ভূতের সঙ্গে অঙ্কের খেলা: প্রথম পর্ব
স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল রোহান। সে মনে মনে ভাবল, এসব স্বপ্নে আমাকে সব সময় বোকা দেখায়। যেমন ধরো, সে স্বপ্ন দেখবে একটা বিশাল কুৎসিত মাছ তাকে গিলে ফেলছে। ঘুম ভাঙার পরও মাছের পেটের সেই জঘন্য পচা গন্ধ তার নাকে লেগে থাকে! আবার সে স্বপ্নে দেখে, একটা অন্তহীন স্লাইড বা পিচ্ছিল পথে সে ওপর থেকে নিচে পিছলে পড়ছে তো পড়ছেই। গতি বেড়েই যাচ্ছে। যতই সে চিৎকার করে বলে, ‘থামো! বাঁচাও!’ কোনো লাভ হয় না। স্লাইড চলতেই থাকে, যতক্ষণ না ঘামে ভিজে তার ঘুম ভেঙে যায়।
সে কিছু পেতে চাইলে স্বপ্নগুলো তার সঙ্গে আরও বাজে তামাশা করে। একবার তার খুব শখ হলো একটা রেসিং সাইকেল কেনার, যেটাতে ২৮টি গিয়ার থাকবে। সে রাতে স্বপ্ন দেখল, ঠিক ওই সাইকেলটা তাদের বাড়ির বেজমেন্টে রাখা। স্বপ্নটা এত পরিষ্কার ছিল যে বিশ্বাস করা কঠিন। সাধারণত স্বপ্নের কথা মানুষের মনে থাকে না, কিন্তু রোহানের সব নিখুঁতভাবে মনে আছে। সাইকেলটার রং চকচকে বেগুনি। পড়ার ঘরের ঠিক পাশেই ওটা রাখা আছে। এমনকি সাইকেলের তালার গোপন নম্বরটাও তার মুখস্থ হয়ে গেল: ১২৩৪৫। এমন স্বপ্ন কি ভোলা যায়?
মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে টলতে টলতে সে পাজামা পরেই বাইরে বেরিয়ে গেল। কিন্তু সেখানে পড়ার ঘরের পাশে কী পেল জানো? একটা মরা ইঁদুর! এটা রীতিমতো ধোঁকা!
শেষমেশ রোহান স্বপ্নের এই শয়তানি থেকে বাঁচার একটা বুদ্ধি বের করল। যখন স্বপ্ন শুরু হতো, সে ঘুমের মধ্যেই ভাবত, ‘আরে, এ তো সেই পচা মাছটা! আমি জানি এখন কী হবে। ও আমাকে গিলে ফেলবে। কিন্তু আমি এটাও জানি যে এটা শুধু স্বপ্ন। কারণ, বাস্তবে মাছ মানুষকে গিলতে পারে না।’
অথবা স্লাইডে পড়ার সময় সে ভাবত, ‘এই তো, আবার পিছলে পড়ছি। কিছু করার নেই। আমি থামতেও পারব না। তবে সত্যি বলতে, আমি তো আর বাস্তবে পড়ছি না।’
মাঝেমধ্যে সেই দারুণ রেসিং সাইকেলটা দেখে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখা। কখনো দেখত টেবিলের ওপর রাখা একটি কম্পিউটার গেম। কিন্তু সে বুঝত, এটা একটা ফাঁদ। সে সাইকেলের দিকে ফিরেও তাকাত না, উল্টো ঘুরে যেত।
কিন্তু সে যা–ই করুক, স্বপ্নগুলো বারবার ফিরে আসত। আর এটাই ছিল তার আসল সমস্যা।
হঠাৎ এক রাতে সব বদলে গেল। সেখানে হাজির হলো দ্য নাম্বার ডেভিল বা সংখ্যার ভূত!
