মাঠের ক্রিকেটে ভাই ভাই
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য সম্মানের। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে পারে মাত্র অল্প কয়েকজন খেলোয়াড়। কিন্তু সেই অল্প কয়েকজনের মধ্যে যদি থাকে একই পরিবারের দুই ভাই, গল্পটা আরও বিশেষ হয়ে ওঠে। ক্রিকেট বিশ্ব যুগ যুগ ধরে এমন অনেক ভাইয়ের জুটিকে দেখেছে। তাঁরা একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন, একে অপরকে সাহস জুগিয়েছেন এবং দেশকে জিতিয়েছেন। চলো, আজ ক্রিকেট মাঠের এমন কিছু বিখ্যাত ভাইয়েদের জুটির গল্প জেনে নিই।
স্টিভ ও মার্ক ওয়াহ্: অস্ট্রেলিয়ার যমজ কিংবদন্তি
ভাইদের জুটির কথায় অস্ট্রেলিয়ার ওয়াহ্ ভাইদের নাম নিতেই হবে। স্টিভ ও মার্ক ওয়াহ্ ছিলেন যমজ। ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগ থেকে এক যুগের বেশি সময় ধরে তাঁরা অস্ট্রেলিয়া দলের অপরিহার্য অংশ ছিলেন। স্টিভ ওয়াহ্ পরিচিত ছিলেন তাঁর কঠিন মানসিকতা ও লড়াকু ব্যাটিংয়ের জন্য। অন্যদিকে, মার্ক বিখ্যাত ছিলেন তাঁর শৈল্পিক ও দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ের জন্য। মার্ক ওয়াহ্র ব্যাটিংকে ‘শিল্প’ হিসেবে মানতেন অনেকেই। দুজনই ১৯৯৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের সদস্য। স্টিভ ওয়াহ্ অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলে পরিণত করেন। স্টিভ ১৬৮ টেস্টে ১০ হাজারের বেশি রান করেছেন। অন্যদিকে মার্ক ১২৮ টেস্টে করেছেন ৮ হাজারের বেশি রান। পরিসংখ্যান এবং অধিনায়ক হিসেবে সাফল্যের বিচারে স্টিভকে এগিয়ে রাখা হলেও মার্কের মতো সহজাত প্রতিভা খুব কমই দেখা গেছে।
অ্যান্ডি ও গ্রান্ট ফ্লাওয়ার: জিম্বাবুয়ের দুই স্তম্ভ
নব্বইয়ের দশকে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বিশ্বমঞ্চে নিজেদের পরিচয় তৈরি করে। এর পেছনের মূল শক্তি ছিলেন ফ্লাওয়ার ভাইয়েরা। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এবং উইকেটকিপার। ছোট ভাই গ্রান্ট ফ্লাওয়ার ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য ওপেনিং ব্যাটসম্যান এবং স্পিনার। প্রায় এক দশক ধরে এই দুই ভাই জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং লাইনআপকে একাই টেনে নিয়ে গেছেন। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে জিম্বাবুয়ের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ৬৩ টেস্টে ৪ হাজার ৭৯৪ রান এবং ২১৩ ওয়ানডেতে ৬ হাজার ৭৮৬ রান করেছেন।
ইরফান ও ইউসুফ পাঠান: ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক
ভারতের হয়ে পাঠান ভাইদের উত্থান ছিল এক রোমাঞ্চকর গল্প। বড় ভাই ইউসুফ পাঠান তাঁর বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি যেকোনো বোলিং আক্রমণ গুঁড়িয়ে দিতে পারতেন। ছোট ভাই ইরফান পাঠান শুরুতে তাঁর অসাধারণ সুইং বোলিং দিয়ে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পরে তিনি একজন নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচিতি পান। ২০০৭ সালে ভারতের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে এই দুই ভাইয়েরই বড় অবদান ছিল। ইরফান ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন। যদিও ইরফানের ক্যারিয়ার শুরুতে যতটা প্রতিশ্রুতি জাগিয়েছিল, ততটা দীর্ঘ হয়নি। কিন্তু এই দুই ভাইয়ের জুটি ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে সবসময়ই এক বিশেষ জায়গা করে রাখবে।
হার্দিক ও ক্রুনাল পান্ডিয়া: ভারতের আধুনিক অলরাউন্ডার জুটি
পাঠান ভাইদের পর ভারতের হয়ে খেলা আরেক বিখ্যাত ভাইদের জুটি হলেন পান্ডিয়া ভাইয়েরা। বড় ভাই ক্রুনাল পান্ডিয়া একজন বাঁহাতি স্পিনার এবং ব্যাটসম্যান। ছোট ভাই হার্দিক পান্ডিয়া বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা পেস বোলিং অলরাউন্ডার। দুজনেই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে একসঙ্গে খেলে তারকা হয়েছেন। পরে ভারতের হয়েও বেশ কিছু ম্যাচে একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন। হার্দিক ভারতের জাতীয় দলের অপরিহার্য অংশ হলেও ক্রুনালের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ততটা সফল হয়নি। তবে আইপিএলে তাঁদের জুটির সাফল্য ভোলার মতো নয়।
