বার্সেলোনায় আবার সেই চেনা রাশফোর্ড

‘ওর মধ্যে প্রতিভা আছে, কিন্তু এভাবে চমকে দিতে পারবে, আগে ভাবিনি।’ নিজ দলের কোচ যখন এমনভাবে প্রশংসা করেন, তখন একজন খেলোয়াড়ের আসলে কেমন লাগে? ২৭ বছর মাত্র বয়স, যেকোনো খেলাতেই এই সময়টা নিজের শ্রেষ্ঠ সময়। সেরা থেকে বিশ্বসেরা হওয়ার গল্প লিখতে হয় এই সময়টাতেই। কিন্তু মার্কাস রাশফোর্ড এই বয়সে এসে লিখছেন ফিরে আসার গল্প। গল্পটা যতটা না আক্ষেপের, তার চেয়ে বেশি অণুপ্রেরণার।

রাশফোর্ড নামটা ফুটবলপ্রেমীদের আক্ষেপের। ‘ইয়াংস্টার’ বলতে যা বোঝায়, রাশফোর্ড ছিলেন তার সবটা। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে তাঁর অভিষেক হয়েছিল ১৮ বছর বয়সে। আর অভিষেকের দিন থেকেই তুলে নিয়েছিলেন আক্রমণভাগের দায়িত্ব। তরুণ রাশফোর্ডের কাঁধে দায়িত্ব তুলে দিতে হয়নি, দলের এতটাই শোচনীয় অবস্থা ছিল যে না চাইতেও দলের সেরা খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিলেন রাশফোর্ড। অভিষেকের দিনই তাঁর পা থেকে এসেছিল দুই গোল। তিন দিন পর আবারও দুই গোল, আর্সেনালের বিপক্ষে। মৌসুমের মাঝপথে অভিষেক হওয়া খেলোয়াড় ছিলেন দলের চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা। তা–ও আবার মাত্র ১৮ বছর বয়সে। লুই ফন গালের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে মার্কাস রাশফোর্ড ছিলেন নতুন এক আশা। নিজেদের যুব দল নিয়ে গর্ব করা ইউনাইটেড অবশেষে খুঁজে পেয়েছিল গর্ব করার মতো কাউকে।

আরও পড়ুন

সেই রাশফোর্ড বড় হয়েছেন জ্ঞানে-গুণে। ওয়েন রুনি চলে যাওয়ার আগে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন ‘১০’ নম্বর জার্সি। ইউনাইটেডের সমর্থকেরা আশার বাণী খুঁজে পেয়েছিলেন রাশফোর্ডের মাঝে। রাশফোর্ডও তাঁদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। প্রতি মৌসুমেই রাশফোর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছেন নিজেকে। কিন্তু ইউনাইটেডকে টানতে টানতে রাশফোর্ডও হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। টানা খেলতে খেলতে ক্লান্তি আর চোট জর্জরিত করেছিল তাঁকে। আর এর মাঝেই কাল হয়ে এল ২০২০ ইউরো।

ওয়েন রুনির আইকনিক ‘১০’ পেয়েছিলেন রাশফোর্ড
ছবি: এক্স

চোটের কারণে রাশফোর্ড দলের সঙ্গে থাকলেও ছিলেন না মাঠে। তাঁকে ছাড়াই ইউরোর ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু কী যেন কী ভেবে টাইব্রেকারের ১ মিনিট আগে তাঁকে মাঠে ঠেলে দিলেন কোচ গ্যারেথ সাউথগেট। পুরো টুর্নামেন্টে ২ মিনিট খেলা রাশফোর্ডের শট বারে লেগে বেরিয়ে গেল বাইরে। সেদিনের সেই হতাশামাখা রাশফোর্ডের চেহারাই ছিল তাঁর স্বর্ণযুগের ইতি।

আরও পড়ুন

ইউনাইটেডের পোস্টারবয় পরিণত হলেন জাতীয় ভিলেনে। সঙ্গে যুক্ত হলো চোট। রাশফোর্ড ধীরে ধীরে যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন ইউনাইটেডের সঙ্গে, সেই কনফিডেন্স যেন গুঁড়িয়ে গেল মুহূর্তেই। বর্ণবাদী আচরণ, ভক্তদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া তো ছিলই, এমনকি সরকারের বড় বড় পদে আসীন ব্যক্তিরাও নিয়মিত দুয়ো দিতে থাকলেন তাঁকে। প্রতিটি পদক্ষেপেই যেন রাশফোর্ড নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। ডেভিড বেকহ্যাম যেভাবে মুহূর্তেই হয়ে উঠেছিলেন ইংল্যান্ডের ভিলেন, একই চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি হয়েছিল রাশফোর্ডের ক্ষেত্রেও। শুধু রাশফোর্ডকে সঙ্গ দেওয়ার মতো একজন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ছিলেন না। তাঁকে ফিরিয়ে আনা, ধৈর্য ধরে সঙ্গ দেওয়ার মতো ছিলেন না কেউ। সবার মাঝে থেকেও একা হয়ে পড়েছিলেন রাশফোর্ড।

ইউরো ফাইনালে পেনাল্টি মিসের পর
ছবি: এক্স

রাশফোর্ডও আর তাঁর পুরোনো ফর্মে ফিরতে পারেননি। মাঝখানে এক মৌসুমে যতসামান্য ঝলক দেখিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও হারিয়ে গিয়েছে সময়ের সঙ্গে। যত দিন গড়াচ্ছিল, রাশফোর্ড হয়ে উঠেছিলেন নিজের ছায়া।

আরও পড়ুন

বাদ পড়েছিলেন ইংল্যান্ড দল থেকে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডও আর তাঁর ওপর ভরসা করতে পারেনি। স্বয়ং দলের সমর্থকেরাই তাঁর পারফরম্যান্সে ছিলেন অসন্তুষ্ট। ফর্মহীন রাশফোর্ড কোনোভাবে আগলে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন ইউনাইটেডকে। শেষমেষ গত মৌসুমে এসে ছেড়ে দিলেন হাল, কর্তৃপক্ষের কাছে জানিয়ে দিলেন নতুন দল খোঁজা হোক তাঁর জন্য। অবশেষে ছয় মাসের জন্য যোগ দিলেন অ্যাস্টন ভিলায়।

ছয় মাসের জন্য অ্যাস্টন ভিলায় ছিলেন রাশফোর্ড
ছবি: এক্স

অ্যাস্টন ভিলায় বলার মতো কোনো পারফরম্যান্স ছিল না। ফলে মৌসুম শেষেই তাঁকে ফেরত পাঠানো হলো ইউনাইটেডে। নতুন মৌসুমে নতুন কোচের অধীনও ছিলেন না কোনো পরিকল্পনায়, ইংলিশ দলগুলোও যেন রাশফোর্ডের শেষ দেখে ফেলেছিলেন। তাই তো ফ্রিতে যখন এত বড় খেলোয়াড়কে পাওয়ার গুঞ্জন উঠল, বার্সেলোনা আর ছাড় দেয়নি। ইউনাইটেড থেকে ধারে ভিড়িয়েছে দলে। কে জানতো, ব্লাউগ্রানার জার্সিতে ভাগ্য খুলে যাবে রাশফোর্ডের।

আরও পড়ুন

বার্সেলোনার বর্তমান কোচ হ্যান্সি ফ্লিক রাশফোর্ডকে দেখেছেন একেবারে ছোটবেলা থেকে। খেলার প্রতি রাশফোর্ডের টান, আচার–আচরণ থেকে শুরু করে উত্থান–পতন; হ্যান্সি ফ্লিকের কাছে কোনো কিছুই নতুন নয়। রাশফোর্ডের জন্য বার্সেলোনা ছিল দ্বিতীয় একটা সুযোগ। রাশফোর্ড সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন নিজের সবটা দিয়ে। রাশফোর্ডকে যখন দলে আনা হয়, তখন অনেকেরই প্রশ্ন ছিল এই দলে তাঁর জায়গাটা কোথায়? রাফিনহা আছেন, লেভানডফস্কি আছেন, আছেন লামিন ইয়ামাল। রাশফোর্ড খেলবেন কোথায়? রাশফোর্ড জায়গা করে নিয়েছেন সবার অনুপস্থিতিতে। একজন করে খেলোয়াড় যখনই চোটে পড়েছেন, রাশফোর্ড সেই জায়গায় মানিয়ে গিয়েছেন। শুধু মানিয়ে গিয়ে ক্ষান্ত হননি, একের পর এক ম্যাচে আবির্ভূত হয়েছেন বার্সেলোনার রক্ষাকর্তা হিসেবে।

রাশফোর্ড এখন বার্সেলোনার রক্ষাকর্তা
ছবি: এক্স

বার্সেলোনার হয়ে ১২ ম্যাচে তাঁর গোল ৫টি। কিন্তু গোলই তো আর সবকিছু নয়। ২০১৭-১৮ সালের রাশফোর্ডকে যাঁরা লাল জার্সিতে দেখেছেন, তাঁরা জানেন রাশফোর্ড কী ছিলেন। গতিতে, বুদ্ধিমত্তায় তাঁকে টেক্কা দেওয়ার মতো তরুণ খেলোয়াড় ছিল হাতে গোনা। এমবাপ্পের সঙ্গে তাঁর তুলনা দেওয়া হতো, ভাবা হতো সেরা ইয়াংস্টারদের একজন। রাশফোর্ড হারিয়ে যেতে বসেছিলেন দর্শকদের দুয়ো, মিডিয়ার প্রেশার আর দুয়োধ্বনিতে। সেই রাশফোর্ড ফিরছেন, আস্তে আস্তে করে ইংলিশ মিডিয়া থেকে দূরে এসে নিজের মতো করে গড়ছেন নিজেকে।

আরও পড়ুন