ঘুমের আগে বই পড়ব নাকি ফোন স্ক্রল করব?
ঘুমের আগে বই পড়ব, নাকি ফোন স্ক্রল করব, এই নিয়ে অনেকেই দোটানায় ভোগেন। এই দোটানার মধ্যে সব সময় যেন ফোনই জয়ী হয়; কিন্তু কেন? যদি বিষয়টি উল্টো হতো, তাহলে ঘুমের ওপর কেমন প্রভাব পড়ত?
আজকাল কেউ বইটই তেমন পড়ে না। গেল সপ্তাহে আমি আমার ফোন লিভিং রুমে রেখে দিয়েছিলাম। আমি বই পড়েছি। সঠিক সংখ্যাটি গুনে বললে, আমি চারটি বই পড়ে শেষ করেছি। যেখানে আগে একটি বই পড়ে শেষ করতেই আমার এক মাস লাগে। কারণ, আমি কখনোই ‘সময় পাই না’।
কী কী পড়েছি আমি বলি। একটি উপন্যাস (মিস্টি উইলসনের ‘ফলিং লাইক লিভস’) , একটি ক্ল্যাসিক উপন্যাস (জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪), একটি আত্মজীবনী (ফ্রিদা কাহলো)। আরেকটা বই আমার আগেই পড়া ছিল, আবার পড়েছি। সিলভিয়া প্লাথের ‘দ্য বেল জার’।
ফলস্বরূপ, আমার তাড়াতাড়ি ঘুম আসত। এমনকি মেলাটোনিন সেবন করাও লাগত না। আমার বেশ বড় ধরনের আর্ট ব্লক হয়েছিল। সেই ব্লকটাও কেটে গেছে। আমি আবারও ছবি আঁকতে শুরু করেছি।
এই সবকিছু দেখে আমি বুঝতে পারলাম, ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করার চেয়ে বই পড়া অনেক ভালো। অন্যের জীবনে কী ঘটছে, তা না দেখে নিজের জীবনের দিকে তাকানোই উপকারী।
বই পড়া মানুষের কল্পনাশক্তিকে উন্নত করে। বই পড়লে বানান সম্পর্কেও ধারণা ভালো হয়। একটি বইয়ের মাধ্যমে তুমি অন্য কারও জগতে ঢুকে পড়তে সক্ষম হবে, যে জগৎটি হয়তো সৃষ্টি হয়েছিল বহু বছর আগে।
সংক্ষেপে বলা যায়, ঘুমানোর আগে বই পড়া ঘুমের জন্য ভালো। এতে ঘুম আগে আগে আসবে। তুমি দ্রুত ঘুমাতে পারবে, ঘুমটা ভালো হবে।
এবার চলো, ঘুমের আগে করা আরেকটি কাজ সম্পর্কে কিছু কথা বলি। যে কাজটি করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে শরীরে কী ঘটে?
এই অভ্যাসের কারণে তোমার মনোযোগ ও ঘুম নষ্ট হয়। তুমি যা করতে ভালবাসো, সেই কাজ থেকে স্ক্রিন তোমার মনোযোগ কেড়ে নেয়। ঘুমানোর আগে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে তোমার ঘুম ও স্বাস্থ্য দুই-ই নষ্ট হয়। রাতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে তোমার মস্তিষ্ক ধরে নেয়, এখন দিন। মুঠোফোনে দেখা ভিডিওগুলো তোমার মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে। কখন বিশ্রামের সময় চলে যায়, মস্তিষ্ক তা টেরই পায় না। রাতে ফোন দেখা আপাতদৃষ্টে খুব রিল্যাক্সিং মনে হলেও আসলে তা নয়। ফোন থেকে নির্গত নীল আলো দেখলে মস্তিষ্ক ভেবে নেয়, এখনো রাত হয়নি। এতে ঘুমের স্বাভাবিক চক্র নষ্ট হয়। মেলাটোনিন উৎপাদন কমে যায়। ঘুম দেরিতে আসে এবং গভীর হয় না।
এসব কথা হয়তো তুমি আগেই পড়েছ, এখন আবারও পড়ছ। তারপরেও আজকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বই রেখে মুঠোফোনটাই তুমি টেনে নেবে। জানতে চাও, কেন?
