ডিউক জনের রহস্য গল্প—হাওর

অলংকরণ: তনি সুভংকর

বইঠা দিয়ে পাড় থেকে নৌকাটা ঠেলে দিল কান্তা। প্রথমে দুলে উঠল নৌকা, তারপর কচুরিপানার দঙ্গল পেরিয়ে এগিয়ে চলল ওটা হাওরের স্বচ্ছ পানির দিকে।

গায়ে চাদর থাকা সত্ত্বেও ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁটা দিচ্ছে ওর খোলা ত্বকে।

রাতচরা পাখিদের কান্নার শব্দ ভেসে আসছে পেছনের জংলা থেকে। কিন্তু যতই এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা, ততই ক্ষীণ হয়ে আসছে সে আওয়াজ। চাঁদটা পুরোপুরি পূর্ণ নয়, তবে এতটাই উজ্জ্বল যে জলের ওপর বইঠার টানে ছোট ছোট ঢেউয়ের বুকেও প্রতিফলিত হচ্ছে রুপালি আলো।

দূরের কুটিরের আলোগুলো যখন পরিণত হলো ঝাপসা বিন্দুতে, দাঁড়টা নৌকায় তুলে নিল কান্তা। মৃদু ঢেউয়ের কারণে দুলছে জলযানটা, ধীরে ধীরে স্থির হয়ে এল।

আয়নার মতো থির হয়ে আছে হাওরের পানি।

বহু বছর পর নির্জন এই এলাকায় ফিরে এসেছে কান্তা। শহরের ধোঁয়া আর কোলাহলে অভ্যস্ত ওর কাছে ছোটবেলায় পড়া রূপকথার গল্পের মতো মনে হচ্ছে পরিবেশটা।

কোলের ওপর দুই হাত গুঁজে চোখ বন্ধ করল কান্তা, গুনগুন করছে অনেক প্রিয় একটা গানের সুর। পুরোনো স্মৃতির ভিড় ওর মনে। যতবারই হাওরে আসত, ততবারই গানটা গাইত ওরা—ও, ঝরনা, মিতা আর লিপি। খিলখিল করে হাসতে হাসতে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিত একে অন্যকে।

কত দিন হয়ে গেল দেখে না ওদের!

শুনেছে, লোকজন নাকি আর আসে না এখানে। জং ধরা একটা সতর্কবার্তার সাইনবোর্ড চোখে পড়েছিল পথের ধারে। ওতে লেখা: ‘বিপজ্জনক! সাঁতার কাটা নিষেধ’।

কান্তাকে দমাতে পারেনি ওই সাবধানবাণী। রাতের খোলা আকাশের নিচে ক্যাম্প করার অভিজ্ঞতা নেই যাদের, তাদের কথায় কখনো পিছপা হবে না ও। এখানেই কেটেছে ওর শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতিময় দিনগুলো।

স্রোত আর বাতাসের কারণে মন্থর গতিতে ভেসে চলেছে নৌকা। বহুদূরের জঙ্গল থেকে আসা আওয়াজগুলো আর একদমই শোনা যাচ্ছে না এখন।

আরও পড়ুন

আচানক কিসে যেন আঁচড় দিল নৌকার নিচে! বোঝা যায় কি যায় না। চোখ খুলে এদিক-ওদিক চাইল কান্তা। কই, কোনো অস্বাভাবিকতা নেই তো পানিতে!

ছোটখাটো কোনো মাছটাছ হবে হয়তো।

শরীর শিথিল করে বসল ও। ঠান্ডাটা সয়ে গেছে অনেকটাই।

আবার আঁচড়াচ্ছে ওটা! এবার একটু দীর্ঘস্থায়ী আর জোরালো আঁচড়।

ঝটিতি নৌকার আশপাশে আবার দৃষ্টি চালাল কান্তা।

উঁহু, মাছ নয় এটা! অন্য কিছু!

জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে পেছনে তাকাল মেয়েটা। একাই এখানে এসেছে ও, আর কোনো পর্যটক নেই। লোকে দূরে থাকে এই হাওর থেকে!

আবার শুরু হলো অস্বস্তিকর আঁচড়ানি! সিরিশ কাগজের ঘর্ষণের মতো কর্কশ একটা আওয়াজ যোগ হয়েছে এর সঙ্গে। নৌকার তলার তক্তা ধরে টানছে বুঝি কেউ!

শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়ে এল কান্তার। ঠান্ডার মধ্যেও ঘাম ফুটেছে শরীরে।

সন্তর্পণে হাত বাড়াল ও বইঠার দিকে। তারপরও দাঁড়ের এক মাথা ঠুকে গেল নৌকার গায়ে।

জায়গায় জমে গেল কান্তা। বুকের খাঁচায় লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। শক্ত করে বইঠা ধরে রাখায় সাদা দেখাচ্ছে আঙুলের গাঁটগুলো।

নিস্তব্ধতা।

তবে সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্য। জোর এক ধাক্কায় ভয়ংকর রকম দুলে উঠল নৌকা! ছিটকে এক পাশে কাত হয়ে পড়ে গেল কান্তা।

পানিতে বইঠা ফেলে টানল ও প্রাণপণে। কিন্তু দুবারের বেশি টানতে পারল না। তার আগেই বইঠা আটকে দিল কিছু একটা!

দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড় ছাড়ানোর চেষ্টা করল কান্তা, পারলও তুলতে কিছুটা, পরক্ষণেই টান দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হলো বইঠাটা, ছুড়ে ফেলা হলো দূরের পানিতে!

দাঁড়বিহীন কান্তা এখন গভীর হাওরের মাঝে বন্দী!

ইতিউতি তাকাচ্ছে ও, কালো পানির বুকে খুঁজে বেড়াচ্ছে জীবটাকে।

ওই তো ওটা!

আলোড়ন উঠল বাঁ দিকের পানিতে। উঠেই আবার নিস্তব্ধ সবকিছু। প্রলম্বিত, কর্কশ আওয়াজটা টের পাওয়া গেল এবার নৌকার এক পাশ থেকে আরেক পাশে। খলবল করে উঠল আয়নার মতো জলসমতল।

আরও পড়ুন

কান দুটো চেপে ধরল কান্তা। চোখ বুজে ফেলে অস্বীকার করতে চাইছে সমস্ত কিছু। কিন্তু এখন চোখ বন্ধ মানেই তো মৃত্যু!

রীতিমতো কাঁপুনি উঠে গেছে কান্তার শরীরে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সাদা ধোঁয়ার মতো বাষ্প বেরোচ্ছে ওর নাক-মুখ থেকে। বুকের মধ্যে যেন দামামা পেটাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। অথচ চারপাশ এখন এতটাই শান্ত-সমাহিত যে কল্পনা বলে মনে হচ্ছে একটু আগের ঘটনাটা।

আচমকা বেমক্কা আরেকটা ধাক্কা লাগাল অদৃশ্য আগন্তুক। দাঁড়িয়ে থাকলে পানিতেই পড়ে যেত হয়তো কান্তা। ঘোঁত করে উঠল সে নৌকার পাশে বাড়ি খেয়ে। জলের ওপর ভাসমান পাতার মতো ঘুরতে আরম্ভ করল নৌকাটা।

এবার আঘাত এল আরেক দিক থেকে, যেটা উল্টো দিকে পাঠিয়ে দিল কান্তাকে। ভারসাম্য রাখার জন্য সর্বশক্তিতে নৌকার কাঠ চেপে ধরল ও। কালো কালির মতো হাওরের জলে ছিটকে পড়লে কী হবে, ভাবতেও চায় না।

অকস্মাৎ থেমে গেল নৌকার ঘূর্ণন। আর তারপরই অমোঘ নিয়তির মতো পানি থেকে উঠে এল ওটা নৌকায়!

জল ঝরছে প্রাণীটির কদাকার শরীর থেকে। ধকধক করা ধূসর চামড়া ভেদ করে এলোমেলোভাবে বেরিয়ে থাকা অজস্র চোখ দিয়ে দেখছে ওকে পানির পিশাচ!

আরও পড়ুন

কান্তা জানে, পলকহীন চোখগুলোর মধ্যে এক জোড়া ওর বান্ধবী ঝরনার!

এক জোড়া মিতার!

এক জোড়া লিপির!

বাকিগুলো কাদের, কে জানে!

দুঃসাহসের নমুনা দেখাতে গিয়ে সেই রাতে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল ওরা। হাওরে ভাসতে ভাসতে জোছনাবিলাসের খায়েশ হয়েছিল চার বান্ধবীর। তীর থেকে অনেকটা দূরে সরতেই লিপির হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হলো বইঠাটা! বিভ্রান্ত মেয়েটি নৌকার পাশ দিয়ে ঝুঁকতেই টান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ওকে জলের তলায়!

উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল মিতা, নিজেই তাল হারিয়ে পড়ে যায় নৌকা থেকে। পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করছিল কান্তা আর ঝরনা, চোখসর্বস্ব অনাসৃষ্টিটা যখন উঠে আসে পানি থেকে!

আজও জানে না কান্তা, সে রাতে কেন শুধু ওকে ছেড়ে দিয়েছিল প্রাণীটা।

নৌকা থেকে বল্লমটা তুলে নিল ও। বহুদিন ধরে ব্যবহার শিখছে এটার; শুধু আজকের দিনটার জন্যই!

এক কদম সামনে বাড়ল কান্তা। ওর মনে কেবল একটা শব্দই অনুরণিত হচ্ছে এখন—বদলা!

আরও পড়ুন