সাহস পেলাম যেখান থেকে
প্রথম কিশোর আলোর মিটিংয়ে গিয়েছিলাম ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। স্বেচ্ছায় যাইনি। বাবা ঠেলে পাঠিয়েছিল। বলেছিল, শুধু সায়েন্সের প্র্যাকটিক্যাল করতে করতে বিকেল পেরিয়ে গেলে হবে? হলি ক্রস কলেজে তখন (এখনো হয়তো) বিকেল পর্যন্ত প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হতো। সকালে ক্লাস, দুপুরে টিফিন, তারপর বিকেলে কেমিস্ট্রি বা ফিজিকস ল্যাবের জানালা দিয়ে দেখতাম, রোদ পড়ে গেছে। ওই তো বাস্কেটবল কোর্টে খুঁটির ছায়া এবার দ্বিগুণ হলো!
তো সে রকম রুটিনবদ্ধ একটা সময়ে বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিল কিশোর আলোর মিটিং কিআড্ডায়। তার আগে আমি আসলে ক্লাসরুম-কোচিং-দাওয়াত-অলিম্পিয়াডের বাইরে তেমন কোথাও যাইনি। মা–বাবা বইমেলা, মহিলা সমিতি, গানের অনুষ্ঠান, জাদুঘরে নিয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। সেসব জায়গায় সিনেমা-শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আলোচনাও হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু খুব খেয়াল করে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। যদি কখনো শুনেও থাকি, খুব দ্রুতই বুঝতে পেরেছি আলোচনাটা ঠিক আমার (বা আমাদের বয়সী কারও) কথা ভেবে করা হচ্ছে না। ঢাকা তখন অমনই ছিল। আমার বয়সীদের, মানে স্কুল-কলেজে পড়া কিশোর-কিশোরীদের যাওয়ার তেমন কোনো জায়গা ছিল না। রেস্টুরেন্টে দল বেঁধে খেতে যাওয়ার রেওয়াজ তখনো পুরোদমে চালু হয়নি অথবা হয়তো আমরাই ও রেওয়াজ থেকে খানিকটা দূরে ছিলাম।
প্রথমবার কিশোর আলোর মিটিংয়ে গিয়ে আমি তাই ভীষণ অবাক হলাম। ওয়ান্ডারল্যান্ডে অ্যালিস যেমন হয়েছিল, অবাক হওয়ার পরিমাণটা অনেকটা সে রকম। অবাক হওয়ার প্রথম কারণ হলো মিটিংয়ের বসার ধরন। দু-চারজন অথবা খুব বেশি হলে পাঁচজন অতিথি বা বক্তা হয়তো মাঝেমধ্যে চেয়ারে বসে ছিলেন, তবে দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁদের মধ্যে টেবিলে কিংবা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার আগ্রহই বেশি। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে যখন কেউ কথা বলছেন, তাঁরাও মিটিং রুমের সামনের দিকে একটা টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলে যাচ্ছেন। আর রুমভর্তি যত কিশোর-কিশোরী, তারা বসে আছে মেঝেতে। সেই বসার ভঙ্গিতে খুব যে সারিবদ্ধতা আছে, তা নয়। তবে একধরনের আরামদায়ক ছন্দ বোধ হয় ছিল। অথবা আমার মনে হয়েছিল। এই যে স্বাচ্ছন্দ্যে মেঝেতে বসে, এত নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে আড্ডার ভঙ্গিতে মিটিং করা—এই পুরো বিষয়টা একদম প্রথম পরিচয়ে মনে গেঁথে গেল।
