কেন ওয়ানডেতে পারছে না বাংলাদেশ
একটা সময় ছিল, যখন ওয়ানডে ফরম্যাট ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রিয়। দুর্দান্ত কম্বিনেশনে যিনি মাঠে নামতেন, তিনিই যেন নিজের সেরা ফর্মে চলে আসতেন। বিশেষ করে ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে ২০১৯ বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত, চার বছর বাংলাদেশ ছিল দুর্দান্ত ফর্মে। এমনকি কোভিড–পরবর্তী বাংলাদেশও নিয়মিত সিরিজ জিতেছে, প্রতিপক্ষকে নাকানিচুবানি খাইয়েছে। কিন্তু হুট করেই কী এমন হলো যে নিজেদের ‘প্রিয়’ ফরম্যাটটাই হয়ে উঠল মাথাব্যথার কারণ?
সর্বশেষ ১১ ম্যাচের ১০টিতেই হার। ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ আছে ১০ নম্বরে। টানা চারটি সিরিজের চারটিতেই বাজে ব্যবধানে হার। সর্বশেষ এমন ঘটনার সম্মুখীন বাংলাদেশ হয়েছিল ২০১১ সালে। সেবার বাংলাদেশ সিরিজ হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া, জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের বিপক্ষে। সর্বশেষ আটটি সিরিজ বিবেচনা করলে মাত্র একটি সিরিজে জয়ের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে আফগানদের বিপক্ষে রয়েছে তিনটি সিরিজ। টানা ব্যর্থতার কারণ খুঁজে পেতে একটু পেছনে ফিরতেই হচ্ছে বাংলাদেশকে।
বল হাতে বাংলাদেশের ব্যর্থতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের বোলিং লাইন আপ আছে ফর্মের তুঙ্গে। বিশেষ করে পেসারদের সামনে বিশ্বের যেকোনো প্রতিপক্ষকে নিজেদের সামলাতে বেগ পেতে হয়। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কোনোভাবেই সেই প্রতিদান দিতে পারছেন না। গত দুই বছরে অর্থাৎ ২০২৩ বিশ্বকাপের পর থেকে বাংলাদেশ ২৫০ এর ওপর রান করেছে মাত্র ৬টি ম্যাচে। ১৯ ম্যাচের মধ্যে ২ ম্যাচে বাংলাদেশের টার্গেট ছিল ২৫০-এর কম। সেই দুই ম্যাচ বাদ দিলে ১৭ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ৬ ম্যাচে ২৫০-এর কাঁটা পেরোতে পেরেছে বাংলাদেশের ব্যাটাররা। সেখানে ৩০০+ ইনিংস মাত্র একটি—২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩২১। ক্রিকেটে যেখানে ৩০০ রান খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠছে, সেখানে ২৫০ পেরোতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। এর মূল কারণ ব্যাটিংয়ে মানিয়ে নিতে না পারা।
পাঁচ বছর আগের দলের সঙ্গেও বর্তমান বাংলাদেশ দলের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। একসময় দল চষে বেড়াতেন ‘পঞ্চপাণ্ডব’। মাশরাফি বিন মুর্তজার বিদায়ের পর চার ‘পাণ্ডব’ সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ছিলেন দলের কাণ্ডারি। বলা বাহুল্য, চারজনই নিজেদের মতো করে সামলে নিতেন বাংলাদেশের ব্যাটিং। ওপেনিংয়ে তামিম যেমন ছিলেন, তেমনই মিডল অর্ডার মুশফিক-সাকিব-রিয়াদ নিয়মিতই হাল ধরতেন। যে কারণে বাংলাদেশের ব্যাটিং ইনিংস দাঁড়িয়ে যেত সহজেই। তরুণেরা ব্যর্থ হলেও কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে একটা সম্মানজনক লক্ষ্যে পৌঁছে দিতেন। অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে যখন যেরকম প্রয়োজন হতো, সেভাবেই খেলতে পারতেন তাঁরা। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও দলকে সাজাতেন সেভাবেই। কিন্তু বিশ্বকাপের পর থেকে এক এক করে ঝরে যাওয়া তারকার ভার আর সামাল দিতে পারেনি বাংলাদেশ।
