সাইফ হাসানের ফেরা

বর্তমানে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটার কে? ফর্ম বিবেচনায় নামটা নিঃসন্দেহে সাইফ হাসান। ২৬ বছর বয়সী অলরাউন্ডার হুট করেই হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশর সাদা বলের ক্রিকেটের ধারকবাহক। অথচ কয়েক মাস আগেও জাতীয় দলের রাডারেই ছিল না তাঁর নাম। যেন উড়ে এসে জুড়ে বসে বদলে দিয়েছেন ক্রিকেটের প্রাণ। সাইফ হাসানের প্রত্যাবর্তন চমকে দিয়েছে অনেককেই।

সাইফ হাসানকে নিয়ে বলতে হলে ফিরে যেতে হবে করোনার ঠিক আগে আগে। তামিম ইকবালের সঙ্গে নতুন ওপেনার হিসেবে পাকিস্তান সিরিজে অভিষেক হয়েছিল সাইফের। অভিষেক হয়েছিল ডাক দিয়ে। করোনার পরপর টানা কয়েকটা সিরিজে তাঁকে বাজিয়ে দেখেছিল বোর্ড, ভাবা হয়েছিল লম্বা রেসের ঘোড়া। কিন্তু তা হতে পারেননি সাইফ। মাত্র ৬ টেস্টে ১৫৯ রান করেই থেমে যায় তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে। সে সময় দুটো টি-টোয়েন্টিও খেলেছিলেন, রান করেছিলেন মাত্র ১। সাইফ হাসান ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে জ্বলে ওঠার আগেই খসে পরা আরও এক খেলোয়াড়।

অনুর্ধ্ব ১৯ দলে বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন সাইফ।
ছবি: এক্স

সাইফকে নিয়ে আশার বাণী দেখেছিলেন নির্বাচকরা, অনূর্ধ্ব-১৯ দলে তাঁর পারফরম্যান্স দেখে। দুটো বিশ্বকাপ খেলেছেন, দলের অধিনায়ক ছিলেন। ওপেনার হিসেবে যেমন রান করতে পারতেন, তেমনই বল হাতেও টুকটাক ভূমিকা রাখতেন। ওপেনিং অলরাউন্ডার হিসেবে পারফরম্যান্স দিয়েই জায়গা করে নিয়েছিলেন দলে। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিটা গায়ে জড়িয়েই যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন। ফলাফল দীর্ঘদিনের জন্য দল থেকে বাদ। পারফরম্যান্সও এমন বলার মতো কিছু ছিল না যা দিয়ে জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়তে পারেন।

আরও পড়ুন

সাইফের ক্যারিয়ারে বাঁক আসে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে রংপুর রাইডার্সে যোগ দেওয়ার পর থেকে। ২০২৪ সালে গ্লোবাল সুপার লিগের জন্য গড়া দলে তাঁকে ডাকে রংপুর। সুযোগটা কাজে লাগান সাইফ। একে তো বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট, সঙ্গে দলে নিয়মিত সুযোগ — দূর্দান্তভাবে তা কাজে লাগিয়েছেন ডানহাতি এই ব্যাটার। প্রথম টুর্নামেন্টে রংপুর রাইডার্স জিতে নেয় শিরোপা, সেখানে ১৪ বলে ২৭ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংসও ছিল সাইফের। হুটহাট ভালো খেলা খেলোয়াড় দলকে নিয়ে গেলেন ফাইনালে। এই আত্মবিশ্বাসটুকুই হয়তো বদলে দিল তার খেলার ধরণ। ২০২৪-২৫ বিপিএলেও তাঁকে ধরে রাখল রংপুর রাইডার্স। ১১ ম্যাচে করেছিলেন ২৪০ রান। স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৭। আপাত দৃষ্টিতে খুব একটা ভালো মনে না হলেও ঝলক দেখিয়েছিলেন দুই ম্যাচে। ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে ৪৬ বলে ৬২ আর সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে ৪৯ বলে ৮০। দুই ম্যাচ জেতানো ইনিংস দিয়ে আবারও সুদৃষ্টিতে ফিরেন সাইফ। এরপর আবারও গ্লোবাল সুপার লিগ, দল ভালো না করলেও ব্যাটে সন্তোষজনক পারফরম্যান্স ছিল তাঁর।

রংপুর রাইডার্সের হয়ে চমক দেখিয়েছেন সাইফ।
ছবি: এক্স

গ্লোবাল সুপার লিগ, বিপিএল, গ্লোবাল সুপার লিগ — টানা তিন টুর্নামেন্টে ভালো পারফরম্যান্সের ফল মিলল এশিয়া কাপের আগে ড্রেস রিহার্সেল হিসেবে নেদারল্যান্ডস সিরিজে। চার বছর পর দলে ফেরা, তাও এমন এক ফরম্যাটে যেখানে তাঁকে দেখার সুযোগই হয়নি। কিন্তু সাইফকে ফেরানোটা যে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না, তার প্রমাণ মিলল প্রথম ম্যাচেই। ১৯ বলে অপরাজিত ৩০, তৃতীয় ম্যাচে আবার ৮ বলে ১২। দ্রুত রান করার সমাধান যেন উড়ে এসে জুড়ে বসল নির্বাচকদের কাছে। সাইফ হয়ে উঠলেন মধ্যমনি।

