অঘ্রান এসেছে আজ
ভোরে যখন পাখি ডাকে, প্রভাতিয়া লাগে গাছের শাখায়-পাতায়, তখন আলস্যভরে চোখ খুলে সোনালি আকাশের দিকে তাকাই, নতুন এক পৃথিবী আবিষ্কার করি। শীতের বার্তা নিয়ে এ দেশে হেমন্ত আসত আমাদের ছেলেবেলায়। ভোরের সূর্যটা এ সময় একটু বেশিই সোনালি; লাল নয়, হলুদও নয়। সঙ্গে হালকা শীত, ভোরের কুয়াশা ভেদ করে যখন সোনাঝরা রোদ উঁকি মারে পূর্ব দিগন্তে, তখন আক্ষরিক অর্থেই যেন স্বর্গ নেমে আসে বাংলার গাঁয়ে, মাঠে, নদীর বাঁকে, পাহাড়ের কোলে কিংবা ধু ধু প্রান্তরে। পথের দুধারে কমলা-সাদা বনফুলের ঝোপ হেসে ওঠে শিশিরের স্পর্শসুখে। মেঠোপথে কৃষক লাঙল কাঁধে ছোটে মাঠপানে। শিউলিতলায় ভোরবেলায় কাজী নজরুলের ‘পল্লীমেয়ের’ চকিত পদচারণ শুরু হয়, আঁচল ভরে ওঠে লাল-সাদা শিউলি ফুলে।
এরপর সূর্যের আলো যত সাদা হতে শুরু করে, কোলাহল বাড়তে থাকে গাঁয়ে, মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন, গোয়ালে কিংবা উঠানে। ভোরের কাক কিংবা ভাতশালিকের দল ভিড় জমায় গৃহস্থের উঠানে। ভোররাতে ক্ষণে ক্ষণে ডেকে ওঠা মোরগগুলো ততক্ষণে ছাড়া পেয়েছে, মুরগির ছানারা মায়ের পিছু পিছু ছুটে চলেছে খাবারের সন্ধানে। বেলা একটু একটু বাড়ে, কুয়াশা বিদায় নেয়, ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দুগুলো সোনালি রোদের উষ্ণতার কাছে হার মানে, বিলীন হয়। গোটা পৃথিবী তখন জেগে ওঠে আড়মোড়া ভেঙে।
বাংলার প্রকৃতি ‘কোন্ পাথারের ওপার থেকে’ হেমন্তকে ডেকে আনে। হেমন্ত আসে খেসারি আর কলাই ফুলের রেণুতে শিশিরবিন্দু ছিটিয়ে, সাঁঝ সকালে নদীর কূলে। হেমন্ত আসে, তাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে হলুদ গাঁদা ফুল, সবুজ পাতার খামের ভেতর চিঠি লিখে। এই হেমন্তের একটা প্রামাণ্য দলিল হলো সুফিয়া কামালের ‘হেমন্ত’ নামে কালজয়ী কিশোর কবিতা।
গাঁয়ের ছেলে আমি, হেমন্তের রূপ-রস-গন্ধ গায়ে মেখে বড় হয়েছি। তবু সেই হেমন্ত কি আমি চিনতাম ভালো করে, যদি না কবি সুফিয়া কামাল ঠিক ওইভাবে হেমন্তকে চিনিয়ে দিতেন! বড় হয়ে জীবনানন্দ দাশ আরও কতভাবেই না চেনালেন। ‘অবসরের গান’ কবিতায় তিনি লিখলেন—‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের খেতে;/ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,/ তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান...।’
২
চঞ্চল ছেলেরা, সবাই সাতসকালে পড়তে বসে না। খাপড়া কিংবা ডাঙ্গুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে লোকের ফাঁকা উঠানে, নির্জন কোনো খামারে, কিংবা পোড়ো ভিটেয়। যতজন খেলে, তার চেয়ে বেশি ভিড় জমায় খেলা দেখার জন্য। বেলা বাড়তে থাকে, পাড়া মুখর হয়।
এ দেশে হেমন্ত আন্ডাররেটেড ঋতু। অথচ হেমন্তের আবহাওয়ায় সৌন্দর্যে হেমন্ত মোটেও ঋতুরাজ বসন্তের চেয়ে পিছিয়ে নয়। না অতি শীত, না উষ্ণ—এমন জল–হাওয়া গ্রামীণ পরিবেশে আমার মনও আজ কেমন কেমন করে! গ্রীষ্মের ঘুঘু ডাকা দুপুরের মতো অলস নয় হেমন্তের দুপুর, সূর্যের আলোর সব রং গায়ে মেখে আমন ধানের খেতগুলো যেন সোনালি উল্লাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে। কৃষকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন সেই ধান কাটায়।
নব্বইয়ের দশকেও আমন ধান মাড়াই হতো গরুর সাহায্যে। গৃহস্থবাড়ির উঠানে। এক জোড়া গরুকে গলায় গলায় বেঁধে উঠানে ছড়ানো ধানের ওপর ঘোরানো হতো। গরু জোড়া ধানের গাছ মাড়িয়ে খড় থেকে আলাদা করে দিত ধান। এখান থেকেই এসেছে ‘মাড়াই’ শব্দটি। এটা এখন সব খাদ্যশস্যের জন্য ব্যবহার করা হয়। আজ ধান মাড়াইয়ের পদ্ধতিতে এসেছে পরিবর্তন। পায়ে বা ইঞ্জিনের সাহায্যে ঘোরানো ড্রাম মেশিনের সাহায্যে ধান মাড়াইয়ের রীতি চালু আছে, তবে হলার মেশিন এসে আরও সহজ করে দিয়েছে কাজটা। কিন্তু হেমন্তের সেই গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ের দৃশ্য আজও আমার স্মৃতিকোষে অনুরণন তোলে।
অঘ্রানে রবি ফসল নিজেদের স্বরূপ মেলতে শুরু করে। মাঠে বাড়ে কৃষকের ব্যস্ততা। গম কিংবা মসুরখেতের ছানাপোনারা নিতান্তই শিশু। শর্ষেখেতেও হলুদ দ্যুতি আসতে অনেক বাকি। তবে হলুদ ফুলে ফুলে ভরে যায় কলাইখেত, মাঝেমধ্যে আগাছার মতো অসময়ে জন্মানো পাটের ফুলও হলুদের দ্যুতি নিয়ে টেক্কা দেয় কলাই ফুলকে। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা সেসব গাছে তখনই ফল ধরার মৌসুম। মটরশুঁটির ফুলগুলো মোহনীয়, লাল-গোলাপি। চেহারায় একই রকম হলেও খেসারির ফুল গাঢ় নীল। হেমন্তের বিকেলে এদের মধ্যে চলে রূপের প্রতিযোগিতা। কলকাসুন্দার কমলা ফুল সারা দিনেই সমান উজ্জ্বল। তাই বোধ হয় ‘হেমন্ত’ কবিতায় সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘খেসারি আর কলাই ফুলে/ আনল ডেকে কুয়াশাকে/ সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।’
দুপুরের পর সূর্য দ্রুতই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে, সাদা রোদ আবারও রূপ বদল করে সোনালি আভায়। গাছিরা ছোটেন বাগান পানে, খেজুরগাছের প্রথম কাটটা শুরু হয় অগ্রহায়ণেই। ধারালো দা আর মাটির ভাঁড় নিয়ে নিপুণ দক্ষতায় গাছ কাটেন গাছি। তারপর সারা রাতের অপেক্ষা। পরদিন সকালেই ওঠে মৌসুমের প্রথম নলেন গুড়। সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘আরও এল সাথে সাথে/ নূতন গাছের খেজুর রসে/ লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা/ মিষ্টি রোদে খেতে বসে।’
হেমন্তে একসময় নবান্ন উৎসব হতো। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় সেটা পাইনি। তার কত আগেই বন্ধ হয়ে গেছে কে জানে! নতুন ধান ওঠে, উৎসব না হলেও পিঠাপুলির তৈরির হিড়িক চলে। শীতের মতো অতটা না হলেও এ সময় খেজুরগাছে অল্পস্বল্প রস পাওয়া যায়, পাওয়া যায় নতুন নলেন গুড় ও জমাট পাটালি। হেমন্তের গুড়ের যে স্বাদ-গন্ধ, তার চেয়ে একেবারেই অন্য রকম হেমন্তের গুড়ের স্বাদ। একেবারে নতুন, একেবারে টাটকা। সকালের হেমন্তের রোদ ভারি মিষ্টি। উঠানে বা বারান্দায় মাদুর পেতে আমরা সে রোদ পোহাই, সঙ্গে মিষ্টি পিঠার স্বাদ অন্বেষণ করি, যে স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে।
৩
এ দেশে হেমন্ত আসে মিষ্টি মধুর বার্তা নিয়ে। কিন্তু আমাদের কৈশোরে হেমন্ত ছিল বুক ঢিপ ঢিপ করা ঋতু। কারণ, স্কুল খোলা আর সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। এ সময় সকালে শিশির পড়ে, মেঠোপথের দুধারে দূর্বাঘাসগুলো বেড়ে উঠেছে শরতের শেষ বর্ষণের পানি খেয়ে। হেমন্তে তাদের তাজা রেখেছে মুক্তোর মতো জমা হওয়া শিশিরবিন্দু। আমরা ইচ্ছা করেই মাঝরাস্তা এড়িয়ে দূর্বাঘাসের ওপর দিয়ে চলতাম, পা শিশিরে ভেজাতে। সুফিয়া কামালের কবিতার মতোই সুন্দর সে সকাল—‘সকাল বেলায় শিশির ভেজা/ ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে/ হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়/ শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।’