তারপর অবাক হওয়ার পরিমাণ আরও বাড়ল আলাপের বিষয়বস্তু দেখেশুনে। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কিআর গত সংখ্যার কী ভালো লেগেছে, কী খারাপ লেগেছে। ভালো লাগার তালিকা শুনে অবাক হইনি। ভালো তো কত কিছুই হয়েছে। একদম আমাদের জন্য লেখা এমন নতুন গল্প-কবিতা-ফিচার পেয়ে আমরা সবাই তখন কমবেশি মুগ্ধ, আনন্দিত। অবাক হলাম সত্যি সত্যি যখন আমার চেয়ে বয়সে ছোট, স্কুলপড়ুয়া একজন নাকের ওপর সবুজ চশমাটা ঠেলে দিয়ে একনাগাড়ে বলে গেল এবারের প্রচ্ছদটা কেন আগের প্রচ্ছদের মতো ‘অত ভালো’ হয়নি। মনে আছে, তার ঠিক পরেই মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল আর গোলাপি শার্ট পরা একটা বাচ্চা মেয়ে খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে জানতে চেয়েছিল, ষোলোটা পৃষ্ঠা ধরে বিজ্ঞাপন কেন? প্রশ্ন যাঁদের করা হচ্ছিল, তাঁরা বয়সে বড়, বেশ বড়। তাঁদের পদবিও বেশ ভারী ভারী, সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদকসহ আরও নানা কিছু। কিন্তু তাঁরা উত্তর দিতেন। প্রশ্নকর্তার বয়স কম বলে প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়ার কোনো ঘটনা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বরং দেখেছি, বিজ্ঞাপন কেন প্রয়োজনীয় হয়, ম্যাগাজিনে কেন সেসব রাখতে হয়, না রাখলে কী ঝামেলা হয়, সেসব সত্যি সত্যি একজন ধৈর্য ধরে বুঝিয়ে বলছেন। প্রচ্ছদের সমালোচনাও মেনে নিতে দেখেছি, দেখেছি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে, প্রচ্ছদে কী থাকলে ভালো লাগবে—আঁকা ছবি নাকি ক্যামেরায় তোলা ছবি?
এই প্রশ্ন-উত্তর, ভালো লাগা-খারাপ লাগা, আলোচনা-সমালোচনার পুরো পরিবেশটাই আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করেছিল। যে সম্পাদকেরা অত লেখার মধ্য থেকে গুটিকয় লেখা বেছে নিয়ে ম্যাগাজিনটা সাজান, তাঁদের সামনে দাঁড়িয়েই যে অমন সরাসরি বলে ফেলা যায় ‘গল্প কম হয়ে গিয়েছে’, সেটা ছিল আমার ভাবনার জগতের সম্পূর্ণ বাইরে। ছোটবেলা থেকে দেখেছি পত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনা ছাপা হয়। কোন সিনেমা ভালো লাগল, কেন লাগল, কোন কবিতা কবিতাই হয়নি, কেন হলো না—সেসব নিয়ে পত্রিকায় জ্ঞানী-গুণীরা লেখেন। কিন্তু সে আলোচনা যে এমন শান্তভাবে সামনাসামনিও হতে পারে, আর তার চেয়ে বড় কথা, সে আলোচনায় যে স্কুল-কলেজে পড়ুয়াদেরও ডাকা যায়, তা আমি অন্তত ওই বয়সে জানতাম না। এখন ভেবে দেখলে বুঝি, ১৮ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে সেই জানাটা খুব জরুরি ছিল। আর কিছু না হোক, সেখান থেকে অন্তত এটুকু জেনেছিলাম, পৃথিবীর সবার যা ভালো লেগেছে, তা আমার না-ও লাগতে পারে। আর সেই মতামতটুকু দেওয়ার জন্য আমার কোনো নির্দিষ্ট বয়সে, শ্রেণিতে বা অবস্থানে পৌঁছানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকেই চাইলে নির্ভয়ে বলা যায়, সত্যজিৎ রায়ের চিড়িয়াখানা সিনেমাটা আমার একদম ভালো লাগেনি। তাতে সত্যজিৎ রায় বা উত্তম কুমার বা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাহাত্ম্য কমে না, আমারও গুরুত্ব বাড়ে না। তাতে স্রেফ আমার মতামতটাই জানানো হয়। আর মতামতের কাজ তো ওটুকুই! সময়-সুযোগ-উপলক্ষ পেলে সে মতামত নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার খানিকক্ষণ আলোচনা হয়তো হতে পারে, এর বেশি আর কী?
অবশ্য প্রথম মিটিংয়ের মতো সব মিটিংই যে ‘খুব ভালো’ লেগেছিল, তা কিন্তু নয়। একবার মিটিং শেষে বাসায় ফিরেছিলাম খুব রাগ কিংবা অভিমান নিয়ে। তখন কিআর নির্বাহী সম্পাদক সিমু নাসের। মিটিংয়ের অনেকটা জুড়েই তিনি সঞ্চালনা করতেন, নতুন শোনা গান শোনাতেন, একটানা আসিমভ পড়ে যাওয়ার গল্প বলতেন আর প্রশ্ন করতেন। এখন ভেবে দেখলে বুঝি, সিমু ভাই প্রায় সারাক্ষণই প্রশ্ন করতেন। টিনটিন কার কার পছন্দ, কোন গল্পটা বেশি পছন্দ? ছবি ভালো লাগেনি, কেন লাগেনি? গল্প পড়তে চাও, কার গল্প হলে ভালো হয়? অরিগ্যামি সেকশনটা আবার চাও, এখানে কে অরিগ্যামি পারে? তো সে রকম প্রশ্ন করতে করতেই কী এক প্রসঙ্গে যেন সিমু ভাই একবার বললেন, ‘এখন তোমরা যারা স্কুল-কলেজে পড়ো, তোমরা তো সারাক্ষণ শুধু ফোন ইউজ করছ। তোমরা লিখতে চাও না, গল্প বলতে চাও না, নতুন কিছু তৈরি করতে চাও না। সারা দিনরাত এমন ফোন নিয়ে থাকতে তোমাদের সত্যি ভালো লাগে?’
প্রশ্নটা একদম হুবহু এখন আর মনে নেই। মাঝে ১১ বছর সময় পেরিয়েছে, স্মৃতি নিশ্চয়ই নিজেকে নিয়ে অনেক রকম ভাঙচুর করেছে। কিন্তু খুব ভালোভাবে মনে আছে, সারাক্ষণ ফোন ব্যবহার করা–সংক্রান্ত অভিযোগটা প্রশ্নে তীব্রভাবেই ছিল। এখন ভাবলে বুঝি, হয়তো আমাদের কাছ থেকে আশানুরূপ পরিমাণ লেখা পাওয়া যাচ্ছিল না! কিংবা স্রেফ অনুপ্রেরণা দেওয়ার খাতিরেই হয়তো প্রশ্নটা করে থাকবেন। কিন্তু অমন প্রশ্ন শুনে আমার হয়েছিল ভীষণ অভিমান। বাসায় এসে খাবার টেবিলে ঘোষণা দিয়েছিলাম, লেখাই তো! এ আর অত কঠিন কী! দেব লেখা! মা–বাবা মুখ টিপে হেসেছিল।
অবশ্য হাসলেই কী! ওই অভিমান থেকেই তো প্রথম লেখাটা লিখলাম। কত শব্দ হবে সে লেখার? ৪০০? কিংবা ৫০০ হয়তো! তবে সেটুকু লিখতে বসেই দেখলাম, মনের (কিংবা মস্তিষ্কের) গভীর থেকে ঠিকঠাক শব্দ খুঁজে আনার বিষয়টা আসলে তেমন সহজ নয়। কোন বাক্যটা দিয়ে শুরু করলে ভালো হয়, তার কোনো নিয়মনীতি নেই। এ তো বাংলা দ্বিতীয় পত্রের রচনা না যে ভূমিকা-বর্ণনা-উপসংহারের ছকে বাঁধা নিয়ম মেনে না লিখলে কেউ খাতায় শূন্য বসিয়ে দেবে! পুরো সিদ্ধান্তটা আমাকেই নিতে হবে। দু-চার লাইন লিখে আবার পড়ে দেখতে হয়, ভাবতে হয়, পাঠক হলে আমার কেমন লাগত? লেখা পড়ে কিছু বোঝা যাচ্ছে? পড়তে কি ভালো লাগছে? নাকি বোরিং হয়ে যাচ্ছে? কত রকমের প্রশ্ন! কত রকমের দ্বিধা!
সেই ৪০০ কিংবা ৫০০ শব্দের লেখাটা কিআর পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম হয়তো আগেও ফর্মে-সার্টিফিকেটে দেখেছিলাম, কিন্তু লেখক হিসেবে সেই প্রথম নিজের নাম দেখা! পুরো বিষয়টার সঙ্গে একটা অদ্ভুত ফুরফুরে আনন্দ আছে! হঠাৎ যদি একটা ড্রয়ার খুলে দেখতে পাও, যা কিছু তোমার সবচেয়ে প্রিয়, সব সেখানে সাজিয়ে রাখা, তখন যেমন আনন্দ হবে, তার সঙ্গে এই আনন্দের খুব মিল। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, এখনো, এই এত বছর পরেও যখন কোথাও শিরোনামের নিচে লেখক হিসেবে নিজের নাম দেখি, সেই একই রকম ফুরফুরে আনন্দ হয়। একদম হুবহু একই রকম আনন্দ!
কিআ ছাড়া এই আনন্দটার সঙ্গে কি আমার কখনো পরিচয় হতো? বোধ হয় না। তেত্রিশ মাথাওয়ালা যে গাছটার কথা তিন সপ্তাহ ধরে আমার মাথায় ঘুরছে, সেটাও যে একটা গল্প হতে পারে, সেটা তো আমি কিআর মিটিংয়ে যাওয়ার আগে জানতাম না। অত আত্মবিশ্বাস আমার ছিল না। এখনো লিখতে বসে সারাক্ষণ ভাবছি কিচ্ছু হচ্ছে না, হবেও না। কিন্তু যে কথাটা আমার মনে হলো, সেটা শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে লিখে ফেলার জন্য যে সাহসটুকু দরকার, সেটুকুও আসলে আমি কিআ থেকেই পেয়েছি। আমার ধারণা, একটা গল্পকে কল্পনা থেকে লিখিত শব্দে রূপান্তর করার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় অনেক রকম বাধা থাকে। ধৈর্য, মনোযোগ, ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সেসব বাধার অনেকগুলোই হয়তো পার করা যায়, তবে সাহসই আদতে বাধাগুলো পার হওয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি। মার্কিন কবি মায়া অ্যাংলো বলেছিলেন, না বলা গল্প বয়ে বেড়ানোর মতো বেদনা নাকি আর নেই। মায়ার প্রেক্ষাপট খুব ভিন্ন হলেও তাঁর কথাটি আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। যা লিখব, তা খুব ভালো হয়তো হবে না, হয়তো ছাপা হওয়ার মতো দারুণ কিছুও হবে না, তবে কিআ থেকে পাওয়া সাহসটুকু সঙ্গে নিয়ে লেখাটা লিখে তো ফেলতে পারব! আর কিছু না হোক, সে লেখা কাউকে পাঠিয়ে জানতে তো চাইতে পারব, দেখো তো কিছু হলো কি না! ভালো কথা, যাদের লেখা দিয়ে ‘হলো কি না’ জানতে চাওয়া যায়, তাদের সঙ্গেও আমার কিআ সূত্রেই পরিচয়।
‘কিশোর আলো’ নামটা সামনে এলে হুড়মুড়িয়ে অনেক কিছু একসঙ্গে মনে পড়ে। কিছু প্রিয় মুখ। কিছু প্রিয় স্মৃতি। আর স্মৃতি বোধ হয় আসলে আমার মতোই অঙ্কে দুর্বল। তাই কিআর ১২ বছর পূর্তিতে এসেও মনে হচ্ছে, এত সময় কখন গেল? এ তো সেদিনের কথা! কিআকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। যে সাহস আর আনন্দের সঙ্গে আমার কখনো পরিচয় হওয়ার কথা ছিল না, সেসবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ শব্দটা বড় বেশি আনুষ্ঠানিক। আসলে বলতে চাইছি, যে সাহস আর আনন্দকে আমি কিশোর আলোতে খুঁজে পেয়েছিলাম, তাদের সঙ্গে নতুন পাঠকদেরও দেখাসাক্ষাৎ হোক। শুভকামনা!
তাবাস্সুম ইসলাম, লেখক ও পিএইচডি গবেষক, আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য