শীতকালে কখন রাতের খাবার খাওয়া উচিত
শীতকাল মানেই এক অন্য রকম আমেজ। কুয়াশাঘেরা সকাল, দুপুরে মিষ্টি রোদ, আর সন্ধ্যা নামতে না নামতেই কনকনে ঠান্ডা। এ সময় দিন এত ছোট হয়ে যায় যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে না হতেই মনে হয় অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটায় হয়তো তখন কেবল সন্ধ্যা ৭টা বা ৮টা বাজে, কিন্তু বাইরের পরিবেশ দেখে মনে হয় যেন মধ্যরাত!
আর ঠিক এখানেই আমরা একটা বড় ভুল করে ফেলি। এই লম্বা রাতের চক্করে পড়ে আমাদের রাতের খাওয়ার সময় অনেক পিছিয়ে যায়। শীতের রাতে লেপ মুড়ি দিয়ে সিনেমা দেখা, ব্যাডমিন্টন খেলা কিংবা আড্ডা দিতে দিতে খাবার খেতে খেতে রাত ১০-১১টা বেজে যায়।
কিন্তু তোমার শরীরের ভালো থাকা বা না থাকা অনেকখানি নির্ভর করে শীতকালে রাতে খাবার খাওয়ার সময়ের ওপর। বিজ্ঞানীরা বলছেন, শীতকালে একটু আগেভাগে রাতের খাবার খেয়ে নিলে শরীর আর মন চনমনে থাকে। কিন্তু কেন এমন হয়? এ জন্য একটু বিজ্ঞান জানতে হবে। চলো, জানা যাক।
আমাদের সবার শরীরের ভেতরে একটা অদৃশ্য ঘড়ি আছে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে সার্কাডিয়ান রিদম। আমরা একে বলব দেহঘড়ি। এই ঘড়িটাই ঠিক করে দেয়, কখন আমাদের ঘুম পাবে, কখন খিদে পাবে, আর কখন শরীর খাবার হজম করবে।
মজার ব্যাপার হলো, শরীরের এই ঘড়িটা সূর্যের আলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের মেটাবলিজম বা হজমশক্তির কাজ শুরু হয়। তখন তুমি যা খাবে, শরীর সেটাকে দারুণভাবে শক্তিতে রূপান্তরিত করবে। কিন্তু শীতকালে যেহেতু আলো তাড়াতাড়ি নিভে যায়, তাই আমাদের শরীরের মেটাবলিজমও তাড়াতাড়ি বিশ্রামে চলে যেতে চায়।
সূর্য ডোবার পর শরীর ধরে নেয়, এখন আর কাজ করার সময় নেই, এখন বিশ্রামের সময়। ঠিক এই সময় যখন তুমি রাত ১০টা বা ১১টায় ভারী খাবার খাও, তখন শরীরের হজমপ্রক্রিয়া ভড়কে যায়। যে খাবারটা শক্তিতে রূপান্তর হওয়ার কথা ছিল, শরীর সেটাকে খরচ না করে চর্বি হিসেবে জমা করতে শুরু করে।
বিষয়টা সহজে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দিই। ধরো, রাফি আর শাফি দুই ভাই। দুজনেই শীতের রাতে একই খাবার খায়। কিন্তু রাফি খায় সন্ধ্যা ৭টায়, আর শাফি খায় রাত সাড়ে ১০টায়। কয়েক মাস পর দেখা গেল, রাফির ওজন ঠিক আছে, কিন্তু শাফির ওজন বেড়ে গেছে। কারণ, রাফি যখন খেয়েছে, তখন তার শরীর হজম করার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু শাফি যখন খেয়েছে, তখন তার শরীরের মেটাবলিজম ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার পথে। ফলে শাফির খাবারটা হজম না হয়ে চর্বি হয়ে শরীরে জমে গেছে।
গবেষণা বলছে, খাওয়ার সময় খাবারের মানের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা রাত ১০টায় রাতের খাবার খায়, তাদের রক্তে পরদিন সকালে চিনির মাত্রা সন্ধ্যা ৬টায় খাওয়া মানুষদের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি বেড়ে যায়। এমনকি তাদের ফ্যাট বা চর্বি বার্ন হওয়ার হারও ১০ শতাংশ কমে যায়! অথচ তারা দুজনই হয়তো সমান ক্যালরির খাবার খেয়েছিল।
দেরি করে খাওয়ার ফলে শরীরে ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। দীর্ঘ মেয়াদে এর ফলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, মোটা হয়ে যাওয়া এবং হার্টের সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্য ডোবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বা ঘুমানোর অন্তত ২-৩ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার শেষ করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
আগে খাওয়ার আরও কিছু সুবিধা আছে। যেমন সন্ধার পরপর হজমশক্তি শক্তিশালী থাকে। এই সময় খেলে খাবারটা দ্রুত হজম হয়ে যায়। কিন্তু গভীর রাতে খেলে অ্যাসিডিটি বা বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা হতে পারে। কারণ, তখন পাকস্থলী বিশ্রামে থাকে।
শীতের রাতে আরামে কে না ঘুমাতে চায়? কিন্তু ভরপেট খেয়েই বিছানায় গেলে ঘুম আসতে চায় না। পেট ভরা থাকলে শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বেড়ে যায় এবং শরীর খাবার হজম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে গভীর ঘুম হয় না। অন্যদিকে পেট একটু খালি থাকলে শরীর ঘুমের মধ্যে নিজেকে মেরামত করার সুযোগ পায়। সকালে উঠে দেখবে শরীর একদম ঝরঝরে লাগছে।
শীতকালে রোদ কম থাকায় আমাদের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন হরমোন কমে যায়। ফলে মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায় অকারণে। একে বলে সিজনাল এফেক্টিভ ডিজঅর্ডার। ঠিক সময়ে খাওয়াদাওয়া করলে আমাদের শরীরের হরমোনগুলো ভারসাম্য বজায় রাখে এবং মনও ফুরফুরে থাকে।
রাতের খাবার খাওয়ার সবচেয়ে আদর্শ সময় হলো সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে খাওয়া। জানি, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সন্ধ্যা ৭টায় রাতের খাবার খাওয়াটা একটু কঠিন। কোচিং বা খেলাধুলা শেষ করে আসতে আসতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে তুমি ঘুমানোর অন্তত ২ থেকে ৩ ঘণ্টা আগে খেয়ে নিতে পারো। অর্থাৎ তুমি যদি রাত ১১টায় ঘুমাও, তবে রাত ৮টার মধ্যে খাওয়া শেষ করে পড়তে বসতে পারো।
একটা পুরোনো প্রবাদ আছে—সকালের নাশতা করো রাজার মতো, দুপুরে খাও প্রজার মতো আর রাতের খাবার ভিখারির মতো। শীতকালে এটা মেনে চলা খুব জরুরি। সকাল ও দুপুরে একটু ভারী খাবার খাও, কারণ তখন দিনের আলো থাকে এবং তুমি হাঁটাচলা করো। রাতে বিরিয়ানি বা রিচ ফুড না খেয়ে স্যুপ, সবজি, রুটি বা গ্রিল করা খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে পারো। প্রতিদিন একই সময়ে খাওয়ার অভ্যাস করো। আজ ৭টায় আর কাল ১১টায় খেলে আমাদের দেহঘড়ি ভড়কে যাবে।
মনে রেখো, শীতের রাতে শুধু লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানোটাই আরামের নয়, ঠিক সময়ে পেটকে আরাম দেওয়াটাও জরুরি!
সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট