পারে, এই দেখা শেষ দেখা। এবার বোধ হয় আমার জিনিসগুলো বাঁধাছাঁদা করে বোটে উঠে চম্পট দেবে।

আমাকে অবাক করে দিয়ে মিনিটখানেকের মধ্যে ফিরে এল দেলগাদো। আমাকে টেনে তুলে হেলান দেওয়াল একটা পাথরের গায়ে। মুখের কাছে তুলে ধরল কী যেন। দেখলাম, কুচকুচে কালো দুটো বড়ি। বিষ? সে তো ইতিমধ্যেই খেয়ে ফেলেছি।

‘অ্যাকটিভেটেড চারকোল ট্যাবলেট,’ দেলগাদো বলল। ‘তোমারই টুলবক্সে ছিল। খেয়ে নাও। বিষক্রিয়া পুরোপুরি দূর না করলেও অনেকটা কমাতে পারবে।’

খানিকটা পানি আর ট্যাবলেট দুটো আমার মুখে তুলে দিল দেলগাদো। বলছে, ‘সিগুয়াটেরা পয়জনিং। একটা সামুদ্রিক গুল্ম খাওয়ার কারণে গ্রুপার মাছের মধ্যে এই বিষক্রিয়া তৈরি হয়। ভাগ্য ভালো হলে এ যাত্রা বেঁচে যাবে।’

মিনিট পনেরোর মধ্যে চারকোল ট্যাবলেটের কাজ শুরু হলো। খানিকটা শক্তি ফিরে পেয়েই করলাম অবধারিত প্রশ্নটা, ‘আমাকে মরে যেতে দিলে না কেন?’

‘তোমাকে বাঁচালে আমার লাভ বেশি। নৌকায় হাল ধরে থাকার জন্য একজন দরকার। আমি পাল ধরে থাকতে ব্যস্ত থাকব। আর তা ছাড়া আমি খুনি নই। দুটো ট্যাবলেট খাওয়ালে যদি কারও জীবন বাঁচে, সেটা করব না কেন?’ দেলগাদো আমাকে আরেকটু পানি খাওয়াতে খাওয়াতে বলল।

‘লাইফবোটে কোনো হাল থাকে না।’ আধা অবশ হাতে মুখ মুছে বললাম আমি।

‘থাকে, যদি সেটা বানিয়ে নেওয়া যায়।’ পাশে পড়ে থাকা লম্বা জিনিসটা তুলে দেখাল দেলগাদো। এটাই তখন তার হাতে ছিল। কাঠ কেটে বানানো একটা এবড়োখেবড়ো হাল। দেখতে যেমনই হোক, কাজ চলে যাবে।

‘তোমার তাঁবু কেটে বানাব পাল। আর হালটা ধরে থাকবে তুমি।’ দেলগাদো বলল।

তা–ই করলাম, তিন দিন পর আমি মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর যখন সমুদ্রে লাইফবোটটা ভাসালাম আমরা। এখনো দুর্বল আমি হেলান দিয়ে বসে ধরে আছি হালটা, আর দেখছি পালের দড়ি ধরে পিঠ সোজা করে পা ছড়িয়ে বসে আছে দেলগাদো। চোখ সামনে। হাতে জিপিএস। দেড় শ নটিক্যাল মাইল দূরে রয়েছে সবচেয়ে কাছের দ্বীপটা, সেটা যেন মিস না হয়ে যায় কোনোভাবে।

খিদে পেয়েছে আমার। হাতের কাছের একটা ব্যাগে রয়েছে রোদে শুকানো প্রচুর পাখির মাংস, সেটার খানিকটা বের করে খেতে শুরু করলাম।

সবই দেলগাদোর সংগ্রহ। সাগরের মাঝখানে দ্বীপ দেখলেই সেটার সবচেয়ে উঁচু জায়গায় এসে বসার চেষ্টা করে সামুদ্রিক পাখিরা। তখন সেগুলোকে শিকার করা কঠিন নয় দক্ষ কারও জন্য।

তোমরা কী ভেবেছিলে, এমনি এমনি পাথরের টিলাটার ওপর বসে থাকত দেলগাদো?

আরও পড়ুন