র্যাচেল কে জোনসের সাইফাই গল্প—বলয়বন্দী
প্রতি দশ বছর অন্তর টার্টারাস গ্রহের বলয় ভেদ করে ছুটে আসে একটা স্পেস-শাটল। টাইটানিয়ামের রুপালি নাকওয়ালা এই মহাকাশযানে কার্গো হিসেবে থাকে নতুন বন্দীদের একটা দল। তাদের গন্তব্য অর্ফিয়াস ফ্যাক্টরি। টার্টারাস গ্রহের বলয়ের চারপাশে ঘুরতে থাকা ভাসমান বস্তুগুলোর স্তর এতটাই ঘন যে সেগুলো ক্রমাগত শাটলের গায়ে আঘাত করতে থাকে। টিনের চালে শিলাবৃষ্টি পড়ার মতো প্রচণ্ড সেই শব্দ-গর্জনে শাটলের বন্দী যাত্রীদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়। তারা চোখ-মুখ শক্ত করে পাইলটকে অনুরোধ করে, সে যেন আরেকটু সাবধানে চালায়। তবে তাতে কোনো কাজ হয় না। তাদের কণ্ঠ হারিয়ে যায় সেই শব্দ-গর্জনের ভেতরে। কখনো কখনো কোনো বন্দী সহ্য না করতে পেরে ঝাঁজালো কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘সব কটার সঙ্গেই গুঁতা লাগাতে চাইছেন নাকি?’
জবাবে পাইলট নাক দিয়ে ঘোঁত ঘোঁতজাতীয় বিচিত্র শব্দ করে। তারপর বাঁকা হাসি হেসে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, ‘হ্যাঁ! ঠিক সেটাই করছি। আমরা সব সময় তা-ই করি। যতটা সম্ভব হয় আরকি! আর এটা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। বিশ্বাস করতে পারো আমার কথা।’
নতুন বন্দীরা তার কথা বিশ্বাস করে না। তবে তাতে তার কিছু যায়–আসে না। সে ইচ্ছা করেই আরও ঘন ভাসমান বস্তুগুলোর দিকে শাটলের নাক ঘুরিয়ে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে শিলাবৃষ্টির গর্জন যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
***
গ্রহের মাটিতে নামার পর বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হয় মার্বেল পাথর দিয়ে গড়া জরাজীর্ণ এক প্রাসাদে। কালের প্রবাহে ক্ষয়ে যাওয়া এই প্রাসাদের নাম সিবিলাইন কোর্ট। এখানেই অনুষ্ঠিত হয় বন্দীদের বিচারকার্য। আসলে বিচারের নামে চলে প্রহসন। সিবিলাইনদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ যাদের মাথার ওপর পড়ে, তাদের কোনো কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয় না। সিবিলাইনে বিদ্রোহের শাস্তি একটাই, আর সেটা হলো, চিরন্তন জীবন।
বিচার শুরুর আগে বন্দীদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। কমিউনিকেশন সিস্টেমে একে একে তাদের নাম ঘোষণা করা হয়। ঘূর্ণায়মান দশ বাহুবিশিষ্ট এক রোবট বিচারক পালা করে সবার অপরাধ ও রায় পড়ে শোনায়। দশকের পর দশক ধরে চলে আসা এই প্রথার কোনো ব্যতিক্রম হয় না। সিবিলাইন সাম্রাজ্য এসব আনুষ্ঠানিকতাকে খুবই গুরুত্ব দেয়।
শাস্তি ঘোষণা হয়ে গেলে বন্দীদের একজন একজন করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় অন্ধকার চতুষ্কোণ এক প্রবেশপথে। মাটির বুক চিরে বানানো এই বর্গাকৃতির সেই গহ্বরকেই বলা হয় অর্ফিয়াস ফ্যাক্টরি। অর্ফিয়াস ফ্যাক্টরির ভেতরে ঢুকতেই বহু বাহুবিশিষ্ট স্বয়ংক্রিয় এক যন্ত্র বন্দীদের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। তারপর সারা শরীরে মেখে দেয় অ্যাম্বার রঙের জীবাণুনাশক। কাঁচা টারের মতো গন্ধযুক্ত এই জীবাণুনাশক ত্বকে ভীষণ জ্বালা ধরায়, সেই সঙ্গে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব চুল আর লোম ঝরে পড়ে যায়। তারপর সরু রুপালিরঙা অসংখ্য