তামিম ইকবাল দলে নেই বিশ্বকাপের আগে থেকেই। সাকিব আল হাসানও দলে অনুপস্থিত। মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ অবসর নিয়েছেন একসঙ্গে। বাংলাদেশ দলে ‘মিডল অর্ডার ক্রাইসিস’ হিসেবে যা ভাবা হচ্ছিল, যে আশঙ্কা ছিল ভক্তদের মধ্যে, তাই যেন সত্যি হয়েছে ২০২৪ সালে এসে। এবং সেটা সামাল দেওয়ার কেউ নেই। কারণ, ভালো মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানের অভাব।
বাংলাদেশ দল এখন চলছে রীতিমতো জোড়াতালি দিয়ে। দলের মূল ওপেনার হিসেবে রয়েছেন তানজিদ হাসান তামিম। অথচ ২৭ ম্যাচ খেলে তাঁর গড় মাত্র ২০। তাঁর সঙ্গে জুটি গড়ছেন একেক দিন একেকজন। ওয়ান ডাউনে নাজমুল হাসান শান্তও অফ ফর্মে। অধিনায়কত্ব থাকাকালীনও তাঁর ওপর বড় ইনিংসের আশা করা যেত না। এখনো সেই অফ ফর্ম কাটেনি তাঁর। তাওহিদ হৃদয় শুরুতে আশার ঝলকানি দেখালেও সেই মোহ কেটে গেছে কিছুদিনের মধ্যেই। মিডল অর্ডারে তাই নিয়মিত দেখা মেলে অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের। বয়সভিত্তিক দলে মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করলেও জাতীয় দলে এসে তিনি পুরোদস্তুর বোলার। মিডল অর্ডারে রান যেন আছে শুধু তাঁর ব্যাটেই। ১৭ ইনিংসে ৩০ গড়ে তাঁর রান ৪৭১। কিন্তু ৭০ স্ট্রাইক রেটে মিরাজের ব্যাটিং কোনোভাবেই বর্তমান যুগের সঙ্গে যায় না। মিডল অর্ডারের বাকি জায়গাতে ঘুরেফিরে আসছে কয়েকটি নাম। জাকের আলী, নুরুল হাসান সোহান ও শামীম হোসেন। এঁদের কেউই মিডল অর্ডারের ব্যাটসম্যান নন। বরং নিচে নেমে ক্যামিও ইনিংসেই স্বাচ্ছন্দ্য তাঁদের।
বর্তমানে মিডল অর্ডারে ঘুরেফিরে যাঁদের নাম আসছে, তাঁদের কেউই নিয়মিত মিডল অর্ডারে খেলেন না। সেটা জাতীয় দলে হোক কিংবা লিগে। প্রত্যেকেই দলে প্রবেশ করেছেন অন্য পজিশনে সফলতা পেয়ে। লিটন ছিলেন ওপেনার, জাকের-সোহান-মিরাজ খেলেন লোয়ার মিডল অর্ডারে। ইনিংসের মাঝখানে ধীরেসুস্থে ইনিংস তৈরি করার গুরুদায়িত্ব যেভাবে তুলে নিতেন সাকিব-মুশফিক-রিয়াদ, সে জায়গায় বিশাল এক শূন্যতা। সেই শূন্যতা পূরণের দায়িত্ব নেওয়ার মতো যোগ্য হয়ে ওঠেননি কেউ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে শোচনীয় সিরিজ হারই তার প্রমাণ।
ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশকে পুরোনো ফর্মে ফিরতে হলে দরকার মিডল অর্ডারকে শক্ত করা। প্রতিদিন হয়তো আগ্রাসী সূচনা আসবে না। প্রতিদিন লোয়ার মিডল অর্ডার থেকেও রান আসবে না। কিন্তু ৩-৬ নম্বর পজিশনে ব্যাট করা প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছু হলেও রান আসতে হবে। এক দিনের ক্রিকেটে রান করতে চাইলে এই জায়গায় হেলাফেলা করার কোনো সুযোগই নেই। যত দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে বাংলাদেশ, তত দ্রুত ‘ফর্মে’ ফিরবে বাংলাদেশ।