আহসান হাবীবের গল্প 'নেলি-কাণ্ড!'

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

নেলি যে আম–কাঁঠালের বন্ধের মধ্যেই স্কুল বদলে ফেলেছে, সেটা গগন বা সজীব জানত না। দুজনই খুব অবাক হলো।

‘স্কুল বদলাল কেন নেলি?’ সজীব প্রশ্ন করে।

‘আমি কী করে বলব, তবে ...’

‘তবে?’

‘তবে মনে হয় ওর বাবা তো আমাদের পছন্দ করে না, আমরা যেন ওর সঙ্গে না মিশি, তাই স্কুলই বদলে ফেলেছে।’

‘হতে পারে।’

বান্দরবান থেকে ফিরে আসার পর দুই মাস হয়ে গেছে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, সবাই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। সারা বছর পড়াশোনা হয়নি। গগনও বইপত্র নিয়ে বসেছে। মোটামুটি পাস তো করতে হবে। সে ছাত্র খারাপ নয়, তারপরও... ঠিক তখনই সজীব ছুটতে ছুটতে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘গগন, সর্বনাশ হয়েছে।’

‘মানে?’

‘নেলিকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘মানে?’

‘মানে নেলি নিখোঁজ!’

‘তুই জানলি কীভাবে?’

‘নেলির মা ফোন করেছিল। তোকে এখনই যেতে বলেছে।’

‘আমাকে? নেলির বাবা...’

‘নেলির বাবা এক মাসের জন্য বিদেশে গেছে। সে জন্যই মনে হয় যেতে বলেছে।’

শেষমেশ গেল ওরা দুজন। ওদের দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন নেলির মা। উনি কেঁদেকেটে যা বললেন তার সারাংশ হলো...

নেলির নতুন স্কুলে বার্ষিক নাটকে নেলির একটা চরিত্র ছিল। নেলি নাকি খুব আগ্রহ নিয়ে রিহার্সেল করেছিল। নতুন স্কুলটা তার পছন্দ হয়েছে। ওটা গার্লস স্কুল। তো যেদিন ফাইনাল নাটক হবে, সেদিন নেলির মায়েরও যাওয়ার কথা। অভিভাবকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু নেলির বাবা ইতালি থেকে ওই সময় ফোন করবেন বলে তিনি থেকে গেলেন। নাটক দেখতে গেলেন না। সন্ধ্যা ছয়টায় নাটক শুরু হয়ে রাত আটটায় নাটক শেষ হওয়ার কথা। আটটা–সাড়ে আটটার দিকেই নেলির ফিরে আসার কথা। কিন্তু নেলি এল না। নেলির মা স্কুলে যোগাযোগ করলেন । স্কুল থেকে বলা হলো, নাটক আগেই শেষ হয়েছে। নেলি ঠিক আটটায় স্কুল থেকে বেরিয়ে গেছে।

‘আন্টি, ও স্কুল থেকে অন্য কোথাও যায়?’

‘যায়, ওর খালার বাসায় যায় মাঝেমধ্যে।’

‘খালার বাসা কোথায়?’

‘কাছেই ট্রাফিক মোড়টার কাছে হলুদ রঙের দোতলা বাসাটা।’

‘হ্যাঁ। চিনতে পেরেছি। আন্টি, পুলিশকে জানিয়েছেন?’

‘না, পুলিশ বলেছে ৪৮ ঘণ্টার আগে ওরা নিখোঁজ হিসেবে ধরে না।’

‘আঙ্কেলকে জানিয়েছেন?’

‘না। ওকেও জানাইনি। তোমাকেই প্রথম জানালাম...’ বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন আবার।

আরও পড়ুন

‘আন্টি, ভাববেন না। গগন ঠিক ওকে খুঁজে বের করবে।’ সজীব আগ বাড়িয়ে গগনের হয়ে সাফাই গায়। গগনের মাথায় তখন চিন্তা চলছে। নেলি কোথায় যেতে পারে...? কোথায় যেতে পারে...?? কোথায় যেতে পারে...???

নেলিদের বাসা থেকে বের হয়ে এল গগন। চিন্তিত মুখে তাকাল সজীবের দিকে।

‘চল, ওর খালার বাসায় যাই একটু।’

‘চল।’

খালার বাসা হাঁটা দূরত্বে। দুজনই গিয়ে হাজির হলো। খালা ওদের চিনতে পারলেন। আগে নেলির সঙ্গে কয়েকবার এসেছিল এই বাসায়। আন্টি এই বাসায় একাই থাকেন। তাঁর দুই ছেলে বিদেশে। আঙ্কেল ক্যানসারে মারা গেছেন বছর তিনেক আগে।

‘আন্টি, আমাদের চিনতে পেরেছেন?’

‘হ্যাঁ, তোমরা নেলির বন্ধু না?’

‘জি জি। শুনেছেন বোধ হয়, নেলি নিখোঁজ।’

‘হ্যাঁ, শুনেছি। ওকে কি এখনো পাওয়া যায়নি?’

‘না, আন্টি।’

‘হায় হায়! তাহলে কী হবে?’

‘আন্টি, ও শেষ কবে এসেছিল?’

‘এই তো। গত পরশু।’

‘না, এখন বলে কাজ নেই। নেলিকে পাওয়া যাচ্ছে না আর এখন কৌতুক বলে হাসাহাসি করা ঠিক হবে না। আন্টি নিশ্চয়ই মন খারাপ করবে। চল যাই।’

‘এসে কী বলল–টলল, খুলে বলবেন?’

‘আমি একা থাকি বলে ও স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই আসত। ওই দিন মানে গত পরশুও এল। স্কুলে ওর নাটক হবে বলে আমাকে আমন্ত্রণপত্র দিল। এই যে কার্ড, আমি অবশ্য যেতে পারিনি। ওর মা আমাকে নিয়ে যাবে বলেছিল, কিন্তু সেও যায়নি। তো ওই দিন আবার আমি কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম...’

‘কিসের বিজ্ঞাপন?’

‘একটা কাজের লোক চেয়ে । আমি একা একা থাকি তো। ওই দিন দুজন মহিলা এসেছিল বিজ্ঞাপন দেখে, কিন্তু তাদের বয়স বেশি বলে আমি রাখিনি। পরে একজনকে রেখেছি। বয়স হয়েছে, একা একা পারি না। চোখেও ভালো দেখি না।’

‘হুম।’ মাথা নাড়ে গগন।

‘নেলি কিছু বলেনি?’

‘না, বলেনি। তবে আমি যে কাজের লোক রাখব, এটা শুনে খুশি হয়েছিল।’

‘আচ্ছা আন্টি, আসি।’

‘একটু চা খাবে না?’

‘না, আন্টি।’

‘নেলির খোঁজ পেলে জানাবে আমাকে।’

‘জি, অবশ্যই।’

দুজন বেরিয়ে এল।

‘এখন কোথায় যাব আমরা?’

আরও পড়ুন

‘চল, নেলিদের বাসায় আবার একটু যাই।’ গগন মুচকি মুচকি হাসছে, সজীব খেয়াল করল।

‘কিরে, হাসছিস কেন?’

‘কেন, হাসলে সমস্যা কী?’

ওদের আবার আসতে দেখে নেলির মা অবাক হলেন!

‘আন্টি, নেলির ঘরটা একটু দেখব।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসো। কোনো খোঁজ পেলে?’

‘না, এখনো পাইনি...’

‘আন্টি, কাল চা খাওয়াতে চাইলেন, আমরা খাইনি। আজ তাই চা খেতে এলাম।’ আন্টি একটু অবাক হলেন। তারপরও বললেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই।’ বলে গলা উঁচু করে ডাকলেন, ‘রাহেলা, রাহেলা, দুকাপ চা দাও। সঙ্গে বিস্কুট দিয়ো এখানে।’

নেলির ঘরটা গোছানো। যেটার জন্য দ্বিতীয় দফায় গগনরা এল, সেটা টেবিলের ওপর পেয়ে গেল গগন। নেলিদের নাটকের স্ক্রিপ্টটা। নাটকের নাম ‘দিন বদলের পালা’। লেখক মনোরঞ্জন ধর। নেলির চরিত্রটা নেলি হলুদ পেনসিল দিয়ে দাগ দিয়ে রেখেছে। ওর সংলাপের নিচে নিচে লম্বা করে হলুদ পেনসিলে দাগ দিয়ে রেখেছে। স্ক্রিপ্টটা উল্টেপাল্টে দেখল গগন, অনেকক্ষণ ধরে। হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল!