সুচ সাপের মতো কিলবিল করে শিরার মধ্যে ঢুকে পড়ে। অতি ক্ষুদ্র ন্যানোবট রক্তে মিশে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। ন্যানোবটগুলো শরীরে জমে থাকা অপদ্রব্য পরিষ্কার করে, টেলোমিয়ার লম্বা করে, ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুকোষ মেরামত করে। সব শেষে তাদের দেওয়া হয় একটি ইনজেকশন। বিশেষ এই ইনজেকশন তাদের নড়াচড়া করার সব ক্ষমতা কেড়ে নেয়, তাদের চোখ ছাড়া কিছুই আর সাড়া দেয় না। এই চূড়ান্ত ধাপের ঠিক আগমুহূর্তে তারা সবাই হঠাৎ করে তরতাজা অনুভব করে, যেন আবার তরুণ হয়ে উঠেছে তারা।
টার্টারাস তার নতুন আগন্তুকদের শেষ যে উপহার দেয়, সেটা হলো ঝকঝকে সাদা একটা স্পেসস্যুট। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি, সৌরশক্তিচালিত অতি উন্নত মানের এই স্পেসস্যুট শ্বাসপ্রশ্বাসের বাতাস আর শরীরের বর্জ্য চক্রাকারে পুনর্ব্যবহার করতে পারে টানা দুই শ বছর ধরে। যদি না কোনো দুর্ঘটনায় স্যুটের আবরণ কোথাও ফেটে যায়। সবশেষে পুষ্টিকর তরল সরবরাহ আর বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য বন্দীদের দেহে বিভিন্ন নল প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়।
এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষ হলে অর্ফিয়াসদের একে একে বাইরে এনে মাটির ওপর গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হয়। অন্ধকার আকাশের নিচে তাদের হেলমেটের কাচের আড়ালে আতঙ্কে কাঁপতে থাকা চোখগুলো জ্বলজ্বল করে। দেহ আর মনের ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না তাদের। ঠোঁট বেঁকে যাওয়ায় মনে হয় যেন অস্বস্তিকর এক হাসি জমে আছে সেখানে।
সব কাজ শেষ হলে যে পাইলট তাদের নিয়ে এসেছিল, সে-ই আবার তাদের তুলে নেয়। স্পেস–শাটলের কার্গো রাখার জায়গায় দেহগুলোকে একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে রাখে সে, যেন জ্বালানি কাঠ গাদা করছে।
ফিরতি পথে টার্টারাস গ্রহের বলয় পেরোনোর সময় স্পেস-শাটলের কার্গো হোল্ড থেকে নতুন অর্ফিয়াসদের ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয় সেই বিশাল বলয়ের ভেতরে। ঠিক সেই মুহূর্তেই তারা প্রথমবারের মতো দেখতে পায়, গ্রহের বলয়ের চারপাশে ঘুরতে থাকা ঘন বস্তুগুলো আসলে অন্য কিছু নয়, ঝকঝকে সাদা স্পেসস্যুটের অন্তহীন সারি! যেমনটা তারা পরে আছে, ঠিক তেমনটাই। টার্টারাসের কক্ষপথকে ঘিরে ঘুরছে হাজার হাজার, লাখ লাখ সাদা স্পেসস্যুট! এক অন্তহীন শোকগীতির মতো। প্রতিটি স্পেসস্যুটের হেলমেটের কাচের আড়ালে অসহায়ভাবে টিমটিম করছে এক জোড়া খোলা, সচেতন চোখ। তাদের দেহগুলো অবিরাম ঘুরে চলছে গ্রহটাকে ঘিরে। তাদের রক্তে মিশে থাকা যন্ত্রগুলো তাদের মরতে দেয় না।
এভাবেই তারা ভেসে থাকবে অনন্তকাল, কিন্তু একমুহূর্তও ঘুমাতে পারবে না। তারা মনে মনে প্রার্থনা করবে, কোনো পথভ্রষ্ট গ্রহাণু এসে তাদের গায়ে আঘাত করবে আর স্যুটে ফাটল ধরাবে। মুক্তি দেবে এই অভিশপ্ত অনন্ত জীবন থেকে। দশ বছর পর তারা যখন রুপালি নাকওয়ালা শাটলটাকে আবার টার্টারাসের দিকে এগিয়ে আসতে দেখবে, তারা কামনা করবে, মহাকাশযানটা কক্ষপথে ঢোকার সময় যেন তাদের দেহে ধাক্কা মেরে তারপর গ্রহপৃষ্ঠে নেমে যায়।
আর পাইলটরা সত্যি সত্যিই সেই চেষ্টাই করে। যতজনকে সম্ভব আরকি!