গোয়েন্দা শামসু ও তিন বোতল তেল

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

ডোরবেলের শব্দে পেয়ে সদর দরজা খুললেন আবদুল হাই। তাকে দেখেই দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলল, ‘আমি “সমস্যা সমাধান ডট কম” থেকে এসেছি। এই ঠিকানায় ওখানে একটা কেস ফাইল হয়েছে।’

আবদুল হাই বললেন, ‘হ্যাঁ। কেসটা আমিই ফাইল করেছি। আপনি?’

‘আমি গোয়েন্দা শামসু। আপনার কেসটা নিয়ে কাজ করতে এসেছি।’

সঙ্গে সঙ্গে দরজার এক পাশে সরে দাঁড়ালেন আবদুল হাই। বললেন, ‘ভেতরে আসুন।’

ঘরে ঢুকলেই বসার ঘর। ছয় আসনের সোফা সেট দিয়ে সাজানো। দুই আসনের সোফাটায় বসলেন গোয়েন্দা।

আর এক আসনের একমাত্র সোফায় বসলেন আবদুল হাই। আর তিন আসনের সোফার ওপর কিছু বই।

আবদুল হাই জানতে চাইলেন, ‘তা আপনার কাজের ধরনটা কী রকম? শার্লক হোমস বা এরকুল পোয়ারোর মতো? নাকি রবার্ট ল৵াংডন, অগাস্ত দুঁপো কিংবা ফিলিপ মারলোর মতো?’

‘আমি কাজ করি আমার মতো।’

‘সেটাই ভালো। আমার কাজটা শেষ করতে কত দিন লাগতে পারে?’

‘কী করতে হবে, আমি কিন্তু এখনো জানি না।’

আবদুল হাই বললেন, ‘তেল খুঁজে বের করতে হবে।’

হোঁচট খেলেন গোয়েন্দা। ‘তেল!’

‘হ্যাঁ। তেল। তিন বোতল তেল। একেক বোতলে তিন শ মিলিগ্রাম।’

‘তেল খুঁজে বের করার জন্য আপনি গোয়েন্দা ভাড়া করেছেন?’

‘সমস্যা কোথায়? আপনি প্রাইভেট গোয়েন্দা। ক্লায়েন্টের প্রয়োজন অনুযায়ীই তো কাজ করবেন! নাকি বেছে বেছে কাজ নেন?’

‘আপনার প্রয়োজনমতোই কাজ হবে।’

‘গুড। আগেই জানিয়ে রাখি, জায়গামতো অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তেল নিয়ে ওদের কোনো আগ্রহই দেখলাম না। সাধারণ ডায়েরি করতে চাইলাম, সেটাও করল না।’

বলতে বলতে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন আবদুল হাই।

শামসু বললেন, ‘আমাকে তিন বোতল তেল খুঁজে বের করতে হবে, এই তো?’

‘ঠিক।’

‘তেলের কোনো স্যাম্পল আছে?’

‘নেই। তবে যেসব বোতলে তেল ছিল, সেই বোতলের স্যাম্পল আছে। দেখবেন?’

বলেই আর জবাবের অপেক্ষা করলেন না আবদুল হাই। দ্রুত হেঁটে ডান পাশের ঘরে চলে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা কাগজের কার্টন নিয়ে এলেন। কার্টনের ভেতর থেকে একগাদা খড় সরিয়ে একটা শোলার বাক্স বের করলেন। বাক্স খুলতেই বেরিয়ে এল একটা বোতল। বোতলটা গোয়েন্দার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এ রকম তিন বোতল তেল গায়েব।’

আরও পড়ুন

বোতলের ছিপি খুলে গন্ধ শুঁকলেন শামসু। জানতে চাইলেন, ‘কী তেল ছিল ভেতরে?’

‘আমি জানি না। তবে তেলটা খুবই উপকারী। নিয়মিত মাখলে পাকা চুল কালো হয়, চুল পড়া বন্ধ হয়। এমনকি নতুন চুলও গজায়।’

মুচকি হেসে গোয়েন্দা বললেন, ‘তেল মাখলে নতুন চুল গজায়, এটা আপনি বিশ্বাস করেন?’

‘আগে করতাম না। কিন্তু এই তেল ব্যবহার করে বিশ্বাস জন্মেছে। আমার মাথার দিকে তাকান! চুল দেখে কি মনে হয় এ মাথার বয়স বাহাত্তর বছর?’

আবদুল হাইয়ের মাথায় তাকালেন শামসু। মাথাভরা ঘন কালো চুল। বললেন, ‘আমি তো প্রথমে দেখে ভেবেছি, চুলে নিয়মিত কলপ দেওয়া হয়।’

‘অনেক বছর কলপ দিয়েই তো ভুলটা করেছিলাম। মাথা প্রায় খালি হয়ে গিয়েছিল। এই তেল মাখার পর সাদা চুল কালো তো হয়েছেই, দুমাসেই ঘন কালো চুলে মাথা ভরে গেছে।’

স্বীকার করলেন গোয়েন্দা, ‘খুবই দুর্লভ তেল।’

‘একেক বোতল তেলের জন্য তিন লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। তিন বোতলে ৯ লাখ। প্রতি বোতল পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করার জন্য আনিয়েছিলাম। ক্লায়েন্টও রেডি ছিল। এমনকি অর্ধেক টাকা অগ্রিমও পেয়েছি। কিন্তু বোতল এসেছে, তেল আসেনি।’

‘এই তেল আসে কোত্থেকে?’