‘কিরে, হাসলি কেন?’

‘একটা কৌতুক মনে পড়ল, তাই।’

‘কী কৌতুক?’

‘শুনবি?’

‘হ্যাঁ।’

‘না, এখন বলে কাজ নেই। নেলিকে পাওয়া যাচ্ছে না আর এখন কৌতুক বলে হাসাহাসি করা ঠিক হবে না। আন্টি নিশ্চয়ই মন খারাপ করবে। চল যাই।’

‘গগন, বাবা কিছু বুঝলে?’ আন্টি এগিয়ে এসে জানতে চান।

‘হ্যাঁ আন্টি, চিন্তা করবেন না। কাল ঠিক নেলিকে নিয়ে আসব।’

‘সত্যি বলছ? ও আছে কোথায়?’

‘আপনি ভাববেন না। যেখানে আছে, মনে হয় ভালোই আছে। কাল সকালে ওকে আমরা নিয়ে আসব।’

‘সত্যি বলছ?’

‘হ্যাঁ, আন্টি।’

গগন আর সজীব ওদের পাড়ার চায়ের দোকানে ঢুকে দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিল। এই দোকানের চা-টা অনেক মজার হয়। চায়ের মধ্যে মনে হয় পুদিনাপাতা দেয়, কেমন একটা অন্য রকম ঘ্রাণ পাওয়া যায়। সজীব চায়ে চুমুক দিয়ে তাকায় গগনের দিকে—

‘গগন?’

‘উম?’

‘সত্যি নেলির খোঁজ পেয়েছিস?’

‘এখনো পাইনি, তবে কাল সকালে ঠিক আসামি ধরে ফেলব।’

‘আসামিটা কে? যারা নেলিকে ধরেছে...’

‘আরে না, আসামি নেলি নিজেই। হি হি ...’ গগন অনেকক্ষণ ধরে হাসল।

‘তুই এত হাসছিস কেন, বল তো।’

‘বললাম না, একটা কৌতুক মনে পড়ল।’

‘তো, এখন বল কৌতুকটা।’

‘না, এখন না, কাল সকালে। চল যাই।’

সকালবেলা নয়টার দিকে গগন আর সজীব নেলির খালার বাসায় গিয়ে হাজির হলো। আন্টি সাতসকালে ওদের দেখে অবাক হলেন।

‘তোমরা এত সকালে?’

‘আন্টি, কাল চা খাওয়াতে চাইলেন, আমরা খাইনি। আজ তাই চা খেতে এলাম।’ আন্টি একটু অবাক হলেন। তারপরও বললেন,

‘অবশ্যই অবশ্যই।’ বলে গলা উঁচু করে ডাকলেন, ‘রাহেলা, রাহেলা, দুকাপ চা দাও। সঙ্গে বিস্কুট দিয়ো এখানে।’

‘জে আম্মা।’ ভেতর থেকে আওয়াজ আসে।

‘তা নেলির কোনো খোঁজ পেলে তোমরা?’

‘এখনো পাইনি। তবে আপনার এখানে চা-টা খেয়েই পেয়ে যাব মনে হচ্ছে।’ তখনই ট্রেতে করে চা–বিস্কুট নিয়ে লম্বা ঘোমটা পরে এক মহিলা ঢুকল। ইনিই সম্ভবত আন্টির নতুন কাজের লোক রাহেলা।

টেবিলের ওপর চা–বিস্কুট নামিয়ে রেখে চলে যাচ্ছিল রাহেলা। তখন গগন বলল,

‘নেলি, কাজের লোক হিসেবে তোর সাজসজ্জা বেশ ভালোই হয়েছে। তবে তোর ফরসা পা কিন্তু দেখা যাচ্ছে। ওখানে একটু রং মারলি না কেন?’

আন্টি আর সজীবের মুখ হাঁ হয়ে যায়। রাহেলা বেগম দাঁড়িয়ে গিয়ে ঘোমটা নামিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। ‘উফ, তোরা বুঝে ফেলেছিস... আর কয়েকটা দিন খালার একটু সেবা করতাম। আর এক মাসের বেতনটা নিতাম... হি হি হি!’

‘ওরে শয়তান!’ খালা উঠে গিয়ে নেলির চুলের ঝুঁটি চেপে ধরলেন।

‘উউউ... লাগে খালা!’

তখনই নেলির মা ঢুকলেন। তাঁকে রাতেই গগন মেসেজ দিয়ে রেখেছিল এখানে আসার জন্য। তিনি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন নেলির দিকে। তারপর ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।

আর ওদিকে সজীবের মুখ যে হাঁ হয়েছে, এখনো বন্ধ হচ্ছে না। গগন ফিসফিস করে বলল, ‘মুখটা বন্ধ কর। মশা–মাছি দুটোই ঢুকবে। আজকাল দিনেও মশা থাকে ...এডিস মশা!’

দুদিন পরের ঘটনা। নেলিদের বাসায় গগন আর সজীবের চায়ের দাওয়াত। গিয়ে দেখে, চায়ের কোনো কারবার নেই। টেবিলে নানা রকম খাবার সাজানো। পিৎজা থেকে শুরু করে নুডলস, স্যান্ডইউচ, ফুচকা—কী নেই! যেহেতু বাসায় নেলির বাবা নেই, তিনি এক মাসের জন্য বিদেশে, কাজেই ওরা নিশ্চিন্তে খাচ্ছে। সজীব নুডলস খেতে খেতে বলল,

‘নেলি, এমনটা করলি কেন?’

‘কেমন করলাম?’

‘এই যে, কাজের লোক হয়ে আন্টির বাসায়...’

নেলি হি হি করে হাসল কিছুক্ষণ হাসল। তারপর বলল,

‘আসলে মা–খালা কেউ আমার নাটক দেখতে যায়নি। আমার খুব রাগ হলো। ভাবলাম একটা শিক্ষা দিই। নাটকে আমার চরিত্রটা ছিল বাসার কাজের মেয়ের। আর ওদিকে খালা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে কাজের মেয়ে চেয়ে... ব্যস দুইয়ে–দুইয়ে চার। আমি স্কুলের নাটক শেষ করে সোজা খালার বাসায় কাজের মেয়ে হিসেবে... হি হি।’

‘ফাজিল মেয়ে একটা।’ আন্টি গজগজ করেন, অবশ্য খুশি খুশি গলায়।

‘আচ্ছা গগন, তুই কী করে বুঝলি বল না!’ নেলি জানতে চায়।

‘ওই যে তোর মুখের রঙের সঙ্গে ফরসা পা মিলছিল না। ওটা দেখেই সন্দেহ হলো। তা ছাড়া...’

‘তা ছাড়া...?’

ঠিক তখনই নেলির বাবা ইতালি থেকে ভিডিও কল দিলেন। ‘নেলি কোথায়?’

‘এই তো, নেলি এখানে।’ বলে আন্টি হাতের ফোনটা ঘুরিয়েছেন, তখনই ঝুপ ঝুপ করে গগন আর সজীব টেবিলের নিচে চলে গেল। ওরা টেবিলের নিচ থেকে শুনতে পাচ্ছে, নেলির বাবা বলছেন, ‘কী ব্যাপার? টেবিলে এত খাবারদাবার কিসের?’

‘অ্যাঁ ইয়ে...নেলির বান্ধবীরা আসবে...’

‘ওই ডেপো ছেলে দুটো আবার আসবে না তো?’

টেবিলের নিচে গগন আর সজীবের গলায় পিৎজার তিনকোনা টুকরো দুটো যেন আটকে যায়। পিৎজা জিনিসটা ডেলিভারি আসে চারকোনা বাক্সে, জিনিসটা গোল ...খায় তিনকোনা টুকরো। সিলিন্ডারের মতো গলা দিয়ে নামে সেই তিনকোনা বস্তুটি... যেটা মনে হচ্ছে গগন বা সজীবের গলায় আটকে গেছে। ছুটবে তো? কে জানে!

আরও পড়ুন