২৭ বছর পর ট্রফি এল বাভুমার হাত ধরে 

বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক মেইস বা গদা হাতে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাএএফপি

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিততে দক্ষিণ আফ্রিকার তখনও প্রয়োজন ১ রান। লর্ডসের ড্রেসিং রুম থেকে প্রোটিয়াদের হাসিমুখ তখন চোখে পড়ার মতো। এর মাঝেও একজন বসে আছেন মুখ লুকিয়ে, জনা দশেক হাসিমুখের মাঝে তাঁর চোখে-মুখে তখনও চিন্তার ভাঁজ। এক রান যেন এক রান নয়, দুই যুগের বেশি সময় ধরে লুকিয়ে থাকা আক্ষেপ-হতাশা আর শিরোপা জয়ের ভার। সেই একজন আর কেউ নন, দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। যাঁর শারীরিক গঠন নিয়ে হাসি তামাশা হয়েছে, অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, দলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে পর্যন্ত কাটা-ছেঁড়া হয়েছে। সেই টেম্বা বামুভা দক্ষিণ আফ্রিকাকে পৌঁছে দিলেন শিরোপার দ্বারপ্রান্তে। একেবারে সামনের সারি থেকে। কাইল ভেরেইনা জয়সূচক রান নিশ্চিত হতেই উল্লাসে ফেটে পড়ল দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রেসিংরুম। বাভুমা হাত উঁচিয়ে যেন পুরো বিশ্বকে জানান দিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। 

ফাইনালের আগে থেকেই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফেভারিট ছিল অজিরা। ক্রিকেট ইতিহাসের যে কোনো ফাইনালে ফেভারিটের খাতায় থাকে অজিদের নাম। গত ১৫ বছরে কোনো ফাইনাল হারেনি তারা। ফাইনালে পা রাখা মানেই শিরোপাটা তাদের নামে বরাদ্দ। আর সেই সঙ্গে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বহু বছরের ‘চোকিং’ ইতিহাস। শিরোপার কাছাকাছি এসে, তীরে এসে তরী ডোবানোর ইতিহাস তাদের থেকে বেশি বোধহয় আর কেউ লেখেনি। দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে হয়তো তাই খোদ প্রোটিয়ারাই ভরসা খুঁজে পাচ্ছিল না। 

লর্ডসে প্রথম দুই দিনের পূর্বাভাস বদলে দিয়েছিল পুরো ম্যাচের চিত্র। সকলে ধরেই নিয়েছিল টানা দ্বিতীয় বারের মতো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গদা তুলে ধরতে যাচ্ছেন প্যাট কামিন্স। অস্ট্রেলিয়ার করা ২১২ রানের জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা করেছিল মাত্র ১৩৮। দ্বিতীয় ইনিংস জবাব দিতে নেমে ৭৩ রানে ৭ উইকেট নেই অস্ট্রেলিয়ার। এ তো মাত্র দ্বিতীয় দিনের কথা। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল চতুর্থ দিনে গড়ায় কী না, সে নিয়েই সন্দেহ ছিল অনেকের। 

রান তাড়ায় ১৩৬ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে দক্ষিণ আফ্রিকার নায়ক এইডেন মার্করাম
রয়টার্স

লর্ডসের আবহাওয়ার সঙ্গে বোলাররা যত সহজে খাপ খাইয়েছিলেন, ব্যাটাররা তার ছিটেফোটাও পারেননি। দুই দিনে ২৮ উইকেটের পতন যেন ছিল সেটারই সংকেত। কিন্তু যতদিন গড়াতে লাগলো, আস্তে আস্তে যেন প্রাণ ফিরে পেল পিচ। বোলারদের কার্যকারিতা কমতে থাকল ক্রমশ, ব্যাটাররা লড়তে শুরু করলেন বুক চিতিয়ে। প্রথম প্রতিরোধটা এসেছিল মিচেল স্টার্কের কাছ থেকে। তৃতীয় দিনের শুরুতে তার ১৩৬ বলে ৫৮ রানের উপর ভর করে ২৮২ রানের বিশাল টার্গেট ছুড়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া। তখনও দক্ষিণ আফ্রিকার জেতার কথা ঘুনাঘরেও ভাবতে পারেনি কেউ। 

সেই মুহূর্ত। ভেরেইনা–বেডিংহামরা ছুটছেন জয়সূচক রান নিতে। দক্ষিণ আফ্রিকা চ্যাম্পিয়ন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে
এএফপি

টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো এর দ্বিতীয় ইনিংস। জীবনের মতো টেস্ট ক্রিকেট সবাইকে দ্বিতীয়বার আরেকটি সুযোগ দেয়, পূর্বের সব ভুল সরিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার। দক্ষিণ আফ্রিকা যেন সেই মন্ত্রণা কানে নিয়েই নেমেছিল। ৭০ রানে দুই উইকেট পতনের পর মাঠে নামেন অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। ম্যাচের মোড় ঘুরে যায় সেখান থেকেই। ওপেনার এইডেন মার্করাম মাঠে ছিলেন শুরু থেকেই। ব্যাটে-বলে বেশ জমছিল তাঁর, দরকার ছিল শুধু একজনের সঙ্গ। অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা সেই সঙ্গ দিয়ে গেলেন পুরো দ্বিতীয় দিন। এর মধ্যেই টান লাগলো পায়ে, দৌড়াতে পর্যন্ত অসুবিধে হচ্ছিল তার। মাঝখানে কিছু সময় ঠিকঠাক টাইমিং পর্যন্ত করতে পারছিলেন না। ড্রেসিংরুমে প্রস্তুত হয়ে বসে ছিলেন ট্রিস্টান স্টাবস। যেকোনো মুহূর্তে হয়তো মাঠে ডাক পরবে তাঁর। কিন্তু বাভুমা জানতেন, সেই মুহূর্তে উঠে যাওয়া মানেই ম্যাচের মোমেন্টাম ঘুরে যাওয়া। আর দক্ষিণ আফ্রিকার মোমেন্টাম ঘুরে গেলে কী হয়, তা খুব ভালোভাবেই জানা আছে তার। 

ভঙ্গুর শরীর নিয়ে দলকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন, একবারও ভাবেননি মাঠ ছেড়ে উঠে যাওয়ার কথা ভাবেননি। শরীরটা আটকে গিয়েছিল, কিন্তু বাভুমা এগিয়ে গিয়েছিলেন মনের জোরে। তৃতীয় দিন শেষে অপরাজিত ছিলেন ৬৫ রানে। আর বাভুমার সঙ্গ পেয়ে সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন এইডেন মার্করাম। চতুর্থ দিনের ব্যাটিং শুরুর আগে প্রোটিয়াদের দরকার ছিল মাত্র ৬৯ রান। প্রোটিয়াদের প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পথটা সুদৃঢ় করে এসেছিলেন অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। বাকি পথটা লড়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল বাকিদের। চতুর্থ দিনের শুরুতে প্যাভিলিয়নে ফেরেন বাভুমা। দলকে জয় থেকে মাত্র ৬ রান দূরে রেখে ফেরেন এইডেন মার্করাম। বাকি পথটা পাড়ি দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজ উদৌগ্যেই। 

টেম্বা বাভুমাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। তাঁর গায়ের রং থেকে শুরু করে উচ্চতা — হাসি তামাশা হয়েছে সবকিছু নিয়েই। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটা কখনই তাঁর জন্য ছিল না, সে ফরম্যাটের অধিনায়ক হিসেবে কটু কথাও শুনতে হয়েছে অনেক। সেই বাভুমার নেতৃত্বে ২৭ বছর পর শিরোপা উঁচিয়ে ধরল প্রোটিয়ারা। বাভুমার নেতৃত্বে এখনও সাদা পোশাকে অপরাজিত তারা। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলতে হলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে হতো বাভুমার দলের। সেটা করে দেখিয়েছেন, টানা আট টেস্ট জিতে পরম আরাধ্য শিরোপাটা করে নিয়েছেন নিজের। 

টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা হাতে নিয়ে মনে পড়ছে টেম্বা বাভুমার দাদির গল্প। ফাইনাল শুরুর আগে যে গল্প শুনিয়েছিলেন সকলকে। ‘আমার দাদি আমার নাম রেখেছিলেন টেম্বা। যার অর্থ আশা (হোপ)। পুরো দেশের আশা।’ পুরো দেশের আশা ভরসার প্রতীক হয়ে জয় ছিনিয়ে এনেছেন টেম্বা। অধিনায়ক হিসেবে এর থেকে বড় গর্বের আর কী-ই বা হতে পারে? 

আরও পড়ুন