আরও পড়ুন

সাইফের দূর্দান্ত ফর্ম চলল এশিয়া কাপেও। আফগানিস্তানের সঙ্গে ৩০ রানের দ্রুতগতির ইনিংস। সুপার ফোরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চাপের মধ্যে ৪৫ বলে ৬১, সঙ্গে দুই ক্যাচ নিয়ে হলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ভারতেও বিপক্ষেও ৫১ বলে ৬৯ করে ম্যাচ একাই ধরে রেখেছিলেন তিনি। অন্য কারও সঙ্গ পেলে হয়তো ম্যাচের ফলাফলটা অন্যদিকে যেতেও পারতো। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে ১৫ বলে ১৮। তাঁর শুরু করে দেওয়া ইনিংসটা টেনে নিতে পারলে হয়তো এশিয়া কাপের ফাইনালেও খেলা হতো বাংলাদেশের ।

ছক্কা হাঁকাচ্ছেন সাইফ।
ছবি: এক্স

এশিয়া কাপ বাংলাদেশের জন্য মলিন হলেও রঙিন ছিল সাইফ হাসানের ব্যাট। আফগানিস্তান সিরিজে যেন সেখান থেকেই শুরু করেছেন। যদিও ব্যাটিং অর্ডারে অদল বদল হয়েছে, ওপেনার সাইফ নেমে এসেছেন মিডল অর্ডারে, কিন্তু তাঁর হিটিং কমেনি। প্রথম ম্যাচে ডাক মারলেও, পরের ম্যাচে করেছেন ১৪ বলে ১৮। আর শেষ ম্যাচে ৩৮ বলে অপরাজিত ৬৪। শারজাহতে একেবারে ম্যাচ জেতানো ইনিংস। সাইফ হাসান যেন বদলে গিয়েছেন বাংলাদেশের জার্সিতে।

আরও পড়ুন

সাইফ হাসানের সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন এসেছে তাঁর হিটিংয়ে। বাদ পড়ার আগে জাতীয় দলে তাঁকে দেখে যতটা আত্মবিশ্বাসহীন লাগতো, এখন তার দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলেন তিনি। শুধু খেলেন না, প্রতিটি বল বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচেই যেমন, পুরো এক ওভার মেডেন দিয়েছেন। পরপর দুই উইকেট পড়ে যাওয়ার পর রশিদ খানের ওভার দেখে খেলতে হবে–সেটা ভালোভাবেই জানতেন তিনি। তাই তো এক ওভার দেখে খেলে পরের ওভারেই তা পুষিয়ে দিয়েছেন ছক্কা মেরে। ২০২৫ সালে প্রত্যাবর্তনের পর ৯ ইনিংসে  সাইফ হাসান রান করেছেন ৩০৮। স্ট্রাইক রেট ১৩৬.১৪। ২৪ টা ছক্কার সঙ্গে রয়েছে ১৪টি চার। বোঝাই যাচ্ছে বল পার করতেই স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর, আর সেটা করছেনও অনায়াসে।

আফগানদের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে হয়েছেন প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ।
ছবি: এক্স

টি-টোয়েন্টির অসাধারণ ফর্ম সাইফকে এনে দিয়েছে ওয়ানডে খেলার সুযোগ। সেটাও কাজে লাগিয়েছেন দূর্দান্তভাবে। প্রথম দুই ম্যাচে ব্যাট হাতে কিছু করতে না পারলেও বল হাতে ঝলক দেখিয়েছেন। প্রথম ম্যাচে ৩ ওভারে ৭ রান দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান আটকেছেন। দ্বিতীয় ম্যাচে শেষ ওভারে এসে নিশ্চিত হারতে যাওয়া ম্যাচকে নিয়ে গিয়েছেন সুপার ওভারে। প্রথম দুই ম্যাচে ব্যাট হাতে নড়বড়ে সাইফ তৃতীয় ম্যাচেই ফিরেছেন ফর্মে। সৌম্য সরকারকে নিয়ে ১০ বছর পর ১০০+ ওপেনিং জুটি গড়েছেন মিরপুরে। শেষ পর্যন্ত ফিরেছেন ৭২ বলে ৮০ করে। টি টোয়েন্টিতে যে মার শুরু করেছিলেন, সেই মার এসেছে ওয়ানডে ক্রিকেটেও।

জায়গায় দাঁড়িয়ে সীমানা পার করা, কখন থামতে হবে জানা — বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের যেন এই ছোটখাটো জিনিসগুলো একেবারেই অজানা। সাইফ হাসান এর মধ্য থেকেই পরিবর্তনের গান গাচ্ছেন, আশা দেখাচ্ছেন দুই ফরম্যাটে বড় কিছু করার। সেটা যাতে টিকে থাকে এমনটাই এখন আশা সবার।

আরও পড়ুন