আমার লড়াই শুধু আমার সঙ্গে অন্যদের সঙ্গে নয়—ক্রিকেটার মারুফা আক্তার
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের তারকা পেসার মারুফা আক্তার। মাত্র ২০ বছর বয়সেই গতি আর সুইং দিয়ে সবার নজর কেড়েছেন তিনি। খেলা বিষয়ক ম্যাগাজিন স্পোর্টস্টার অবলম্বনে বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর পেসারের উত্থানের গল্প লিখেছেন কাজী আকাশ
ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে মারুফার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ছিল, বড় মঞ্চে খেলার স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় পাকিস্তানের বিপক্ষে দলকে জেতানোর পর মারুফা বলেন, ‘আমি ঘুমানোর সময়ও ভাবতাম, প্রথম ম্যাচেই আমাকে ভালো করতে হবে। আমিই হব ম্যাচ উইনার।’
পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের পিচ স্লো হবে, তা বোঝাই যাচ্ছিল। বাংলাদেশের একাদশে স্পিনারদের ভিড়ে মারুফাই ছিলেন একমাত্র পেসার। কিন্তু ২০ বছর বয়সী এই তরুণী প্রমাণ করেছেন, তিনি থাকলে দলে একজন পেসারই যথেষ্ট। মারুফার গতি আর সুইং দুর্দান্ত। ব্যাটারদের জন্য রীতিমতো ত্রাস হয়ে ওঠেন তিনি।
মারুফার আইডল অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি মিচেল স্টার্ক। পাকিস্তানের বিপক্ষে তিনি স্টার্কের মতোই বিধ্বংসী ছিলেন। ডানহাতি ব্যাটারদের জন্য তাঁর ইনসুইং ছিল ভয়ংকর। প্রথম ওভারেই ওমাইমা সোহেল ও সিদরা আমিনকে পরপর ২ বলে আউট করে পাকিস্তানকে বিপদে ফেলে দেন মারুফা। ২টি বলই ছিল ‘আনপ্লেয়েবল’। বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটের কিংবদন্তিদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে মারুফার বোলিং। শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি লাসিথ মালিঙ্গা সেই জোড়া উইকেটের একটি ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করে লিখেছেন ‘দারুণ দক্ষতা, চমৎকার নিয়ন্ত্রণ। এখন পর্যন্ত এই টুর্নামেন্টের সেরা ডেলিভারি।’
ভারতের স্মৃতি মান্ধানাও মারুফার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘ওর বয়স কত, সেটা বড় কথা নয়। মাঠে ও যে চেষ্টা করে এবং ভালো ক্রিকেটার হওয়ার যে আগুন ওর মধ্যে আছে, তা দারুণ।
মারুফার এই কীর্তি ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেখানেও তিনি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরপর ২ বলে বিস্মি গুনারত্নে ও আনুশকা সঞ্জীবনীকে আউট করেছিলেন। এর আগের ওভারেই তিনি ফিরিয়েছিলেন লঙ্কান অধিনায়ক চামারি আতাপাত্তুকে। সেদিন বাংলাদেশের নেওয়া ৩ উইকেটের সব কটিই পেয়েছিলেন মারুফা। যদিও বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরে গিয়েছিল। ২০২৩ সালে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়েও মারুফা ছিলেন নায়ক। মাত্র ২৯ রান দিয়ে ৪ উইকেট তুলে নেন তিনি। স্মৃতি মান্ধানা, প্রিয়া পুনিয়া, আমানজ্যোত কৌর ও স্নেহ রানাকে আউট করে ঐতিহাসিক জয় নিশ্চিত করেন মারুফা। ভারতের স্মৃতি মান্ধানাও মারুফার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘ওর বয়স কত, সেটা বড় কথা নয়। মাঠে ও যে চেষ্টা করে এবং ভালো ক্রিকেটার হওয়ার যে আগুন ওর মধ্যে আছে, তা দারুণ। ওর বলগুলো প্রত্যাশার চেয়ে একটু বেশি স্কিড করে। ঢাকার ধীরগতির উইকেটে ও খুব বেশি সাহায্য পাচ্ছে না। ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় কী করে, তা দেখতে হবে।’ একসময় মারুফা ছিলেন ছিপছিপে এক কিশোরী। মাঠে বলের পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি। প্রতিটি উইকেট পাওয়ার পর গর্জে উঠতেন ডানহাতি এই পেসার। এখন তিনি আরও পরিণত। গতি বাড়াতে জোর দিয়েছেন ফিটনেস ও পাওয়ার ট্রেনিংয়ের ওপর। এই পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের সাবেক স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ ইয়ান ডুরান্টের অধীন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একটি ভিডিওতে মারুফা বলেন, ‘আগে আমি ২৫-৩০ কেজি বেঞ্চ প্রেস করতাম। এখন করি ৪২-৪৪ কেজি। আর ৩০-৩৫ কেজি ওজনের স্কোয়াট এখন ৬০ কেজিতে পৌঁছেছে।’
মন দিয়ে অন্যদের খেলাও দেখেন মারুফা। পাকিস্তানের ডায়ানা বেগ তাঁর বিশেষ পছন্দের। মারুফা বলেন, ‘উনি বেশি শক্তিশালী। ওনার সুইংও আমার পছন্দ। ইনসুইং ও আউটসুইং—দুটোই করতে পারেন তিনি।’
অধিনায়কের চোখে মারুফা
মারুফার শুরুটাও ছিল দুর্দান্ত। ২০২৩ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন তিনি। ২০২২ সালের এশিয়ান গেমসেও তাঁর পারফরম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো। অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি স্টাম্পের পেছন থেকে মারুফার উন্নতি দেখেছেন। জ্যোতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘প্রথম দিকে ও বোলিং নিয়ে খুব বেশি ভাবত না। আমিই ওকে পরিকল্পনা সাজাতে সাহায্য করতাম। কিন্তু ও এখন অনেক পরিণত। এখন নিজের বোলিং–কৌশল নিয়ে ভাবে। ডেথ ওভারে কেমন বল করবে বা বাঁহাতি ব্যাটারদের কীভাবে অ্যাটাক করবে, তা নিয়েও পরিকল্পনা করে।’
করোনা মহামারির সময় আরিফা জাহান বিথির শেয়ার করা ভিডিও মারুফাকে আলোচনায় নিয়ে আসে। বিথি রংপুরে ‘ওমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি’ চালান।
জ্যোতি আরও বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন আমাদের দেশে এমন খেলোয়াড় দেখিনি। ও সত্যিই অনন্য। খুব পরিশ্রমী। ওর অ্যাকশনটাও আলাদা। এভাবে গতি আর সুইং একসঙ্গে করতে পারে, এমন খেলোয়াড় বাংলাদেশে আর নেই। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার, কোচরা ওকে ওর মতোই থাকতে দিয়েছেন। তাঁরা শুধু ওর দক্ষতাকে আরও ধারালো করছেন।’
মাঠ থেকে মাঠের লড়াই
একটা সময় মারুফার জীবন ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। করোনা মহামারির সময় আরিফা জাহান বিথির শেয়ার করা ভিডিও মারুফাকে আলোচনায় নিয়ে আসে। বিথি রংপুরে ‘ওমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি’ চালান। এটি মেয়েদের জন্য বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র একাডেমি। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মারুফা হলুদ জ্যাকেট পরে তাঁর বাবার সঙ্গে ধানের জমিতে লাঙল দিচ্ছেন। এর আগেই তিনি ক্রিকেট স্কাউটদের নজরে পড়েছিলেন। কিন্তু মহামারি আসায় প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর ক্যারিয়ার শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
আরিফা জাহান আনুষ্ঠানিকভাবে মারুফাকে প্রশিক্ষণ না দিলেও তিনি সব সময় তাঁর পাশে ছিলেন। ৩৫০ জন মেয়েকে প্রশিক্ষণ দেন আরিফা। তিনি জানেন, মারুফার মতো প্রতিভা কতটা দুর্লভ। আরিফা জাহান বলেন, ‘মারুফা ছোটবেলা থেকেই মাঠে কঠোর পরিশ্রম করত। ও একজন সহজাত অ্যাথলেট। প্রথম ওভারে ওই ২টি উইকেট নেওয়া দেখে আমার গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। এ দেশের কোনো খেলোয়াড়ের কাছ থেকে আমি এমন পেস বোলিং দেখিনি।’
বদলে যাওয়া জীবন
মারুফার পরিবার কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। লিজ নেওয়া জমিতে তাঁদের সংসার চলে। মারুফার এই উত্থান তাঁর পরিবারের সদস্যদের জীবন বদলে দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে তাঁর বাবার মনোভাবে।
মারুফাকে উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগ বা বিগ ব্যাশ লিগে খেলার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি তখন মিডিয়া ম্যানেজারের দিকে তাকান। মিডিয়া ম্যানেজার এড়িয়ে যান বিষয়টি।
মারুফা আগে বলেছিলেন, ‘শুরুতে আমার পরিবার আমাকে খুব একটা সমর্থন করত না। বাবা একজন কৃষক। তাই তিনি চাইতেন, আমি একটা সাধারণ চাকরি করি। কিন্তু আমি যখন খেলায় দিন দিন ভালো করতে শুরু করলাম, পরিবার আমাকে খুব সমর্থন করতে শুরু করে।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
১৫ বছর বয়সে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ট্রায়ালে নজর কাড়েন মারুফা। এরপর বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া আর এখন জাতীয় দলের প্রধান পেসার। মারুফার এই যাত্রা যে কারও জন্যই অনুপ্রেরণার। একসময়কার লাজুক কিশোরী এখন একজন আত্মবিশ্বাসী পেসার। হাসিমুখে বড় বড় খেলোয়াড়কে চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন তিনি।
মারুফাকে উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগ বা বিগ ব্যাশ লিগে খেলার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি তখন মিডিয়া ম্যানেজারের দিকে তাকান। মিডিয়া ম্যানেজার এড়িয়ে যান বিষয়টি। তবে আরিফা বিশ্বাস করেন, মারুফার প্রতিভা উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগ খেলার যোগ্য। জ্যোতিও মনে করেন, ‘বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স ফ্র্যাঞ্চাইজি দলগুলোকে আকৃষ্ট করবে। এতে সে আরও বেশি পরিচিতি পাবে। তবে ওকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও শক্তি বাড়াতে হবে। ও এখনো তরুণ। ওর অ্যাকশনটা সত্যিই ইউনিক।’
আপাতত মারুফার মন্ত্র একটাই—তাঁর লড়াই সব সময় শুধু নিজের সঙ্গে, অন্যদের সঙ্গে নয়। বিশ্বকাপে যাঁরা এখনো তাঁর মুখোমুখি হননি, তাঁদের জন্য এটা একটা শান্ত সতর্কবার্তা। ক্রিকেট–বিশ্ব তাঁর খেলা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।