কেমন গেল বাংলাদেশের মেয়েদের বিশ্বকাপ

বাংলাদেশের নারীদের বিশ্বকাপ–যাত্রা কেমন ছিল? কাগজে–কলমে হিসাব করতে বসলে ব্যর্থতার মোড়কে আরেকটি অধ্যায়। আর খেলা দেখে বললে? হতাশার মাঝেও একটুখানি আশার আলো। একই সঙ্গে মুদ্রার দুই পিঠই দেখেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। বিশ্বকে যেমন দেখিয়েছে কেন ভয় পেতে হবে বাংলার বাঘিনীদের, তেমনই দেশি সমর্থকদের দেখিয়েছে আশাহত করতে আমরাও পারি।

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বেই যাত্রা শেষ হয়েছে বাংলাদেশের। ৭ ম্যাচ শেষে জয় মাত্র একটিতে, একটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ায় নামের পাশে যুক্ত হয়েছে আরেকটি পয়েন্ট। সব মিলিয়ে ৭ ম্যাচে ৩ পয়েন্ট নিয়ে দেশে ফিরেছে মেয়েরা। কিন্তু এই জায়গা থেকেই সম্ভাবনা ছিল বাংলাদেশের সেমিফাইনাল খেলার। শুধু চাপের মধ্যে নিজেদের স্নায়ু ধরে রাখতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে পুরো দলকে। তবে ফলাফলটাই তো আর শেষ কথা নয়, নিয়মিত বাংলাদেশের খেলা দেখা দর্শকদের আশার ফুল ফুটিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত করেছে মেয়েরা।

আরও পড়ুন

দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের মূল আসরে খেলার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচেই চমকে দিয়েছে পাকিস্তানকে হারিয়ে। মারুফা আখতার ও স্বর্ণা আখতারের দুর্দান্ত বোলিংয়ে পাকিস্তান অলআউট হয়ে যায় ১২৯ রানে। সেই রান পার করতে বাংলাদেশের লাগে মাত্র ৩১ ওভার। তবে সেদিন বাংলাদেশের জয়কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ২০ বছর বয়সী মারুফা আখতারের বোলিং। কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে মারুফার সুইং শুধু পাকিস্তানি ব্যাটারদের ভড়কে দেয়নি, প্রশংসা কেড়েছিল তাবৎ দুনিয়ার নামীদামি বোলারদের। ওয়াসিম আকরাম প্রশংসা করেছেন, লাসিথ মালিঙ্গা তো তাঁর বোলিংয়ের ভিডিও শেয়ার করেছেন নিজের পেজ থেকে। প্রথম ম্যাচের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স বাংলাদেশকে তুলে দেয় অনন্য উচ্চতায়।

পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে দুর্দান্ত বোলিং করেন মারুফা
এএফপি

দ্বিতীয় ম্যাচেও জয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমে ব্যাটিং করে মাত্র ১৮৭ রান করতে পারে বাংলাদেশ। বল হাতে আরও দুর্দান্ত বাংলাদেশ, ৭৮ রানের মধ্যেই নেই ইংল্যান্ডের ৫ উইকেট। এরপরই একটি সিদ্ধান্ত বদলে দিল ম্যাচের মোড়। হিদার নাইটের ওঠা ক্যাচ মাঠের আম্পায়ার জানিয়েছিলেন আউট। কিন্তু তৃতীয় আম্পায়ার ছিলেন দোটানায়। নিয়ম অনুযায়ী দোটানায় থাকলে মাঠের আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই বলবৎ থাকবে। কিন্তু মাঠের আম্পায়ার সিদ্ধান্ত বদলে দেন, হিদার নাইটকে সুযোগ দেন আরেকবার। শেষ পর্যন্ত তাঁর ১১১ বলে ৭৯ রানের ইনিংস এনে দেয় ইংল্যান্ডের জয়। একে তো দলের সেরা বোলার মারুফা আখতারের চোট, অন্যদিকে চাপের মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলা। দুইয়ে মিলে ১০৬ রানে ৬ উইকেটের পতন ঘটিয়েও ম্যাচটা নিজেদের করে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। ৪ ওভার হাতে রেখে ৪ উইকেটের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইংল্যান্ড।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের তৃতীয় ম্যাচ ছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। এই একটি ম্যাচেই কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি বাংলার নারীরা। প্রথমে ব্যাট করে ২২৭ রান করে কিউই নারীরা। সেই লক্ষ্য ধাওয়া করে মাত্র ১২৭ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ।

চতুর্থ ম্যাচে আবারও চমক নিয়ে হাজির হয় বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে ২৩২ রানের বিশাল এক সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। যেখানে ৩৫ বলে ৫১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে তাক লাগিয়ে দেন স্বর্ণা আখতার। বল হাতে বরাবরের মতোই দুর্দান্ত বাংলাদেশ। ৭৮ রানে নেই ৫ উইকেট। সেখান থেকে বড় দুটি জুটি। তবু ১৯৮ রানে সপ্তম উইকেটের পতনের পর বাংলাদেশের জন্য জয় ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু তখনই আবির্ভূত হন নাদিন ডি ক্লার্ক। চাপে পড়ে বরাবরের মতো খেই হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। ক্যাচ মিস, স্ট্যাম্পিং মিস করে সহজ ম্যাচটা ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ। ডি ক্লার্কের দুর্দান্ত ব্যাটিং আর আত্মবিশ্বাসের কাছে হারতে হয় বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল নিগার সুলতানা–শারমিন আক্তারের জুটি
এএফপি

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোনো পাত্তাই পায়নি বাংলাদেশ। ১৯৮ রানের টার্গেট অস্ট্রেলিয়া পার করেছে কোনো উইকেট না হারিয়েই। পরের ম্যাচেই আবার স্বরূপে ফেরে বাংলাদেশ, ২০২ রানে অলআউট করে দেয় শ্রীলঙ্কাকে। বাকি দায়িত্ব ছিল ব্যাটারদের কাঁধে। একটা সময় পর্যন্ত জয়ের স্বপ্নই দেখছিল বাংলাদেশ। শেষ দুই ওভারে ১৩ রান, হাতে ৬ উইকেট। বাংলাদেশি ব্যাটারদের জন্য এ তো সহজ ব্যাপার। কিন্তু সহজ ব্যাপারটাই সহজ করতে গিয়ে আর শেষই করতে পারল না বাংলাদেশ। ৪৯তম ওভারে ১ উইকেট হারিয়ে তুলতে পারল ৩ রান। শেষ ওভারের প্রথম চার বলে চার উইকেট হারাল বাংলাদেশ। ৪ উইকেটে ১৯১ থেকে বাংলাদেশ ম্যাচ শেষ করল ৯ উইকেটে ১৯৫ রান নিয়ে। ৭ রানের এক অবিশ্বাস্য হার নিয়ে মাঠ ছাড়তে হলো বাংলাদেশকে। ভক্ত–সমর্থকেরা দূরে থাক, শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়েরা পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, এভাবে একটা ম্যাচ বিলিয়ে দিয়ে এসেছে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ ছিল ভারতের বিপক্ষে। বৃষ্টির কারণে ২৭ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে বাংলাদেশ করেছিল ৯ উইকেটে ১১৯। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৮ ওভার ৪ বলে ৫৭ রান করতেই হানা দেয় বৃষ্টি। পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ায় এক পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছে ভারত আর বাংলাদেশ।

রেকর্ড ফিফটির পর বাংলাদেশের স্বর্ণা আক্তার
আইসিসি

দ্বিতীয়বারের মতো এক দিনের বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া বাংলাদেশ হেরেছে মূলত চাপের কাছে। নইলে ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিততে আলাদা করে কিছু করতে হতো না বাংলাদেশকে। শুধু নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে হতো। কিন্তু সেটাই করতে পারেনি বাংলাদেশ। নিয়মিত ম্যাচ না খেলা, আন্তর্জাতিক ম্যাচের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা —সব অভিযোগই আছে বিসিবির বিপক্ষে। চাপ সামলানোর জন্য যে পরিমাণ ম্যাচ খেলা প্রয়োজন, যে পরিমাণ অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, তা যথেষ্ট পরিমাণ পায় না বাংলাদেশের নারী দল। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গিয়ে কীভাবে নিজেকে ধরে রাখতে হয়, সেটাও শেখা হয়ে ওঠেনি। অন্যান্য দল যখন বিশ্বকাপের আগে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে, বাংলাদেশ দল মুখোমুখি হয়েছে অনূর্ধ্ব-১৫ ছেলেদের দলের বিপক্ষে। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি আর চাপ সামলানোর ক্ষমতা ছাড়াই এত দূর এগিয়েছে বাংলাদেশের নারীরা। বিশ্বকাপের ফলাফল নিয়ে হতাশ হলেও তাই বলতে হয়, নারীদের সেরা অর্জন এই পারফরম্যান্সই।

আরও পড়ুন