রোহান তো মহাখুশি। যাক, সেই রাক্ষুসে মাছ আর অন্তহীন স্লাইড থেকে মুক্তি মিলল। এবার সে দেখল একটা বিশাল সবুজ মাঠ। তবে মজার ব্যাপার হলো, ঘাসগুলো এত লম্বা যে মনে হচ্ছে আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে, অন্তত তার চেয়ে অনেক উঁচু তো বটেই।
আর কী দেখল জানো? একটা বিশাল গুবরে পোকা তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। ঘাসের ডগায় বসে আছে একটা শুঁয়াপোকা। আর একটা পালংশাকের পাতার ওপর ফড়িংয়ের সমান এক বুড়ো লোক বসে দোল খাচ্ছে আর জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘তুমি কে?’ জিজ্ঞাসা করল রোহান।
লোকটা অবাক করা উঁচু গলায় উত্তর দিল, ‘আমি সংখ্যার ভূত!’
এমন পিচ্চি একটা লোকের কাছ থেকে বাজে বকবক শোনার ইচ্ছা ছিল না রোহানের। ‘প্রথমত, নাম্বার ডেভিল বা সংখ্যার ভূত বলে কিছু হয় না।’
‘তাই নাকি? আমি যদি নাই থাকি, তবে আমার সঙ্গে কথা বলছ কীভাবে?’
‘তা ছাড়া...সংখ্যা বা অঙ্কসংক্রান্ত সবকিছু আমি ঘৃণা করি।’
‘তাই? কিন্তু কেন জানতে পারি?’
‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি কখনো স্কুলে যাওনি। নাকি তুমি নিজেই একজন শিক্ষক?’
‘আচ্ছা বলো তো, যদি ২ জন রুটিওয়ালা ৬ ঘণ্টায় ৪৪৪টা রুটি বানাতে পারে, তবে ৫ জন রুটিওয়ালা ৮৮টা রুটি বানাতে কত সময় নেবে?’
‘এর চেয়ে বোকা প্রশ্ন আর হয় না!’ রোহান বিরক্ত হয়ে বলল। ‘শুধু সময় অপচয়। এখান থেকে চলে যাও! দূর হও! হুশ!’
কিন্তু পিচ্চি ভূতটা তার কথা শুনল না। উল্টো একটা লাফ দিয়ে সে রোহানের ঠিক পাশে এসে পড়ল। রোহান তখন লম্বা ঘাসের মধ্যে বসে ধর্মঘট করছিল।
‘তোমার ওই রুটিওয়ালার গল্পটা কোথা থেকে এল? স্কুল থেকে নিশ্চয়ই?’
‘আর কোত্থেকে আসবে?’ বলল রোহান। ‘মিস্টার বাকের আমাদের নতুন শিক্ষক। ওনার গায়ে প্রচুর চর্বি। তাও সব সময় খিদে লেগেই থাকে। উনি আমাদের কঠিন সব অঙ্ক দেন ক্লাসে। যখন দেখেন আমরা মাথা নিচু করে অঙ্ক করছি, তখন উনি চুপিসারে বাক্স থেকে রুটি বের করে গপাগপ গিলতে থাকেন।’
‘বুঝেছি,’ সংখ্যার ভূতটা একটু হেসে বলল। ‘তোমার শিক্ষকের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু ওই ধরনের অঙ্কের সঙ্গে কোনো সম্পর্কও নেই আমার। তোমাকে একটা গোপন কথা বলি? সত্যিকারের গণিতবিদেরা কিন্তু যোগ-বিয়োগে খুব কাঁচা হন। তা ছাড়া ওসব করার সময়ও তাদের নেই। ওটার জন্য তো ক্যালকুলেটর আছেই। তোমারও নিশ্চয়ই একটা আছে?’
‘আছে তো, কিন্তু স্কুলে ওটা ব্যবহার করতে দেয় না।’
‘বুঝেছি,’ ভূতটা বলল। ‘সমস্যা নেই। একটু যোগ-বিয়োগ জানা ভালো। ব্যাটারি কখন ফুরিয়ে যায়, বলা তো যায় না। কিন্তু বাছা, গণিত এক অন্য জিনিস!’
‘তুমি আমাকে পটাচ্ছ,’ বলল রোহান। ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। তুমি যদি আমাকে স্বপ্নে হোমওয়ার্ক দাও, আমি চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলব। বলব, এটা শিশু নির্যাতন!’
‘তুমি যে এত ভীতু, জানলে কি আর তোমার স্বপ্নে আসতাম? আমি তো চেয়েছিলাম তোমাকে একটু চাঙা করতে। বেশির ভাগ রাতে যেহেতু আমার কোনো কাজ থাকে না, ভাবলাম তোমাকে ওই একঘেয়ে স্লাইড থেকে বাঁচাই।’
‘ওহ, ধন্যবাদ।’
‘যাক, তুমি বুঝেছ।’
‘কিন্তু তুমিও বুঝে রাখো, তোমাকে আমি কোনো সুযোগ দেব না। তুমি আমাকে বোকা বানাতে পারবে না।’
হঠাৎ ভূতটা ঘাসের ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠল। সে আর এখন ফড়িংয়ের মতো ছোট্ট রইল না।
‘ভূতের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে হয় না!’ সে গর্জন করে উঠল। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। রাগে সে পায়ের নিচের ঘাসগুলো সব মাড়িয়ে চ্যাপটা করে ফেলল।
‘দুঃখিত’, রোহান মিনমিন করে বলল। যদিও পুরো ব্যাপারটা আরও অদ্ভুত হয়ে উঠছে। ‘সংখ্যার ব্যাপারটা যদি মুভি বা সাইকেলের মতোই সহজ হয়, তাহলে তা শিখতে আলাদাভাবে ভূত লাগবে কেন?’
‘ঠিক ধরেছ, বাছা!’ ভূতটা বলল। ‘সংখ্যা বা অঙ্ক ভয় লাগে, কারণ এগুলো খুব সহজ। আর এটা প্রমাণের জন্য ক্যালকুলেটর লাগে না। শুধু একটা জিনিস দরকার, এক। আমি ১ সংখ্যার কথা বলছি। ১ দিয়ে তুমি প্রায় সবকিছু করতে পারো। পঞ্চাশ লাখ সাতশ তেইশ হাজার আটশ বারোর মতো বড় সংখ্যাকে যদি তুমি ভয় পাও, তাহলে তোমাকে শুধু এভাবে শুরু করতে হবে:
১ + ১
১ + ১ + ১
১ + ১ + ১ + ১
১ + ১ + ১ + ১ + ১
……………..
যতক্ষণ না পঞ্চাশ লাখ ইত্যাদি ইত্যাদিতে পৌঁছাও, ততক্ষণ চালিয়ে যাও। এখন বলো না যে এটাও খুব কঠিন। যেকোনো গাধাও এটা বুঝবে।
‘ঠিক আছে,’ বলল রোহান।
‘এখানেই শেষ নয়,’ যোগ করল ভূতটা। সে একটা রুপালি মাথাওয়ালা লাঠি তুলে রোহানের নাকের সামনে ঘোরাতে লাগল। ‘তুমি যখন পঞ্চাশ লাখ ইত্যাদি ইত্যাদিতে পৌঁছে যাবে, তখন চাইলে আরও এগিয়ে যেতে পারো। অসীম পর্যন্ত। সংখ্যার কোনো শেষ নেই।’
রোহান বুঝতে পারছিল না বিশ্বাস করবে কি না।
‘তুমি এত নিশ্চিতভাবে বলছ কীভাবে?’ রোহান জিজ্ঞাসা করল। ‘তুমি কি কখনো গুনে দেখেছ?’
‘না, দেখিনি,’ বলল ভূতটা। ‘প্রথমত, এটা গুনতে অনেক সময় লাগবে। দ্বিতীয়ত, এটার কোনো মানে হয় না। সময়ের অপচয়।’
রোহান বুঝল না কেন। ‘হয় আমি শেষ পর্যন্ত গুনতে পারব, সে ক্ষেত্রে অসীম বলে কিছু নেই। অথবা এর কোনো শেষ নেই, তাই আমি গুনতেও পারব না।’
‘ভুল!’ ভূতটা চিৎকার করে উঠল। তার গোঁফ কাঁপছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। রাগে মুখ লাল হয়ে গেছে।
‘ভুল মানে কী?’ জিজ্ঞাসা করল রোহান।
‘ওরে গাধা! বলো তো, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কতগুলো চুইংগাম চিবানো হয়েছে?’
‘আমার কোনো ধারণা নেই।’
‘আন্দাজ করো।’
‘হাজার কোটি বা বিলিয়ন বিলিয়ন হবে,’ বলল রোহান। ‘আমার বন্ধু ইরা, আনিসা, রাহিন, ক্লাসের বাকি সবাই, শহরের সবাই, দেশের সবাই, পৃথিবীর সবাই মিলে হয়তো ট্রিলিয়ন হবে!’
‘অন্তত ট্রিলিয়ন তো হবেই,’ ভূতটা বলল। তার মাথা একটু ঠান্ডা হয়েছে। এবার বলল, ‘আচ্ছা, ধরো সবাই মিলে সব চুইংগাম চিবিয়ে শেষ করে ফেলেছে। আর মাত্র একটা বাকি। আমি আমার পকেট থেকে আরেকটা বের করলাম, যেটা আমি নিজের জন্য রেখেছিলাম। তাহলে কী হবে? ওই ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন চিবানো চুইংগাম যোগ এক। বুঝলে তো? আমার গুনতে হবে না। আমার শুধু একটা পদ্ধতি দরকার, যা দিয়ে আমি যেকোনো সংখ্যার ব্যবস্থা করতে পারি। আর সেটা আমার কাছে আছে।’
ভূতের কথাগুলো ভেবে রোহান মানতে বাধ্য হলো, তার কথায় যুক্তি আছে। ‘যা-ই হোক, উল্টোটাও কিন্তু সত্য,’ ভূতটা যোগ করল।
‘উল্টো? মানে কী?’
‘সহজ,’ ভূতটা একগাল হেসে বলল। ‘অসীম বড় সংখ্যা যেমন আছে, তেমনি অসীম ছোট সংখ্যাও আছে। আর অসীম ছোট সংখ্যার পরিমাণও অসীম।’ এই বলে সে তার লাঠিটা প্রপেলারের মতো রোহানের মুখের সামনে ঘোরাতে লাগল।
মাথা ঘুরতে শুরু করল রোহানের। ঠিক স্লাইডে পড়ার সময়ের মতো অনুভূতি।
‘থামো!’ সে চিৎকার করে উঠল।
‘এত ভয় পাচ্ছ কেন, রোহান?’ জিজ্ঞাসা করল ভূতটা। ‘এতে ভয়ের কিছু নেই। দেখো। আমি শুধু পকেট থেকে আরেকটা চুইংগাম বের করছি…’
ভূতটা পকেট থেকে একটা চুইংগাম বের করল। কিন্তু ওটা স্কেলের মতো লম্বা, পাথরের মতো শক্ত আর অদ্ভুত বেগুনি রঙের।
‘এটাকে তুমি চুইংগাম বলো?’ রোহান জিজ্ঞাসা করল।
‘তোমার স্বপ্নের চুইংগাম,’ উত্তর দিল ভূতটা।
‘আমি এটা তোমার সঙ্গে ভাগ করে খাব। ভালো করে দেখো। যতক্ষণ এটা আস্ত আছে, এটা আমার চুইংগাম। একটা চুইংগাম, একজন মানুষ।’ সে লাঠির মাথায় একটা চক লাগাল। ওটাও অদ্ভুত বেগুনি রঙের। তারপর বলল, ‘আমরা এটাকে এভাবে লিখি—’
সে বিমানের ধোঁয়ার মতো করে দুটো ‘এক’ লিখল। বেগুনি সংখ্যাগুলো কিছুক্ষণ সাদা মেঘের গায়ে ভেসে রইল, তারপর গলে গেল আইসক্রিমের মতো।
‘দারুণ’ বলল রোহান। ‘ইশ! ও রকম একটা লাঠি যদি পেতাম!’
‘ওহ, এটা আহামরি কিছু নয়। যদিও ওটা দিয়ে মেঘে, দেয়ালে, পর্দায় বা যেকোনো জায়গায় লেখা যায়। আমার খাতার দরকার হয় না। যাকগে, ওসব বাদ। চুইংগামে ফিরে আসি। আমি যদি এটাকে ভেঙে দুই ভাগ করি, তুমি অর্ধেক পাবে, আমি অর্ধেক পাব। একটা চুইংগাম, দুজন মানুষ। গাম থাকবে ওপরে, মানুষ নিচে:
এখন তোমার বন্ধুরাও নিশ্চয়ই চাইবে।
‘ইরা আর আনিসা।’
‘ঠিক আছে। ধরো ইরা তোমার কাছে চাইল, আর আনিসা আমার কাছে। আমরা সমান ভাগে ভাগ করলাম। তার মানে আমরা প্রত্যেকে এক–চতুর্থাংশ বা চার ভাগের এক ভাগ পাব:
কিন্তু এটা সবে শুরু। বাকি সবাইও চাইবে। ক্লাসের বাকিরা, শহরের বাকিরা...। তাই আমাদের চারজনকে আবার নিজেদের ভাগটা অর্ধেক করতে হবে, তারপর সেটাকে আবার অর্ধেক, তারপর আবার অর্ধেক এবং চলতেই থাকবে।’
‘অনন্তকাল পর্যন্ত!’ বলল রোহান।
‘যতক্ষণ না টুকরাগুলো এত ছোট হয় যে খালি চোখে দেখাই যায় না। যা হোক, আমরা ভাগ করতেই থাকব যতক্ষণ না পৃথিবীর আট শ কোটি মানুষ তাদের ভাগ পায়। কিন্তু তারপর আসবে ছয় হাজার কোটি ইঁদুর, ওরাও ভাগ চাইবে। সোজা কথায়, এর কোনো শেষ নেই।’
ইতিমধ্যে সে আকাশের গায়ে বেগুনি রঙের অসীম সংখ্যক ‘১’ লিখে ফেলেছে।
‘আপনি এভাবে চলতে থাকলে তো পুরো পৃথিবী ভরে যাবে!’ রোহান চেঁচিয়ে উঠল। ‘দেখো,’ ভূতটা আবার বুক ফুলিয়ে বলল, ‘আমি তো শুধু তোমার জন্যই করছি! তুমিই তো সংখ্যা ভয় পাও। তুমিই তো সবকিছু সহজ করতে চাও, যাতে গুলিয়ে না যায়।’
‘কিন্তু এতগুলো ১ দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগছে। আমার তো মনে হয় না এটা সহজ। ১ দেখতে দেখতে আমার মাথা ধরে গেছে। এটা বরং আরও বেশি জটিল মনে হয়।’
‘আচ্ছা আচ্ছা,’ ভূতটা হাত নেড়ে আকাশ পরিষ্কার করে দিয়ে বলল। ‘তাহলে তুমি মানছ যে আমাদের ১ + ১ + ১ + ১ ... এর চেয়ে স্মার্ট কিছু দরকার। যেমন সংখ্যা। এ জন্যই তো আমি সংখ্যা আবিষ্কার করেছি।’
‘তুমি? তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলছ যে সংখ্যা তুমি আবিষ্কার করেছ?’
‘আমি বা আরও কয়েকজন। কে করেছে তাতে কী আসে যায়? এত সন্দেহ কেন বাপু তোমার? তার চেয়ে আমি বরং তোমাকে দেখাই কীভাবে শুধু ‘১’ দিয়ে সব সংখ্যা বানানো যায়।’
‘ঠিক আছে। কীভাবে?’
‘সহজ। আমি এভাবে শুরু করি:
১ × ১
তারপর:
১১ × ১১
আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এটার জন্য তোমার ক্যালকুলেটর লাগবে।’
‘বোকার মতো কথা বলো না,’ বলল রোহান।
১১ × ১১ = ১২১
‘দেখলে?’ ভূতটা বলল। ‘তুমি শুধু ১ ব্যবহার করে ২ বানিয়ে ফেললে। এবার এটা চেষ্টা করো—
১১১ × ১১১
‘এটা বেশি কঠিন। আমি মুখে মুখে পারব না।’
‘তাহলে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করো।’
‘আমার ক্যালকুলেটর! তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না আমি ওটা নিয়ে ঘুমাতে আসি?’
‘তাহলে এটা ব্যবহার করো,’ সে রোহানের হাতে একটা ক্যালকুলেটর ধরিয়ে দিল। ওটা ধরতে কেমন পিচ্ছিল, নরম ময়দার মতো আর দেখতে জঘন্য সবুজ রঙের। কিন্তু কাজ করছিল। রোহান টিপল: ১১১ * ১১১
আর উত্তর পেল: ১২৩২১
‘দারুণ’, বলল রোহান। ‘এখন আমরা ৩ পেয়ে গেলাম।’
‘ঠিক। চালিয়ে যাও।’
রোহান তখন চাপতে লাগল:
‘খুব ভালো,’ ভূতটা রোহানের কাঁধ চাপড়ে বলল। ‘তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ, প্রতিবার শুধু নতুন সংখ্যাই আসছে না, সংখ্যাগুলো সামনে থেকে পড়লে যা, পেছন থেকে পড়লেও তা–ই। যেমন ‘নয়ন’ বা ‘মলম’ শব্দের মতো।’
রোহানের কাছে কৌশলটা বেশ ভালো লাগল। সে ছয়টা ১ দিয়ে চেষ্টা করল এবং কাজ হলো! কিন্তু যখন সাতটা ১ গুণ করতে চাইল, তখন আর ক্যালকুলেটরটা কাজ করল না।
রোহান অবাক হয়ে দেখল, ওটা হঠাৎ ‘ফৎ’ করে শব্দ করে গলে সবুজ কাদা হয়ে গেল।
‘ইয়াক!’ রোহান আঙুল থেকে সবুজ কাদা মুছতে মুছতে বলল। ‘তোমার একটা বড় ক্যালকুলেটর বা কম্পিউটার দরকার। কম্পিউটার এক নিমিষে উত্তর দিয়ে দিত।’
‘তুমি নিশ্চিত?’
‘অবশ্যই নিশ্চিত।’
রোহানের মনে হলো ভূতটা একটু বেশিই ভাব নিচ্ছে। হয়তো সে ধাপ্পা দিচ্ছে। রোহান একটা বুদ্ধি বের করল। সদে ভূতটাকে বলল, তুমি নিশ্চয়ই এটা দিয়ে এগারোটা ১১-কে গুণ করার চেষ্টা করোনি। করেছ কি?’
‘না, করেছি বলে মনে পড়ে না।’
‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি ওটা কাজ করবে না।’
ভূতটা মনে মনে অঙ্কটা কষতে শুরু করল। কিন্তু আবার তার মুখ টকটকে লাল হয়ে বেলুনের মতো ফুলে উঠল। রোহান ভাবল, ও কি রেগে গেছে, নাকি অঙ্কটা আসলেই কঠিন?
‘এক সেকেন্ড দাঁড়াও,’ ভূতটা বিড়বিড় করল। ‘কিছুতেই মেলাতে পারছি না। ধুর ছাই! তুমিই ঠিক বলেছ। এটা কাজ করে না। তুমি জানলে কী করে?’
‘আমি জানতাম না। তুমি কি আমাকে পাগল ভাবো যে আমি এমন অঙ্ক কষতে যাব? আমি শুধু আন্দাজ করেছি।’
‘আন্দাজ? গণিতে আন্দাজ করা নিষেধ! গণিত হলো নিখুঁত বিজ্ঞান!’
‘কিন্তু তুমি যখন বলেছিলে সংখ্যার শেষ নেই, অনন্তকাল চলতেই থাকে; ওটা তো আন্দাজই ছিল, তাই না?’
‘কী স্পর্ধা! তুমি কে হে? আনাড়ি একটা! অঙ্ক ভয় পাও! আর তুমি আমাকে কাজ শেখাতে আসছ?’ প্রতিটি শব্দ বলার সঙ্গে সঙ্গে ভূতটা আরও বড় আর মোটা হতে লাগল; ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। ভয় পেয়ে গেল রোহান।
‘ওরে গর্দভ! ওরে চুনোপুঁটি! ছোট্ট ছোকরা!’ সে চিৎকার করতে লাগল। আর যেই না ভূতটা শেষ কথাটা বলল, অমনি সে বিকট শব্দে ফেটে গেল।
ঘুম ভেঙে গেল রোহানের। সে খাট থেকে পড়ে গেছে এবং মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে। কিন্তু ভূতটাকে বুদ্ধিতে হারিয়ে দিয়েছে ভেবে সে হেসে ফেলল।
চলবে...
*হান্স ম্যাগনুস এনজেন্সবার্গারের ডের সালেন-টয়ফেল অবলম্বনে