ইউরোপের বাইরে কেন হবে ইউরোপিয়ান ম্যাচ?
লিগ ম্যাচের নিয়ম কী? যেকোনো খেলাপ্রেমী দর্শকই এক নাগাড়ে বলে দিতে পারবেন সেটা। লিগ মানেই প্রতিটি দল মুখোমুখি হবে দুইবার। একবার নিজেদের মাটিতে, একবার প্রতিপক্ষের মাটিতে। খেলার ভাষায় এর অবশ্য একটা ভারিক্কি নাম আছে। রাউন্ড-রবিন লিগ। অর্থাৎ এক রাউন্ড নিজেদের মাটিতে, পরের রাউন্ড প্রতিপক্ষের মাটিতে। কিন্তু এই মৌসুমে এসে ইউরোপিয়ান লিগের চিত্র বদলে যাচ্ছে। রাউন্ড রবিন লিগ আর থাকছে না। প্রথমবারের মতো ইউরোপের বাইরে চলে যাচ্ছে ইউরোপিয়ান লিগের ম্যাচ। আর সেটা শুরু করছে লা লিগা আর সিরি আ।
স্প্যানিশ আর ইতালিয়ান লিগ অনেকদিন ধরেই এ নিয়ে আলোচনা করছিল। তাদের নিজেদের লিগের অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। প্রিমিয়ার লিগের সামনে তাদের মাথা তুলে দাঁড়ানোই দায়। বিশ্বের প্রতিটি কোনায় যেভাবে প্রিমিয়ার লিগের সমর্থক আছে, দর্শক আছে। সে তুলনায় তারা অনেকটাই পিছিয়ে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী? দুই লিগের কর্তৃপক্ষের মাথায় এসেছে উদ্ভট এক বুদ্ধি–লিগের খেলা বাইরে নিয়ে যাও।
গত বছর থেকেই এ নিয়ে কথা চলছিল। তবে উয়েফা পর্যন্ত কথা এগোয়নি। তবে গতকাল উয়েফাও ‘কোনো উপায় না পেয়ে’ সম্মত হয়েছে। লিগের ম্যাচ বাইরে খেলানোর জন্য অনুমতি দিয়েছে তারা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো লিগের ম্যাচ শুধু দেশের বাইরে নয়। একেবারে মহাদেশের বাইরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পরীক্ষামূলকভাবে এই দুই ম্যাচ হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অস্ট্রেলিয়ায়। এই ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে বার্সেলোনা মুখোমুখি হবে ভিয়ারিয়ালের, অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে কোমোর মুখোমুখি হবে এসি মিলান।
আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যেই। কারণ এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না কেউ। কারণ বেশ কয়েকটা। এক এক করেই ধরা যাক।
নিজেদের মাঠে খেলতে না পারা
মৌসুমে মাত্র একটা ম্যাচ দেশের মাটি থেকে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ নিরপেক্ষ একটি মাঠে, নিজেদের দর্শকদের ছাড়া খেলতে হবে তাদের। ভিয়ারিয়ালের কথাই ভেবে দেখ, ইস্তাদি দে লা সেরামিকাকে ধরা হয় লিগের সবচেয়ে ভয়ানক ফিকশ্চার। ভিয়ারিয়ালের ‘হলুদ সাবমেরিন’- এর মুখোমুখি হতে বাঘা বাঘা দলগুলোও ভয় পায়। তাদের মূল লক্ষ্যই থাকে ঘরের মাটিকে দূর্গ বানিয়ে যতটা সম্ভব পয়েন্ট টেবিলের ওপরে থাকা যায়। সেখানে তাদের কাছ থেকে একটি ম্যাচ তো কেড়ে নিচ্ছেনই। উল্টো প্রতিপক্ষ পাচ্ছে সুবিধা। তাদেরকে প্রতিপক্ষের মাটিতে নয়, একটি ম্যাচ খেলতে হবে নিরপেক্ষ মাঠে। ফলে লিগের প্রতিটি দল সমান সুযোগ যেমন হারাচ্ছে, তেমনই একটি দল বিশেষ সুবিধা আর আরেকটি অন্যায়ের শিকারও হচ্ছে।
একই ঘটনা এসি মিলান এবং কোমোর বেলাতেও। নতুন নতুন সিরি আ-তে আসা কোমো নিজেদের মাটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ মিস করবে এই উদ্ভট ফিকশ্চারের জন্য। তাদের জন্যও ক্ষতিই বয়ে আনছে এই ম্যাচ।
অতিরিক্ত ভ্রমণ
অনেকেই বলেন, ম্যাচের আগে পরে জার্নি করে যে পরিমাণ ক্লান্ত হন খেলোয়াড়েরা, পুরো ম্যাচ খেলেও ততটুকু ক্লান্ত অনেকে হন না। কথাটা অনেকাংশেই সত্য। যত লম্বা ফ্লাইট, তত বেশি ক্লান্তি। আর লিগের মাঝখানে এমন লম্বা সফর করে ম্যাচ খেলানো দুই দলের জন্যই সমস্যা। দীর্ঘ যাত্রা শেষে যেমন ম্যাচ খেলতে হবে, আবার সেই ম্যাচ খেলে উড়ে এসে পরের ম্যাচের প্রস্তুতিও নিতে হবে। স্পেন থেকে আমেরিকা যেতে সময় লাগে প্রায় ১২ ঘন্টা। আর ইতালি থেকে অস্ট্রেলিয়া যেতে লাগে প্রায় ২০ ঘন্টা। এই লম্বা ভ্রমণ শেষে খেলতে যাওয়া খেলোয়াড়দের শুধু ক্লান্তই করবে। আর বেশি কিছু নয়।
এছাড়াও ঘরের মাঠে নিজেদের খেলা দেখতে না পারা। ম্যাচকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত আয়োজনে খেলোয়াড়দের মনোযোগ নষ্ট হওয়া। বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াসহ হাজারো সমস্যা জুড়ে আছে এক ম্যাচকে কেন্দ্র করে। শুরুতে নিজেদের ‘লিগ কাপ’(স্পেনের ‘সুপারকোপা দে ইস্পানা’ ও ইতালির ‘সুপারকোপা ইতালিয়া’) সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে দেশের বাইরে। দুটোই এখন অনুষ্ঠিত হয় সৌদি আরবে। এখন আবার লিগ ম্যাচ নিয়েও টানাটানি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই ম্যাচগুলো কাগজে কলমে নিরপেক্ষ মাঠে খেলা হবে। ম্যাচের দিন দেখা যাবে বড় দলগুলোর সমর্থকে মাঠে তিল ধারণের জায়গা থাকবে না। ঘুরে ফিরে ম্যাচগুলো বড় দলগুলোর পক্ষেই যাবে।
প্রশ্ন করতে পারো, খেলোয়াড়দের সমস্যা, লিগের সমস্যা। তাহলে এই ম্যাচ আয়োজনের কারণটা কী? আর দলগুলো রাজিও বা হবে কেন? কারণ টাকা। এক ম্যাচ খেলার জন্য যে পরিমাণ টিভি সত্ত্ব, টিকিট আর রাইটস বিক্রি করবে দুই লিগ। তার অনেকটাই যাবে দুই দলের পকেটে। এমনকি লিগগুলোও হবে লাভবান।
স্প্যানিশ ও ইতালিয়ান লিগ এই বুদ্ধি ধার নিয়েছে এনবিএ থেকে। প্রায় ৪০ বছর ধরে এনবিএ প্যারিস, লন্ডন, বার্লিনের মতো শহরে ম্যাচ খেলে আসছে। নিজেদের ফ্যানবেজ আর জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য। সেই সঙ্গে বিশাল অঙ্কের টাকাও আয় হচ্ছে। সেভাবেই ফুটবলকে ‘বিকশিত’ করতে চাচ্ছেন তারা। কিন্তু দুই খেলার মধ্যে যে পার্থক্য, শিডিউল থেকে শুরু করে শক্তিমত্তায় — তা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন হর্তাকর্তারা। নইলে কী আর এমন সিদ্ধান্ত আসে?