ইছামতীর কূলে খালের ধারে ছিল বিশাল বড় বড় গাছের এক আমবাগান। সেখানে গিয়ে বসে থাকতাম। রাজ্যের গল্প। সেই কৈশোরেই ক্রিকেট, রাজনীতি আর সিনেমার গল্পে আমাদের সকালটা কাটত। গল্প করতাম আর মাছ ধরা দেখতাম। দুই খন্দকার ভাই, গুটকে আর ফুলু মাছ ধরত। ছিপ দিয়ে। পাকা পাকা ট্যাংরা উঠত ছিপে, হলুদ রঙের বড় ট্যাংরা।
মাছ যে খুব বেশি উঠত তা নয়, কিন্তু ট্যাংরা বড্ড দামি মাছ। দুই ভাই আধা কেজির টার্গেট নিয়ে খুব ভোরে চলে আসত। জায়গা নিয়ে মাঝেমধ্যে তাদের ঝগড়া লাগত। তাদের ওই প্রতিযোগিতা দেখলে কে বলবে এরা আপন দুই ভাই। আমরাও বুঝতাম না। সেই হিম হিম সকালে ওদের মাছ ধরা দেখতাম তন্ময় হয়ে। তারপর একসময় শীতে কাঁপতে কাঁপতে গোসল করে উঠে পড়তাম, রওনা দিতাম স্কুলের উদ্দেশে।
স্কুলের শুরুটা হতো অ্যাসেমব্লি দিয়ে। সেখানে জাতীয় পতাকা সামনে রেখে গাওয়া হতো জাতীয় সংগীত। আমরা ঠোঁট মেলাতাম তাতে। সেখানেও হেমন্ত আসে—‘ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি/ আমি কী দেখেছি, মধুর হাসি…’
৪
হেমন্তের সকাল যতটা সুন্দর, পড়ন্ত বিকেলের রূপ তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। নদীর পাড়ে, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ছায়াগুলো শেষ বিকেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হতে শুরু করে। সূর্যও পশ্চিমাকাশে হেলতে হেলতে নিজের আকার বাড়িয়ে নেয় খানিকটা। রাখালেরা ঘরে ফেরে গরু কিংবা ছাগলের পাল নিয়ে। তাদের পায়ের খুরে খুরে ধুলো ওড়ে। তখনই বড় থালাটির মতো সূর্যটা হঠাৎ মুখ লুকোয় দিগন্তের ওপারে। ঝপ করে সন্ধ্যা নামে বাংলার মাঠে, প্রান্তরে, শহরে, পাহাড়ে, জঙ্গলে। ধূসর, মলিন সন্ধ্যা। এর সঙ্গে কুয়াশা আর গবাদিপশুর খুরের ধুলো মিলেমিশে যে ধূসর পৃথিবীটার জন্ম দেয়, তার নামই এ দেশে গোধূলি, বিদেশে টুইলাইট।
হেমন্তের সন্ধ্যা গাঢ় হতে সময় নেয় না। তার আগে মেঠোপথে একঝলক দর্শন দিয়ে যায় দলছুট শিয়াল, বনবিড়াল, বেজি, গুইসাপেরা। মাঠে চরে বেড়ানো ঘাসবনের পাখিরা, গৃহস্থের দুঃসাহসী মোরগের দল কিংবা অতি উৎসাহী ছাগলছানারা এ সময় ভুল করে, সেই ভুলের সুযোগটাই নেয় সন্ধ্যার এই সন্ধানী শিয়াল-বিড়ালেরা।
রাত নামে, চাপ চাপ অন্ধকার জমা হয় গৃহস্থের উঠানের নিমগাছে, জোনাকিরা ঝিকিমিকি আলোতে অন্ধকার তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। ছেলেমেয়েরা পড়তে বসে, জোরে জোরে সুর করে পড়ে। পাড়া মুখর হয়। বাংলার প্রকৃতিতে নেমে আসে হাজার বছরের পুরোনো হেমন্তের রাত।
শৈশব ছেড়ে কৈশোর, তারপর যৌবন, এখন আমার মাঝবয়স। পৃথিবী বদলে গেছে। বদলে গেছে দেশ। মানুষও বদলায়, কারণে–অকারণে বদলায়। আমরাও হয়তো বদলে গেছি। অথচ আয়ুরেখা পেরিয়ে যাওয়ার পরও আবার পৃথিবীতে ফিরতে মন চায়। হোক সে অলীক কল্পনা, তবু জীবনানন্দের ভাষায় আমি এবং আমরা ফিরতে চাই, ‘এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’—বারবার—শতবার।