এর আগে কখনও কি ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল হয়েছে?
এশিয়া কাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফাইনালে মুখোমুখি হতে চলেছে ভারত আর পাকিস্তান। ৪৩ বছর ধরে চলা টুর্নামেন্টের ১৭টি আসরে এখনও পর্যন্ত একবারও মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়নি ভারত আর পাকিস্তানের। যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, ঘুরে ফিরে কেউ না কেউ এসে সেই আশায় পানি ঢেলে দিতো। পুরো ক্রিকেট বিশ্ব কিংবা নির্দিষ্ট করে বললে এসিসি (এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল) যখন অপেক্ষায় থাকে ভারত পাকিস্তানকে মুখোমুখি করার, তখন বড় মঞ্চের ফাইনালে তাদের দেখা হয়ই না কখনও। কিন্তু তাই বলে যে ফাইনালে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হয়নি, তা কিন্তু নয়।
এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে মোট ১০টি টুর্নামেন্টের ফাইনালে দেখা হয়েছে তাদের। ১২ বার মুখোমুখি হয়ে পাকিস্তান জিতেছে ৮ বার অন্যদিকে ভারত জিতেছে ৪ বার। খটকা লাগতে পারে, ১০ টুর্নামেন্টের ফাইনালে দেখা হলে ১২ বার খেলা হয় কী করে? সেটার উত্তর জানতে পারবে লেখাটা পরলেই। শুরু করা যাক একেবারে শুরু থেকে। এশিয়া কাপের ফাইনাল দেখার আগে ইতিহাসটাও একটু ঝালাই করে নাও।
১৯৮৫ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ
ফলাফল: ভারত ৮ উইকেটে জয়ী
তৎকালীন টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বসেছিল বিশ্বকাপের মতো এক আসর। ১৯৮৫ সালের সেই টুর্নামেন্টের ফাইনালে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয় ভারত আর পাকিস্তান। মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত সেই ফাইনালে ৫০ ওভারের মাত্র ১৭৬ রান করেছিল পাকিস্তান। মাত্র দুই উইকেট হারিয়ে হেসেখেলে সে ম্যাচে জয় তুলে নেয় ভারত।
১৯৮৬ অস্ট্রেলেশিয়া কাপ
ফলাফল: পাকিস্তান ১ উইকেটে জয়ী
এশিয়া মহাদেশের তিন দল ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা আর অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের দুই দল অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলেশিয়া কাপের যাত্রা। সেটিই ছিল এই টুর্নামেন্টের প্রথম আসর। শারজাহতে অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্টের ফাইনালে দেখা মিলে জমজমাট এক ম্যাচের। প্রথমে ব্যাট করে সুনীল গাভাষ্কারের ৯২ রানের উপর ভর করে ২৪৫ রানের বিশাল টার্গেট দেয় ভারত। কিন্তু ফাইনালে সব আলো কেড়ে নেন জাভেদ মিয়াদাদ। ভারতের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনেন ম্যাচের ফলাফল। চেতন শর্মাকে শেষ বলে ছক্কা মেরে শিরোপা নিশ্চিত করেন মিয়াদাদ। চাপের মধ্যে তার করা ১১৪ বলে ১১৬ রানের ইনিংস ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম ইনিংস হিসেবে ধরা হয়।
১৯৯১ উইলস ট্রফি
ফলাফল: পাকিস্তান ৭২ রানে জয়ী
ভারত, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল ছিল এটি। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৬ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান করে ২৬২ রান। সেই রান তাড়া করতে নেমে ১৯০ রানেই গুটিয়ে যায় ভারত। ৩৭ রানে ৭ উইকেট নিয়ে ইতিহাস রচনা করেন পাকিস্তানি বোলার আকিব জাভেদ, এর মধ্যে ছিল হ্যাটট্রিকও। যা ছিল তৎকালীন সময়ের সেরা বোলিং ইনিংস। প্রায় ৯ বছর সে রেকর্ড নিজের করে রাখেন তিনি।
১৯৯৪ অস্ট্রেলেশিয়া কাপ
ফলাফল: পাকিস্তান ৩৯ রানে জয়ী
অস্ট্রেলেশিয়া কাপের প্রথম টুর্নামেন্টের মতো শেষ টুর্নামেন্টের ফাইনালেও মুখোমুখি হয় ভারত আর পাকিস্তান। পাকিস্তান প্রথমে ব্যাট করে ২৫০ রানের স্কোর দাড় করায়। জবাব দিতে নেমে ভারত অল আউট হয় মাত্র ২১১ রানে।
১৯৯৮ সিলভার জুবলি ইন্ডিপেন্ডেস কাপ
ফলাফল: ২-১ ব্যবধানে ভারত জয়ী
লেখার শুরুতে অঙ্কের গড়মিল বলছিলাম না? অঙ্কের গড়মিল মূলত শুরু হয়েছে এই টুর্নামেন্টে এসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয় ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানকে নিয়ে। ফাইনালে মুখোমুখি হয় ভারত আর পাকিস্তান। কিন্তু সেই টুর্নামেন্টের ফাইনাল এক ম্যাচ নয়, ছিল তিন ম্যাচের!
প্রথম ফাইনাল ম্যাচটা জিতে নেয় ভারত। পাকিস্তানের দেওয়া ২১২ রানের টার্গেট মাত্র ২ উইকেট হারায় ভারত। সেই ম্যাচে শচীন টেন্ডুলকারের ৯৮ রানের ইনিংস এখনও অনেকের চোখে ভাসে।
দ্বিতীয় ফাইনালে ফিরে আসে পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাট করে ১৮৯ রানে অলআউট হয়ে যায় ভারত। পাকিস্তান মাত্র ৪ উইকেট হারিয়ে জিতে নেয় সেই ম্যাচ। দুই দল একটি করে ম্যাচ জেতায় তৃতীয় ফাইনালটা হয়ে উঠে সত্যিকারের ফাইনাল। আর সেখানেই টানটান উত্তেজনা।
বৃষ্টির কারণে ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমে আসে ২ ওভার। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান ৪৮ ওভারে করে ৩১৪ রান! সেই সময়ে এত রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড ছিল না কারোর। কিন্তু ভারতও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সৌরভ গাঙ্গুলির ১৩৮ বলে ১২৪, শচীনের উড়ন্ত ২৬ বলে ৪১ আর রবিন সিংয়ের ৮৩ বলে ৮২। তিন ইনিংসে ভর করে ১ বল হাতে রেখে জয় তুলে নেয় ভারত।
১৯৯৯ পেপসি কাপ
ফলাফল: পাকিস্তান ১২৩ রানে জয়ী
১৯৯৯ সালে ভারত, পাকিস্তান আর শ্রীলংকাকে নিয়ে আয়োজন করা হয় একটি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট। সেই টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে ভারত আর পাকিস্তান। সেই ম্যাচে পাকিস্তানের ২৯১ রানের জবাবে মাত্র ১৬৮ রানেই অল আউট হয়ে যায় ভারত।
১৯৯৯ কোকাকোলা কাপ
ফলাফল: পাকিস্তান ৮ উইকেটে জয়ী
আবারও ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট। এবার ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে ইংল্যান্ড। শারজাহতে সেই ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করে মাত্র ১২৫ রান করে ভারত। সেই রান টপকাতে পাকিস্তানের খরচ হয় মাত্র ২ উইকেট আর ২৮ ওভার।
২০০৭ আইসিসি টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপ
ফলাফল: ভারত ৫ রানে জয়ী
নব্বইয়ের দশকে যে হারে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হয়েছে ফাইনালে, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। তাই তো প্রায় ৮ বছর বিরতি দিয়ে আবারও ফাইনালে মুখোমুখি হয় ভারত আর পাকিস্তান। সেটাও আবার বিশ্বকাপের ফাইনালে। ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো বসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর। আর সেখানেই মুখোমুখি হয় দুই দল। প্রথমে ব্যাট করে ভারত করে ১৫৭ রান। পাকিস্তান প্রায় ধরেই ফেলেছিল ভারতকে। শেষ ওভারে দরকার ছিল ১৩ রান। ছয় মেরে মিসবাহ-উল হক খেলায় ফিরিয়েছিলেন ভারতকে। কিন্তু উচ্চাভিলাসী এক স্কুপ ভেঙে দেয় সব স্বপ্ন। ৫ রানে জিতে যায় ভারত। উচিয়ে ধরে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা।
২০০৮ কিটপ্লে কাপ
ফলাফল: পাকিস্তান ২৫ রানে জয়ী
ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে নিয়ে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আয়োজন করা একটি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট। সেখানেও ফাইনালে মুখোমুখি ভারত আর পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাট করে সালমান বাট আর ইউনিস খানের সেঞ্চুরিতে ৩১৫ রানের একটা বিশাল স্কোর দাঁড় করায় পাকিস্তান। জবাবে ভারত অলআউট হয়ে যায় ২৯০ রানে।
২০১৭ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি
ফলাফল: পাকিস্তান ১৫৮ রানে জয়ী
আবারও প্রায় ৯ বছর বিরতি দিয়ে ফাইনালে মুখোমুখি হয় ভারত-পাকিস্তান। রাজনৈতিক অস্থিরতায় এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আর ত্রিদেশীয়, দুই ধরনেই সিরিজই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আইসিসি টুর্নামেন্ট আর এশিয়া কাপই ভরসা। সেই সুযোগ এনে দেয় চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান সংগ্রহ করে ৩৩৮ রান। ফখর জামান ১০৬ বলে করেন ১১৪। ভারত সে ম্যাচে সামান্যতম প্রতিরোধও গড়তে পারেনি। মোহাম্মদ আমিরের দূর্দান্ত স্পেলে মাত্র ১৫৮ রানেই গুটিয়ে যায় ভারত। সর্বোচ্চ ৭৬ রান এসেছিল হার্দিয়া পান্ডিয়ার ব্যাট থেকে।
এই গেল ভারত পাকিস্তানের ১০ টুর্নামেন্টে ১২ ফাইনালের গল্প। ১৩ তম বারের মতো ফাইনালে মুখোমুখি হতে চলেছে ভারত-পাকিস্তান। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে দ্বিতীয় আর এশিয়া কাপে প্রথম। মজার ব্যাপার হলো সবচেয়ে বেশিবার ভারত-পাকিস্তান ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতেই। আর বাংলাদেশই ঠেলেঠুলে নিশ্চিত করেছে ভারত-পাকিস্তানের ফাইনাল। কী মনে হয়, আজকে রাতে কার মুখে হাসি ফুটবে?