ডিউক জনের গল্প 'কবর'

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

খুব জোরে গাড়ির ব্রেক কষল রাফি, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে! পিচঢালা সড়কে কালো দাগ ফেলে চেঁচিয়ে উঠল চাকাগুলো, সেই সঙ্গে ‘থ্যাপ’ করে একটা চাপা শব্দ। তীব্র কাঁপুনি উঠল গাড়ি আর রাফির সারা শরীরজুড়ে।

পরের কয়েকটা মুহূর্ত শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার সাহস হলো না ওর। এরপর একটা গালি ঝেড়ে ঝড়াং করে খুলে ফেলল গাড়ির দরজা।

হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো রাতের অন্ধকার চিরে সোনালি রেখা বিছিয়ে দিয়েছে রাস্তার ওপর। কুকুরটাকে যেখানে দেখেছিল রাফি, সেখান থেকেই শুরু হয়েছে টায়ারের দাগ, শেষ হয়েছে তিন ফুট ব্যাসের একটা বৃত্ত তৈরি করে।

অ্যাকসিডেন্টের ফলাফল দেখার জন্য গাড়ির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল রাফি। রক্তে ভেজা একতাল রোমশ মাংসপিণ্ড হয়ে পড়ে আছে এখন চারপেয়েটা, কুকুর বলে চেনার জো নেই আর। বেঁচে যে নেই, বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তাতে।

সম্ভবত ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই মরে গেছে ওটা, ভাবল রাফি। মুখখানা বিকৃত করে হাতড়ে দেখল ও কুকুরটার গলায়। নাহ, কোনো কলারটলার পাওয়া গেল না।

বেওয়ারিশ তাহলে? হাড়বহুল শরীরটাও সেদিকেই নির্দেশ করছে।

তবে নাকটা দেখে মনে হচ্ছে, একসময় পোষা ছিল কারও। হয়তো হারিয়ে গিয়েছিল। কাছেপিঠে বাড়িঘর নেই কোনো, অন্তত গত বিশ মিনিটের রাস্তায় চোখে পড়েনি একটাও।

আরেকবার গাল দিয়ে উঠে গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে ফেলল রাফি। ছোটবেলায় নিজেরও একটা কুকুর ছিল ওর, সেটাও এভাবে গাড়িচাপা পড়েছিল। ড্রাইভার এমনকি থামায়ওনি গাড়ি। পরের অনেকগুলো মাস নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়েছে রাফিকে কুকুর হারানোর শোক।

ওই ঘটনার পর বিশটা বছর পেরিয়ে গেলেও আজও ও ভাবতে পারছে না মৃত প্রাণীটাকে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে চলে যাওয়ার কথা।

জ্যাকেট দিয়ে কুকুরটাকে মুড়ে ফেলল রাফি।

‘ভাগ্যিস, সস্তার জ্যাকেটটা এনেছিলাম।’ এই ভেবে সান্ত্বনা দিল ও নিজেকে। যত্নের সঙ্গে ড্রাইভারের পাশের সিটে নামিয়ে রাখল মৃতদেহটা।

গাড়িতে ওঠার পর চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। কী যে করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। পশু হাসপাতালে নিয়ে যাবে লাশটা? কিন্তু রাত তো প্রায় সাড়ে বারোটা!

গাড়ি স্টার্ট দিল রাফি। হঠাৎ করে মনে পড়েছে, গত সপ্তায় কেনা গার্ডেনিং ইকুইপমেন্টের পুরো সেট রয়ে গেছে গাড়ির ট্রাংকে—কেনার পর আর বেরই করা হয়নি গাড়ি থেকে। শাবল, কোদাল, দস্তানা—সবই আছে ওখানে।

আর ওর চারপাশে রয়েছে জঙ্গল।

ড্রাইভ করতে করতে গাছগাছালির ভিড়ে গাড়ি ঢোকানোর মতো ফাঁকা একটা জায়গা দেখতে পেয়ে প্রথমে সেটা পেরিয়ে গেল রাফি, এরপর আবার গাড়ি পিছিয়ে এনে ঢুকে পড়ল ওখান দিয়ে। গাড়ি বের করার সুবিধার্থে পেছনটা ঢুকিয়েছে জঙ্গলের দিকে মুখ করে।