‘সেটা বলা যাবে না। ব্যবসায়িক গোপনীয়তা। বোতলপ্রতি দুলাখ টাকা লাভ করতে চাইলে গোপনীয়তা ধরে রাখতেই হবে।’

‘তিন বোতলই কি একই কুরিয়ারে পাঠানো হয়েছিল?’

চোয়াল কঠিন করে আবদুল হাই বললেন, ‘তার চেয়ে কঠিন। চুরি হওয়া তেল উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমার ৯ লাখ টাকা গচ্চা। কঠিন প্রতিশোধ নিয়ে সেটা পুষিয়ে দিতে হবে।

‘হ্যাঁ। তবে তিন নয়। এ পর্যন্ত চার বোতল তেল পাঠানো হয়েছিল। চার মাসে চার বোতল। এক বোতল তেল তৈরি করতে এক মাস সময় লাগে। প্রথম মাসের পাঠানো তেল আমি হাতে পেয়ে নিজেই ব্যবহার করেছি। সেটার ফলাফল নিজের চোখেই দেখেছেন। সেই জোরেই ব্যবসা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শুরুই তো করতে পারিনি। পরের তিন মাসে আসা তিন বোতল তেল হাপিস।’

‘তেল খুঁজে বের করতে হলে আগে তেলচোরকে খুঁজে বের করতে হবে।’

‘ঠিক। কান টানলে মাথা আসবেই।’

গোয়েন্দা বললেন, ‘আমার দুটো জিনিস চাই। কুরিয়ারের ঠিকানা আর তেলের বোতল। বোতল আপনি ফেরত পাবেন। তারপর দেখি কোথাকার তেল কোথায় গড়ায়।’

আরও পড়ুন

২.

সাত দিন পর সেই এক আসনের একমাত্র সোফায় বসতে বসতে আবদুল হাই জানতে চাইলেন, ‘কাজ কিছু এগোল?’

সেই দুই আসনের সোফায় বসতে বসতে গোয়েন্দা শামসু বললেন, ‘অনেকখানি। সন্দেহের তালিকায় তিনজনকে জমায়েত করতে পেরেছি।’

‘কোন তিনজন?’

‘কুরিয়ারে বুকিং দেওয়া জিনিসপত্র ঠিকঠাকমতো এসেছে কি না, চালান রসিদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন আলী হায়দার। এই মিলিয়ে দেখার সময় কার্টন খুলে বোতল থেকে তেল হাপিস করা কিছুটা সময়সাপেক্ষ হলেও অসম্ভব নয়।’

‘বাহ! এরপর?’

‘জমির উদ্দিন। কোন জিনিস কখন কোথায় ডেলিভারি দিতে হবে, ডেলিভারিম্যানদের সেটা তিনিই ঠিক করে দেন। আপনি কি নির্দিষ্ট দিনে হোম ডেলিভারি পেয়েছিলেন?’

‘নির্দিষ্ট দিনেই পেয়েছি, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে পাইনি। কয়েক ঘণ্টা দেরি হয়েছিল।’

‘সন্দেহের তালিকায় জমির সাহেবও আছেন।’

‘গুড। আর তৃতীয় সন্দেহভাজন?’

‘ডেলিভারিম্যান জয়নাল। এ এলাকার ডেলিভারিগুলো সে-ই করে।’

‘কিন্তু প্রমাণ?’

শামসু বললেন, ‘প্রমাণ করতে হলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এ জন্য কুরিয়ার অফিসে আগে অভিযোগ জানাতে হবে।’

আঁতকে উঠলেন আবদুল হাই। ‘না, না। সেটা অসম্ভব। অভিযোগ করলেই খোঁজখবর শুরু হয়ে যাবে। তেলের উত্সটাও আর গোপন থাকবে না।’

হতাশ হলেন গোয়েন্দা। ‘তাহলে আপনি কী করতে চান?’

‘প্রতিশোধ নিতে চাই এবং এমনভাবে নিতে চাই, যাতে তেলচোরেরা ঠিকই বুঝবে কে প্রতিশোধ নিয়েছে, কিন্তু কাউকে বলতে পারবে না।’

‘মানে আপনার এখন যে রকম অবস্থা, তাদেরও ঠিক একই অবস্থা করতে চাইছেন। তাই তো?’

চোয়াল কঠিন করে আবদুল হাই বললেন, ‘তার চেয়ে কঠিন। চুরি হওয়া তেল উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমার ৯ লাখ টাকা গচ্চা। কঠিন প্রতিশোধ নিয়ে সেটা পুষিয়ে দিতে হবে। কঠিন প্রতিশোধ নিতে পারবেন তো?’

গম্ভীর কণ্ঠে শামসু বললেন, ‘বড়শি তো পেতেই রেখেছি। আপনি যেখান থেকে তেল আনিয়ে থাকেন, সেখানে তেলের বোতলটা পাঠিয়েছেন তো?’

‘দুদিন আগেই এবং আপনার কথামতো জানিয়েও দিয়েছি যেন এই বোতলই আবার আমার ঠিকানায় একই কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেয়।’

‘দারুণ! বড়শিতে শিকার ধরা পড়তে দেরি নেই। দু–তিন দিনের ভেতর প্রমাণসহ চোরের হদিস পেয়ে যাবেন।’

হতাশ কণ্ঠে আবদুল হাই বললেন, ‘কিন্তু প্রতিশোধ!’

গোয়েন্দা বললেন, ‘প্রমাণটাই হবে প্রতিশোধ।’

আরও পড়ুন

৩.

আরও তিন দিন পর সদ্য ডেলিভারি পাওয়া কাগজের একটা কার্টন খুলতে লাগলেন গোয়েন্দা শামসু। খড় সরিয়ে শোলার বাক্স খুলে বোতলটা বের করে আনলেন। এক আসনের একমাত্র সোফায় বসা আবদুল হাইয়ের হাতে বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নিন আপনার বোতল।’

হাতে বোতল নিয়ে আবদুল হাই বললেন, ‘বোতল তো দেখছি খালি। এটাই সেই বোতল তো?’

রহস্যময় হাসি দিয়ে সেই দুই আসনের সোফায় গিয়ে বসলেন গোয়েন্দা শামসু। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ। এটাই সেই বোতল। বোতলে আধার ভরে একটা চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলাম। চিহ্নটা আছে কিন্তু আধারটুকু নেই। তার মানে মাছ বড়শির আধার গিলেছে।’

কৌতূহলী দৃষ্টিতে আবদুল হাই বললেন, ‘কী আধার ছিল বোতলে?’

অবাক হয়ে গোয়েন্দা শামসুর দিকে তাকালেন ম্যানেজার। বিস্ময়ে ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে গেছে। কপালের আরেকটু ওপরেই মাথাভরা কাঁচা–পাকা চুল।

গোয়েন্দা শামসু বললেন, ‘আধারের জন্য আমার এক কেমিস্ট বন্ধুর সাহায্য নিয়েছি। তেলের সঙ্গে সে এমন কিছু মিশিয়েছে, ওই তেল মাথায় মাখামাত্রই কাজ শুরু হয়ে যাবে। ছাব্বিশ ঘণ্টা পর চুল পড়া শুরু হবে এবং মাত্র বাইশ মিনিটে মাথা খালি হয়ে যাবে।’

চোখ দুটো কপালে তুলে আবদুল হাই বললেন, ‘বলেন কী! গতিটা বেশি হয়ে গেল না?’

‘আপনি কঠিন প্রতিশোধ নিতে বলেছিলেন। সে কারণে গতি না বাড়িয়ে উপায় ছিল না। আর ছাব্বিশ ঘণ্টা পর আমরা ফলাফল দেখতে যাচ্ছি।’

আরও পড়ুন

৪.

কুরিয়ার অফিসটা বেশ বড়ই। কিন্তু বড্ড হট্টগোল, চিত্কার–চেঁচামেচি। কাউন্টারে গিয়ে ম্যানেজারের খোঁজ করতেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘আমিই ম্যানেজার। কিছু বলবেন?’

‘আপনার সঙ্গে জরুরি আলাপ ছিল।’

মুখ ভার করে ম্যানেজার বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আজ আমি খুব ব্যস্ত। দেখতেই পাচ্ছেন হই–হট্টগোল চলছে। অনুগ্রহ করে যদি আগামীকাল...!’

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই গোয়েন্দা শামসু বললেন, ‘বেশ বিশৃঙ্খল অবস্থা। আজ আপনার তিনজন কর্মী কাজে আসেনি। তাই তো?’

‘তিনজন নয়, চারজন। বারোজন কর্মীর মধ্যে চারজন না এলে যা হয় আরকি!’

শামসু বললেন, ‘কাজে আসেনি ডেলিভারিম্যান জয়নাল, বুকিং চেকার আলী হায়দার, সুপারভাইজার জমির উদ্দিন। আরেকজন কে?’

‘আমার সহকারী আইনুল।’

‘হঠাৎ করে সবারই মাথার চুল পড়ে গেছে, তা–ই না?’

অবাক হয়ে গোয়েন্দা শামসুর দিকে তাকালেন ম্যানেজার। বিস্ময়ে ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে গেছে। কপালের আরেকটু ওপরেই মাথাভরা কাঁচা–পাকা চুল। বিস্মিত কণ্ঠে ম্যানেজার জানতে চাইলেন, ‘অবাক কাণ্ড! কী করে জানলেন?’

জবাব দিলেন না গোয়েন্দা শামসু। আবদুল হাইকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন কুরিয়ার অফিস থেকে।

আরও পড়ুন