কেন আমরা ডোপামিন বেছে নিই?
আমার বিশ্বাস, টিনএজারদের মধ্যে অর্ধেকই দিনে চার ঘণ্টার বেশি ফোনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্রাউজ করে কাটায়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, আমাদের মস্তিষ্কে এমন কী ঘটে যে ফোন আমাদের জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে?
আমরা যখন কোনো নোটিফিকেশন পাই, তখন আমাদের ডোপামিন নিঃসৃত হয়। সুখানুভূতির সঙ্গে ডোপামিনের সম্পর্ক আছে। ডোপামিন আমাদের মধ্যে খুব ক্ষণস্থায়ী সুখানূভুতি সৃষ্টি করে। এ এমন এক অনুভূতি যা ধরাছোঁয়ার বাইরে। যখনই তুমি ফোনটা বন্ধ করো, তখনই এই অনুভূতি মিলিয়ে যায়।
এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াগুলো আসলে তৈরি করাই হয়েছে আমাদের ব্যস্ত রাখার জন্য। নোটিফিকেশনের উজ্জ্বল রং, একের পর এক লাইক, সীমাহীন স্ক্রলিং, এই সবই ডিজাইন করা হয়েছে যতক্ষণ সম্ভব তোমার মনোযোগ ধরে রাখার জন্য। প্রতিটি মিথস্ক্রিয়াই এমন একটি বিভ্রম সৃষ্টি করে যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই ঘটছে না। শুধু তাৎক্ষণিক পুরস্কারের একটি সিস্টেমে তোমার মস্তিষ্ক বন্দী হয়ে আছে। এ কারণেই মন খারাপ হলে, ক্লান্ত লাগলে আমরা ছবি আঁকা, লেখালেখি এসব বাদ দিয়ে
ফোনটাই সবার আগে তুলে নিই। কারণ, এটিই আনন্দলাভের সবচেয়ে সহজ পথ।
এই দুষ্টচক্র থেকে বের হবার উপায় কী?
আমার ব্যক্তিগত মতামত
ব্যক্তিগতভাবে আমি যা করতাম, তা হলো ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমি আমার ফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট, এমনকি আমার সুইচটাও (গেম কনসোল) লিভিং রুমে বা মা–বাবার ঘরে চার্জে রেখে দিতাম, যাতে আমি সেগুলো ব্যবহার করতে না পারি। আর যদি ফোনে আমার কোনো অ্যালার্ম সেট করা থাকত, তাহলে আমি এক ঘণ্টার জন্য ব্লক সেট করতাম (ঘুমাতে যাওয়ার সময় থেকে শুরু করে ঘুম থেকে ওঠার আগ পর্যন্ত)। এভাবে আমার অ্যালার্মও থাকত; আর আমি ভালোভাবে বিশ্রামপূর্ণ ঘুম পেতাম!
কিন্তু মধ্যরাতে এমন করলে কোনো কাজ হবে না। তুমি কি জানতে, ঘুমের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘণ্টাগুলো হলো মধ্যরাতের আগে?
ঘুমের স্বাভাবিক চক্র ফিরিয়ে আনার এবং স্ক্রিন আসক্তি কমানোর অসংখ্য উপায় আছে। উদ্যোগটা নিতে হবে তোমাকেই।
এই আর্টিকেল পড়ার পরে রাতে বিছানায় গিয়ে ফোন হাতে তুলে নেওয়ার আগে তুমি কি আরেকবার ভাববে?
মূল: গ্যাব্রিয়েলা কাপাল্ডো অনুবাদ: আলিয়া রিফাত
সূত্র: দ্য টিন ম্যাগাজিন