এ যেন এক বদলে যাওয়া গ্রিলিশ

ম্যাচের শেষ বাঁশি বেজে গেছে। এভারটনের গ্যালারিতে এক ছোট্ট বাচ্চাকে দেখে এগিয়ে গেলেন গ্রিলিশ, নিজের জার্সিটা উপহার দিতে। গ্রিলিশ গেলেন বটে, কিন্তু ফিরতে পারলেন না। উৎসুক দর্শক আর ভক্তরা যেন তাঁকে যেতে দিতে নারাজ। এমন ভালোবাসা দেখে কিছুটা যেন লজ্জাতেই পড়ে গেলেন গ্রিলিশ। এমন ভালোবাসা তাঁর কাছে নতুন নয়, কিন্তু বহুদিনের হারানো। এভারটনে গিয়ে যেন সেই পুরোনো ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছেন জ্যাক গ্রিলিশ, পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে আবার মিলেছেন এক সুরে। ইংল্যান্ডের প্লে–মেকার জ্যাক গ্রিলিশ ফিরেছেন ফুটবলে।

দরজায় কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ। আর বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দলবদলের মৌসুম হয়ে ওঠে চাঙ্গা। সামনে বাকি মাত্র এক বছর। বিশ্বকাপ দলেই যদি জায়গা পাওয়া না যায়, তবে এত দিন ফুটবল খেলে আর কী লাভ? যে কারণে বিশ্বকাপের আগের বছর অনেক দলবদলই হয় বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়া নিয়ে। গ্রিলিশের দলবদলও ছিল সে রকমই একটা দলবদল। ম্যানচেস্টার সিটিতে গ্রিলিশ ছিলেন রাজার হালে। তাঁর ওপর ছিল না প্রতি সপ্তাহে খেলার চাপ, গার্দিওলার ফরমেশনে তাঁর কাজটাও ছিল অল্প। যেটুকু দরকার, সেটুকু মেনে চললেই শিরোপা চলে আসত হাতে। সিটির গ্রিলিশ যেন উচ্ছন্নে যাওয়া এক তারকা, যাঁকে মাঠ থেকে মাঠের বাইরেই পাওয়া যেত বেশি। চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর তাঁর নিয়ন্ত্রণহীন উল্লাস চোখে লেগে আছে এখনো অনেকের।

আরও পড়ুন
সিটিতে শিরোপা জিতেছেন বৈকি, কিন্তু হারিয়েছেন নিজেকে।
ছবি: এক্স

অথচ অ্যাস্টন ভিলার গ্রিলিশ তেমন ছিলেন না। অ্যাস্টন ভিলায় গ্রিলিশ ছিলেন জনমানুষের নেতা, রীতিমতো ‘কাল্ট হিরো’। মাত্র ছয় বছর বয়সে ভিলায় আগমন তাঁর। বেড়ে উঠেছেন তাঁদের সঙ্গেই। নিজের ঘরের ছেলে যখন একের পর এক রেকর্ড গড়ে, তখন দেখতেই যেন ভালো লাগে। ভিলায় পেয়েছিলেন অধিনায়কত্ব, চ্যাম্পিয়নশিপে ঘুরপাক খাওয়া দলটাকে টেনে এনেছিলেন প্রিমিয়ার লিগে। ‘কাল্ট হিরো’তো আর এমনি এমনি হননি।

২০২১ সালে যখন তাঁর জন্য ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের অফার আসে, তখন আর না করার অবস্থা ছিল না ভিলার। গ্রিলিশও রাজি হয়ে যান। ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার যাচ্ছেন ইংল্যান্ডের বর্তমান সময়ের সেরা ক্লাবে, সেরা কোচের অধীন। গ্রিলিশকে নিয়ে আশা ছিল পুরো ফুটবলপ্রেমীদের। সেই আশায় গুঁড়েবালি দিয়েছেন গ্রিলিশ নিজেই। হয় চোট, নইলে অফ ফর্ম, নইলে যেটুকু দরকার, ঠিক সেটুকুই খেলা— সব মিলিয়ে গ্রিলিশকে দেখে চেনার উপায় ছিল না। গ্রিলিশ হয়ে উঠেছিলেন পেপ গার্দিওলার ‘সিস্টেম’ খেলোয়াড়।

আরও পড়ুন

গার্দিওলার সিটিতে যেন একটু একটু করে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলেন। আর তার প্রভাব পড়েছিল ইংল্যান্ড জাতীয় দলে। নতুন কোচ থমাস টুখেল এসে সাফ জানিয়ে দিলেন, হয় নিজের খেলার উন্নতি করো, নইলে থ্রি লায়নসের জার্সিতে তোমার জায়গা হচ্ছে না। তৎক্ষণাৎ যেন মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল গ্রিলিশের। এক বছর পরই তো বিশ্বকাপ, এখন দলে নিয়মিত জায়গা না হওয়ার অর্থ বিশ্বকাপ দল অনিশ্চিত। মিটিংয়ে বসলেন গার্দিওলার সঙ্গে, বুঝলেন নিয়মিত মিনিট পাওয়া কিংবা স্বাধীনভাবে খেলা, কোনোটাই সিটিতে থেকে সম্ভব নয়। তাহলে কারা দিতে পারবে স্বাধীনতা? এগিয়ে এল এভারটন। আর ভাবনা নয়, এক মৌসুমের জন্য ধারে যোগ দিলেন এভারটনে। বেছে নিলেন ১৮ নম্বর জার্সি, ওয়েইন রুনি আর পল গ্যাসকোইন দুজনেই এভারটনে খেলেছেন এই জার্সি পরে।

এভারটনের নতুন ‘হিরো’ গ্রিলিশ।
ছবি: এক্স

এভারটনের গ্রিলিশ যেন ওপর থেকে নেমে আসা এক স্বর্গদূত। তিন মৌসুম ধরে যে বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছেন গ্রিলিশ, তা যেন মুহূর্তেই উবে গিয়েছে। এভারটনের মাঝমাঠে তাকালেই দেখা মিলে ‘১৮’ নম্বর জার্সির। প্রিমিয়ার লিগে তিন ম্যাচের দুটিতে ছিলেন প্রথম একাদশে। আর দুটিতেই পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন গ্রিলিশ। দুই ম্যাচে এভারটন গোল করেছে পাঁচটি, এর মধ্যে চারটি অ্যাসিস্টই এসেছে তাঁর পা থেকে। অথচ সিটির জার্সিতে গত দুই মৌসুমে তাঁর পা থেকে অ্যাসিস্ট এসেছিল মাত্র ২টি! সেটাও ৪০ ম্যাচ খেলে। সিটিতে থাকতে মাত্র এক মৌসুমে এর থেকে বেশি অ্যাসিস্ট করেছিলেন গ্রিলিশ, সেটাও ২০২২-২৩ মৌসুমে সর্বোচ্চ ৭টি। সেটি বাদ দিলে গ্রিলিশ এত দিন সিটিতে ছিল পাদপ্রদীপের আলোর নিচে।

আরও পড়ুন

এভারটন গ্রিলিশের জীবনে নতুন আশার আলো। গ্রিলিশ নিজেও সেটা মেনে নিয়েছেন এক বাক্যে। ‘ফুটবলকে যেন নতুন করে উপভোগ করছি এখানে এসে।’ কোচ ডেভিড ময়েসও স্বীকার করে নিয়েছেন, ‘এতটা ভালো খেলতে দেখবেন গ্রিলিশকে, ভাবেননি তিনি। গ্রিলিশকে নিয়ে আমি একটা কথাই বলতে পারি। আমি যতটা ভালো ভেবেছিলাম, তার থেকেও অনেক গুণ ভালো খেলোয়াড় সে।’

কোচ ডেভিড ময়েসের আশ্বাসেই এভারটনে এসেছেন গ্রিলিশ।
ছবি: এক্স

শুধু ডেভিড ময়েস নন, ফুটবলপ্রেমীরাও ভুলতে বসেছিলেন, জ্যাক গ্রিলিশ আসলে কোন ধরনের খেলোয়াড়। মাঝমাঠকে বন্দী করে একের পর এক বল বানিয়ে দেওয়া, হুটহাট ডিফেন্ডারদের বোকা বানিয়ে বক্সে ঢুকে পড়া কিংবা দূরপাল্লার শটে গোল, ২৯ বছর বয়সে এসে গ্রিলিশ নিজেকে আবিষ্কার করছেন আরেকবার।

আরও পড়ুন