অ্যালবি ও মর্নে মরকেল: দক্ষিণ আফ্রিকার দুই শক্তি
দক্ষিণ আফ্রিকার মরকেল ভাইয়েরা ছিলেন যেকোনো দলের জন্য এক আতঙ্কের নাম। ছোট ভাই মর্নে মরকেল ছিলেন লম্বা, গতিময় এবং ভয়ংকর ফাস্ট বোলার। তার বাউন্স আর গতি সামলাতে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানরাও হিমশিম খেতেন। অন্যদিকে, বড় ভাই আলবি মরকেল ছিলেন দারুণ অলরাউন্ডার। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর বড় বড় ছক্কা মারার ক্ষমতা তাকে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। দুজনেই দীর্ঘদিন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে একসঙ্গে খেলেছেন এবং দলকে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে মর্নে মরকেলের সাফল্য নিঃসন্দেহে তার ভাইয়ের চেয়ে বেশি। বর্তমানে দুই ভাই দায়িত্ব পালন করছেন কোচ হিসেবে। মর্নে ভারত জাতীয় দলের বোলিং কোচ। আর অ্যালবি মরকেল দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।
মাইকেল ও ডেভিড হাসি: অস্ট্রেলিয়ার আরেক ভাই ভাই জুটি
অস্ট্রেলিয়ার হাসি ভাইদের গল্পটা একটু অন্যরকম। বড় ভাই মাইকেল হাসি অনেক দেরিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ পান। তাঁর বয়স তখন প্রায় ৩০ বছর। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ‘মিস্টার ক্রিকেট’ খেতাব অর্জন করেন। তিন ফরম্যাটেই তিনি ছিলেন দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। তাঁর ছোট ভাই ডেভিড হাসিও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন। তবে তিনি মূলত সাদা বলের ক্রিকেটে বেশি পরিচিত ছিলেন। এই দুই ভাইও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতির বিচারে মাইকেল হাসি যোজন যোজন এগিয়ে।
টম ও স্যাম কারেন: ইংল্যান্ডের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি
ইংল্যান্ডের কারেন ভাইয়েরা বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম প্রতিভাবান জুটি। বড় ভাই টম এবং ছোট ভাই স্যাম পেস বোলিং অলরাউন্ডার। তাঁরা একসঙ্গে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট দল সারের হয়ে খেলেন। তাঁরা ইংল্যান্ডের হয়েও বেশ কিছু ম্যাচে একসঙ্গে খেলেছেন। স্যাম কারেন ২০২২ সালে ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ে অসাধারণ ভূমিকা রাখেন এবং টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। এই অর্জনের কারণে তিনি তাঁর ভাইয়ের চেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশি সাফল্য পেয়েছেন। তাদেঁর আরেক ভাই বেন কারেন খেলছেন জিম্বাবুয়ে দলে।
ব্রেন্ডন ও নাথান ম্যাককালাম: নিউজিল্যান্ডের দুই পরিচিত মুখ
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের দুই পরিচিত মুখ ম্যাককালাম ভাইয়েরা। ছোট ভাই ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ছিলেন বিস্ফোরক ব্যাটিং এবং আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্বের জন্য বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। তিনি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটকে এক নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। অন্যদিকে বড় ভাই নাথান ম্যাককালাম ছিলেন অফ-স্পিনার। তিনিও শেষের দিকে মাঠে নেমে রান করতে পারতেন। সাদা বলের ক্রিকেটে বহু বছর ধরে তারা নিউজিল্যান্ড দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। খ্যাতির দিক থেকে ব্রেন্ডন অনেক এগিয়ে থাকবেন নিঃসন্দেহে।
শন ও মিচেল মার্শ: অস্ট্রেলিয়ার আধুনিক জুটি
