কেইন কেন রেস্টুরেন্টে শিরোপা জয়ের স্বাদ পেলেন

জীবনের ৩১ বসন্ত পেরিয়ে গেছে, ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ক্লাবের জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন। জাতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছেন, দলকে তুলে নিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। হ্যারি কেইনের জীবনে ব্যক্তিগত অর্জনের কোনো অভাব নেই। তবু ৪ মে, ২০২৫ তারিখটাকে একটু বিশেষভাবে মনে রাখবেন কেইন। কারণ, খেলোয়াড়ি জীবনের ১৫ বছর পেরিয়ে, ৩১ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো শিরোপার স্বাদ পেলেন ইংলিশ স্ট্রাইকার। সেটাও আবার সতীর্থদের সঙ্গে এক রেস্টুরেন্টে বসে।

দুর্ভাগা, অলক্ষুণে—কেইনের নামের পাশে এমন অনেক বিশেষণ গত এক দশকে। খেলোয়াড় হিসেবে কেইনের তুলনা হবে রোনালদো নাজারিও, ফার্নান্দো তোরেসদের সঙ্গে। পরিসংখ্যানও সাক্ষী দেবে, তাঁর মতো দুর্দান্ত স্ট্রাইকার গত দশকে আসেনি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগে পাল্লা দিয়ে গোল করেছেন। নিত্য নতুন কৌশলের যুগে স্ট্রাইকার থেকে সবাই যখন ‘ফলস নাইন’ হওয়ার দৌড়ে, তখন কেইন দাঁড়িয়ে ছিলেন পারফেক্ট ‘নাম্বার নাইন’ হয়ে। সময়ের পরিক্রমায় আর দলের প্রয়োজনে খেলার ধরনে পরিবর্তন এসেছে বটে, কিন্তু তাঁর খেলার ধার কমেনি বিন্দুমাত্র। তাঁকে নিয়ে নিত্য নতুন কাটাছেঁড়া করেছেন কোচরা, কখনো ফলস নাইন, কখনো ডাবল স্ট্রাইকার; প্রতিটি পজিশনেই কেইন ছিলেন দুর্দান্ত।।

আরও পড়ুন
কেইনের ক্যারিয়ার টটেনহামে শুরু হলেও হাতেখড়ি হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালে। ৮ বছর বয়সে আর্সেনালের যুবদলে অভিষেক, কিন্তু এক বছরের মাথায় ‘যথেষ্ট অ্যাথলেটিক না’ দাবি করে রিলিজ করে দেয় গানার্স একাডেমি।
গোল্ডেন বুট, সেরা খেলোয়াড়—সব তকমাই ছিল তাঁর
ছবি: এক্স

এক কেইনের ওপর ভর করেই বিশ্বের সেরা দলগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছিল টটেনহাম। প্রিমিয়ার লিগের বিগ সিক্স, ইউরোপিয়ান মঞ্চে ত্রাসের রাজত্ব। কোচ মাউরিসিও পচেত্তিনোর অধীনে হ্যারি কেইন ছিলেন তুরুপের তাস। কিন্তু তাঁর সব স্কিল, গোলমুখে এত কারিকুরি; সবটাই যেন ফিকে হয়ে যেত শিরোপার কাছাকাছি এসে। গোলমুখে হাজারো জট নিমেষেই খুলে ফেলেন তিনি, শিরোপার জট খোলা হয়নি তাঁর।

কেইনের ক্যারিয়ার টটেনহামে শুরু হলেও হাতেখড়ি হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালে। ৮ বছর বয়সে আর্সেনালের যুবদলে অভিষেক, কিন্তু এক বছরের মাথায় ‘যথেষ্ট অ্যাথলেটিক না’ দাবি করে রিলিজ করে দেয় গানার্স একাডেমি। সেখান থেকে রিজওয়ে রোভার্স, ওয়াটফোর্ড ঘুরে কেইন অবশেষে থিতু হন টটেনহামে। টটেনহামও প্রথম দফায় তাঁকে রিজেক্ট করেছিল, কিন্তু ওয়াটফোর্ডের জার্সিতে তাঁর পারফরম্যান্স দেখে সিদ্ধান্ত নেয় দলে ভেড়ানোর। ২০০৯ সালে প্রথম টটেনহামে ডাক পাওয়া, ২০১১ সালে অভিষেক। ২০১৩ সাল পর্যন্ত কেইন ক্যারিয়ার গড়েছেন বিভিন্ন দলে ধারে খেলে।

ক্যারিয়ারের লম্বা সময় দিয়েছেন টটেনহামে
ছবি: এক্স

তবে কেইন নিজের ক্যারিয়ার গড়েছেন আর্জেন্টাইন কোচ মাউরিসিও পচেত্তিনোর অধীনে। গ্যারেথ বেলের ফেলে রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণের দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। ২১ বছর বয়সী কেইন প্রতিদান দিয়েছিলেন ৫১ ম্যাচে ৩১ গোল করে। নিজের ব্রেকআউট সিজনেই প্রথমবারের মতো স্বাদ পান রানার্সআপ মেডেলের। লিগ কাপের ফাইনালে চেলসির বিপক্ষে ২-০ গোলে হারে টটেনহাম। তখন হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি, বছরের পর বছর কেটে যাবে, কিন্তু স্বর্ণালি মেডেলটা হয়তো আর কখনোই গলায় ঝোলানো হবে না তাঁর।

আরও পড়ুন
জাতীয় দলের গল্পটা তো আরও করুণ। ইংল্যান্ডের ‘ড্রিম টিম’ যা পারেনি, সেটা করে দেখিয়েছেন কেইন। তাঁর অধীনে প্রায় ৬০ বছর পর ফাইনালে উঠেছিল থ্রি লায়ন্সরা।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে গোলসংখ্যা। টটেনহামকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। ২০১৬-১৭ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে ৮৬ পয়েন্ট অর্জন করে টটেনহাম। নিজেদের ইতিহাসের সেরা পারফরম্যান্স দিয়েও শিরোপা থেকে ৬ পয়েন্ট দূরে থেকে লিগ শেষ করে স্পার্সরা। ২০১৮-১৯ মৌসুম ছিল স্পার্সদের জন্য স্বপ্নের এক মৌসুম। সে মৌসুমে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ওঠে স্পার্স। কিন্তু লিভারপুলের কাছে হেরে শিরোপার স্বপ্ন শিরোপাতেই থেকে যায়। আবারও রানার্সআপের মেডেল তাঁর গলায়।

চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে হ্যারি কেইন
ছবি: এক্স

২০২০-২১ মৌসুমে আবারও ফাইনাল নিশ্চিত করে টটেনহাম, এবার ইএফএল কাপের। কিন্তু ফাইনালের মাত্র দুই দিন আগে বরখাস্ত করা হয় ‘স্পেশাল ওয়ান’ খ্যাত জোসে মরিনহোকে। বিদায়ের আগে মরিনহো রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে যান, এই ক্লাবের কোনো পরিকল্পনা নেই। এদের দিয়ে শিরোপা জেতা হবে না। হলোও তাই। ম্যানচেস্টার সিটির কাছে হারতে হলো তাঁদের।

আরও পড়ুন

এ তো গেল টটেনহামের কথা। জাতীয় দলের গল্পটা তো আরও করুণ। ইংল্যান্ডের ‘ড্রিম টিম’ যা পারেনি, সেটা করে দেখিয়েছেন কেইন। তাঁর অধীনে প্রায় ৬০ বছর পর ফাইনালে উঠেছিল থ্রি লায়ন্সরা। একবার না, পরপর দুবার ইউরোর ফাইনালে দলকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন কেইন। লাভের লাভ কিচ্ছু হয়নি। কেইন ব্যর্থ মনোরথে ফিরেছেন রানার্সআপ ট্রফি নিয়ে। প্রথমবার ইতালির কাছে, টাইব্রেকারে হেরে। করোনার প্রভাবে পিছিয়ে যাওয়া এক ইউরোতে শিরোপা হারান ঘরের মাটিতে। তিন বছর পর একই মঞ্চে শিরোপা হারাতে হয় স্পেনের কাছে। এবার অবশ্য টাইব্রেকার পর্যন্ত টানেনি। নির্ধারিত সময়েই শেষ হয়েছে খেলা। ২-১ গোলে হেরে রানার্সআপ মেডেলের সংখ্যা বাড়িয়েছেন তিনি।

ইউরো ২০২৪–এর ফাইনালে হ্যারি কেইন
ছবি: এক্স

মৌসুমের পর মৌসুম ধরে একই বৃত্তে ঘুরতে থাকা টটেনহামকে নিয়ে যেন হ্যারি কেইনও ছিলেন বিরক্ত। একদিকে দলের এমন হাল, অন্যদিকে দলের চেয়ারম্যান ডেনিয়েল লেভিও আছেন তাঁর জগতে। রিয়াল মাদ্রিদ হোক কিংবা ম্যানচেস্টার সিটি, তাঁকে দলে ভেড়ানোর জন্য কম অফার আসেনি টেবিলে। একটি প্রস্তাবও শোনার প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি। বরং ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধরে রেখেছেন হ্যারি কেইনকে। অবশেষে ২০২৩ সালে এসে বায়ার্নের প্রস্তাবে রাজি হন তিনি। চুক্তির বাকি ছিল মাত্র এক বছর। কেইনও বেঁকে বসেছিলেন চুক্তি বাড়ানোর ব্যাপারে। সব মিলিয়ে তাঁকে দলে রাখলে লাভের থেকে ক্ষতি বেশি হতো। ফলে ১১০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বায়ার্নে যোগ দেন কেইন।

আরও পড়ুন
১১ বছর পর সেবারই প্রথম বুন্দেসলিগা হাতছাড়া হলো বায়ার্নের। জাবি আলানসোর অধীনে রেকর্ডের পাহাড় গড়ল বেয়ার লেভারকুসেন। অপরাজিত থেকে জিতে নিল বুন্দেসলিগার শিরোপা।

আর বায়ার্নের জার্সি নিশ্চিত হতে না হতেই নিশ্চিত হয়ে যায় একটি সম্ভাবনা। হ্যারি কেইনকে আর যা–ই হোক, শিরোপাবিহীন থাকতে হবে না। বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে বাকিদের দূরত্ব যোজন যোজন। খেলার ধরনে হোক আর শিরোপার দিক দিয়ে, বায়ার্নকে ছোঁয়ার মতো কেউ আসেনি জার্মান লিগে। ব্যাপারটা এমন ছিল এই দলে নাম লেখালেই শিরোপা। আর সেটাও আবার প্রথম দিনেই।

১২ আগস্ট বায়ার্নের হয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন কেইন। সেদিন সন্ধ্যায় ছিল ডিএফএল সুপার কাপের ফাইনাল। শিরোপা জিততে যেন তর সইছিল না তাঁর। সকালে বায়ার্নের সঙ্গে চুক্তি, রাতে মাঠে। কথায় আছে, অভাগা যেদিকে যায়, সাগরও শুকিয়ে যায়। কেইনের আগমনে বায়ার্ন তাদের নিশ্চিত শিরোপাটাও হারিয়ে ফেলল আরবি লাইপজিগের কাছে। ০-৩ গোলে হেরে শুরু হলো কেইনের বায়ার্নযাত্রা। এ যেন অধঃপতনের সূচনা মাত্র।

দুর্দান্ত খেলেও বায়ার্নে প্রথম মৌসুমে শিরোপার দেখা পাননি কেইন
ছবি: এক্স

১১ বছর পর সেবারই প্রথম বুন্দেসলিগা হাতছাড়া হলো বায়ার্নের। জাবি আলানসোর অধীনে রেকর্ডের পাহাড় গড়ল বেয়ার লেভারকুসেন। অপরাজিত থেকে জিতে নিল বুন্দেসলিগার শিরোপা। দ্বিতীয় হওয়া দূরে থাক, স্টুটগার্ডের পেছনে থেকে তৃতীয় হতে হলো লিগে। চ্যাম্পিয়নস লিগেও রিয়াল মাদ্রিদের কাছে কাটা পড়ল ভাগ্য। হ্যারি কেইন যেন দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গী করে। ৪৬ ম্যাচে ৪৪ গোল করেও ভাগ্যের শিকে ছিড়ল না তাঁর।

আরও পড়ুন

কেইন হাল ছাড়ার পাত্র নন, বায়ার্ন তো আর টটেনহাম নয়, যে একবার হোঁচট খেলে দাঁড়াতে পারবে না। এই মৌসুমেই ঘুরে দাঁড়াল বায়ার্ন। এবারও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন কেইন। ২৯ ম্যাচে ২৪ গোল, ভিনসেন্ট কোম্পানির অধীনে কেইন যেন আরও বিধ্বংসী। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে তাঁর ক্ষুধা, শিরোপা জয়ের প্রচণ্ড ক্ষুধা মনে। সেটাই ঠিকরে বেরোচ্ছিল তাঁর চোখে-মুখে। এবারও তাদের প্রতিপক্ষ বায়ার লেভারকুসেন। কিন্তু শিরোপা তো তাঁর কাছে এত সহজে ধরা দেবে না।

গত ম্যাচে একটুর জন্য শিরোপা নিশ্চিত হয়নি কেইনের
ছবি: এক্স

কেইনের শিরোপা নিশ্চিত হতে পারত গত ম্যাচেই। অথচ হলুদ কার্ড দেখে ম্যাচ থেকে নিষিদ্ধ ছিলেন তিনি। নিজের প্রথম শিরোপাটাও মাঠ থেকে উদ্‌যাপন করতে পারবেন না, এমনটাই টিটকিরি ছুড়েছিল অনেকে। শিরোপাটা নিশ্চিত হয়েও গিয়েছিল, ৯০ মিনিট পর্যন্ত বায়ার্ন এগিয়ে ছিল ৩-২ গোলে। দলের জয় নিশ্চিত দেখে গ্যালারি থেকে ডাগ আউটে নেমে এসেছিলেন কেইন। দলের সঙ্গে যেই না উদ্‌যাপনে মেতে উঠবেন, তখনই বাদ সাধলেন ইউসুফ পৌলসেন। শেষ মুহূর্তের গোলে শিরোপা উদ্‌যাপন গেল পিছিয়ে। চোখ ছিল বেয়ার লেভারকুসেনের ম্যাচের দিকে।

আরও পড়ুন
শীর্ষ পর্যায়ে খেলতে খেলতে শিরোপাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে কমবেশি সব তারকারই। শুধু হ্যারি কেইনের কাছেই শিরোপা ছিল অধরা।

গতকাল তাই রেস্টুরেন্টে বসে সতীর্থদের সঙ্গে নজর রাখছিলেন টিভি পর্দায়। প্রথমেই ২-০ গোলে পিছিয়ে যায় লেভারকুসেন। কিন্তু তারা তো কামব্যাকে সিদ্ধহস্ত। কে জানে হয়তো শেষ মুহূর্তে না তাদের আনন্দ নষ্ট করে দেন জাবি আলানসো। সেটা হয়নি। কামব্যাক হয়েছে বটে, কিন্তু বায়ার্নকে আটকে দেওয়ার মতো নয়। ২-২ গোলে ম্যাচ ড্র হলেও শিরোপাটা ঠিক নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে বায়ার্ন তথা হ্যারি কেইনের। এরিক ডায়ারের সঙ্গে তাঁর লম্বা হাগ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, ঠিক কতটা যন্ত্রণা তিনি পুষে রেখেছিলেন নিজের মনে।

শিরোপা নিশ্চিতের পর হ্যারি কেইন
ছবি: এক্স

একটা শিরোপার জন্য এত আকাঙ্ক্ষিত তা বোঝা যাচ্ছিল কেইনের উদ্‌যাপনে। শীর্ষ পর্যায়ে খেলতে খেলতে শিরোপাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে কমবেশি সব তারকারই। শুধু হ্যারি কেইনের কাছেই শিরোপা ছিল অধরা। যে কারণে রেস্টুরেন্টের টিভির সামনে ত্রিশোর্ধ্ব একজন খেলোয়াড়ের বাঁধভাঙা উল্লাস একটুও দৃষ্টিকটু লাগে না। এই উল্লাস যেন নিজেকে প্রমাণ করতে পারার উল্লাস, নিজেকে জেতানোর প্রয়াস। এমন দৃশ্য একচিলতে হাসি এনে দেবে সবার ঠোঁটে।

আরও পড়ুন