বিশ কদমমতো যাওয়ার পর আর পেছানো গেল না গাড়ি। পুরোপুরি গোপন করতে না পারলেও রাস্তা থেকে অন্তত কারও চোখে যে পড়বে না ওটা, এটা নিশ্চিত রাফি। জঙ্গলের মধ্যে কাউকে গর্ত খুঁড়তে দেখলে কে কী ভেবে বসে, কে জানে! যদিও মধ্যরাত এখন।

গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করতেই নিভে গেল হেডলাইট। তবে গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে বনের ভেতর প্রবেশ করতে অসুবিধা হচ্ছে না পূর্ণ চাঁদের আলোর।

বুট খোলার জন্য ঘুরে গাড়ির পেছনে যাওয়ার সময় শুকনা পাতা মচমচ করে উঠল ওর জুতার নিচে। ভেতর থেকে শাবল বের করল রাফি, খুঁড়তে আরম্ভ করল গজ দশেক দূরের একটা খালি জায়গায় গিয়ে।

মাটি শক্ত, কাজটা কঠিন। কিছুক্ষণ পরই শার্টের পিঠের দিকটা ভিজে উঠল রাফির। ঘামে ভেজা চুলগুলো লেপটে রইল কপালের ওপর।

তারপরও কাজ বন্ধ করল না ও, যতক্ষণ না যথেষ্ট গভীর হলো গর্তটা। তা না করলে গন্ধ ছুটবে মাটি ভেদ করে, আর তাতে আকৃষ্ট হবে বুনো জানোয়ার।

ঠান্ডা বাতাসে বাষ্প হয়ে যাচ্ছে নিশ্বাস। অসাড় হয়ে গেছে হাতের আঙুলগুলো। আচমকা গাড়ির আওয়াজ কানে আসতেই জায়গায় জমে গেল রাফি।

গতি অব্যাহত রেখেই অবশ্য চলে গেল গাড়িটা।

‘এই রাস্তায় তো দিনের বেলাতেও লোক চলাচল নেই খুব একটা।’ মনে মনে নিজেকে আশ্বস্ত করে রাফি। আশা করছে, আর কেউ ওকে বিরক্ত করবে না।

হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল ও গাড়ির কাছে। কিন্তু কুকুরটাকে বের করার বদলে গাড়ির বুটে উঁকি দিল আবার। আরও কিছু রাখা আছে ওখানে তারপলিনে জড়ানো অবস্থায়।

জিনিসটা গাড়ি থেকে নামাতে গিয়ে দম বেরিয়ে গেল রাফির। মড়ার মতো ভারী ওটা!

সদ্য খোঁড়া গর্তের দিকে টেনে নিয়ে চলল সে বস্তাটা।

গর্তের মধ্যে ওটা ফেলে দেওয়ার পর ফিরে গেল রাফি কুকুরটার কাছে। জ্যাকেটে পেঁচানো দেহটা দুহাতে তুলে নিতে নিতে মনে হলো ওর—আর যা-ই হোক, কুকুর কখনো মিথ্যে বলে না। কক্ষনো বেইমানি করে না!

কবরের কাছে এসে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল রাফি। পরম মমতায় কুকুরটাকে নামিয়ে রাখল ও ব্যবসায়িক পার্টনারের মরদেহের ওপর!

*

এক বছর পর...

ডিনার শেষে মাত্র ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাফি। হঠাৎ বেজে উঠল কলবেল। এত রাতে কারো আসার কথা নয়। ‘কে?’ জিজ্ঞেস করল রাফি। ‘দরজা খুলুন। আমরা ডিবি থেকে এসেছি।’ ওপাশ থেকে বলল ভারী কণ্ঠ। ঢোঁক গিলল রাফি। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ পাচ্ছে ও।

আরও পড়ুন