অস্ট্রেলিয়ার আরও একটি ভাই ভাই জুটি আছে—মার্শ ভাইয়েরা। বড় ভাই শন মার্শ একজন স্টাইলিশ বাঁহাতি টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান। ছোট ভাই মিচেল মার্শ দারুণ অলরাউন্ডার। দুজনেই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তিন ফরম্যাটেই খেলেছেন। বহু ম্যাচে তাঁরা একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন। ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের ফাইনালে মিচেল মার্শ ম্যাচসেরা হয়েছিলেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই দুই ভাই অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটে নিজেদের জায়গা পাকা করেছেন। মিচেল মার্শ বর্তমানে অজিদের টি-টোয়েন্টি ক্যাপটেন। বর্তমানে তিনি দারুণ ফর্মে আছেন। দিন দুয়েক আগেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করে একাই ম্যাচ জিতিয়েছেন।
অর্জুনা ও ধাম্মিকা রানাতুঙ্গা: শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক
শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে রানাতুঙ্গা পরিবারের অবদান অনেক। বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গার ভাইদের মধ্যে ধাম্মিকা রানাতুঙ্গাও শ্রীলঙ্কার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। অর্জুনা যখন দলের অধিনায়ক, তখন তাঁর অধীনেই ধাম্মিকা বেশ কিছু ওয়ানডে ম্যাচে একসঙ্গে খেলেছেন। ধাম্মিকা একজন পেস বোলার ছিলেন। যদিও তাঁর ক্যারিয়ার ভাইয়ের মতো কিংবদন্তিতুল্য হয়নি, কিন্তু একই দলে অধিনায়ক ভাই এবং খেলোয়াড় ভাইয়ের উপস্থিতি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে এক দারুণ অধ্যায়।
চতুরাঙ্গা ডি সিলভা ও ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা: শ্রীলঙ্কার স্পিন জাদুকর জুটি
শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম পরিচিত ভাইদের জুটি হলেন চতুরাঙ্গা ডি সিলভা ও ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা। বড় ভাই চতুরাঙ্গা বাঁহাতি স্পিনার ও ব্যাটসম্যান। ছোট ভাই ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা বর্তমান সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনার এবং বিধ্বংসী লোয়ার-অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। দুজনেই শ্রীলঙ্কার হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেও তাঁদের একসঙ্গে খেলতে দেখা যায়। হাসারাঙ্গা এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে তারকা হিসেবে পরিচিতি পেলেও, চতুরাঙ্গাও ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের ছাপ রেখেছেন।
তামিম ও নাফিস ইকবাল: বাংলাদেশের গর্ব
বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ওপেনার তামিম ইকবালের বড় ভাই নাফিস ইকবালও একজন ওপেনার ছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেট একসঙ্গে খেললেও একসঙ্গে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয়নি তাঁদের। তোমরা হয়তো অনেকেই নাফিস ইকবালকে সরাসরি খেলতে দেখোনি। তিনি এখন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ম্যানেজার। নাফিস ইকবালের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার খুব বেশি দীর্ঘ না হলেও তিনি তাঁর সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ওপেনার ছিলেন। ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। একটি টেস্ট সেঞ্চুরি এবং দুটি ফিফটি রয়েছে তাঁর।
ছোট ভাই তামিম পরে নিজেকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি ১৫ হাজারের বেশি রান করেছেন। একটি নির্দিষ্ট মাঠে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি রানের মালিক তামিম ইকবাল। মজার ব্যাপার হলো, এই তালিকায় প্রথম তিনজনই বাংলাদেশি। বাকি দুজন মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসান। তাঁরা সবাই শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন।