নিখোঁজ সময়ের অজানা আততায়ী
সময়ভ্রমণ কিংবা প্রচলিত কথায় যাকে বলে টাইম-ট্রাভেল; তোমাদের কি কখনো মনে হয়েছে, এমন কিছু আবিষ্কৃত হলে মন্দ হতো না? আমি বহুবার এটা নিয়ে ভেবেছি। দু-একটা গল্পও লিখেছি এ বিষয়ে। মাঝেমধ্যেই মনে হয়, আহা, যদি এমন একটা সময়ে গিয়ে থাকতে পারতাম, যেখানে পরীক্ষা নামের বিচ্ছিরি জিনিসটা আবিষ্কৃত হয়নি, কী ভালোই না হতো!
তবে জীবনের সুদীর্ঘকাল আমি অতীতে গিয়ে বিশেষ কিছু বদলে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলাম না। আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, অতীতে কিছু বদলে দিলে আজকের দিনের যে আমি থাকবে, সেটা আর সেই আমি হবে না; যে অতীত বদলাতে পাড়ি দিয়েছিল সময়ের পথে। কারণ, অতীতের প্রতিটি ঘটনা আর সিদ্ধান্তের সমষ্টিই তো আজকের আমি, আজকের তুমি। কিন্তু বয়স বাড়ে, সময় বদলায়, পাল্টায় জীবনের উপলব্ধি। আজ হয়তো কিছু কিছু জিনিস একটু বদলে দিতে আগ্রহ বোধ করি। বর্তমানের আমিটাকে আর অতটা জরুরি ও অনিবার্য বলে মনে হয় না।
যদিও আজ যে অ্যানিমে নিয়ে কথা তোমাদের জানাতে চলেছি, তার কাহিনিতে অতীত বদলের গুরুত্ব নিছক আত্মকেন্দ্রিক নয়; বরং এ চেষ্টা হয় অন্যের জীবন বাঁচানোর জন্য, রহস্য সমাধানের উদ্দেশ্যে। আজ অ্যানিমে–কথনের চোখ থাকবে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চলা জনপ্রিয় অ্যানিমে বোকু দাকে গা ইনাই মাচি বা ইরেজড–এর (ERASED) ওপর।
এ গল্প সাতোরু ফুজিনুমার। উনত্রিশ বছর বয়সী এক ব্যর্থ মাঙ্গাকা সে। জীবন চালাতে তাকে কাজ নিতে হয়েছে এক পিৎজাশপে। কাজটা বিশেষ কিছু কঠিন নয়, দোকানের বাইক চালিয়ে তাজা পিৎজা পৌঁছে দিতে হয় ক্রেতাদের হাতে। দোকানে তার সহকর্মীরা বেশ আন্তরিক। বিশেষ করে ম্যানেজার ও তার জুনিয়র একটি মেয়ে। মেয়েটির নাম আইরি কাতাগিরি; সাতোরু ওকে পছন্দ করলেও বয়সের তফাৎ আর সহজাত সংকোচের কারণে কিছুটা দূরত্ব রাখে, সরাসরি কিছু বলতে পারে না।
একটা বিশেষ ক্ষমতা অবশ্য আছে সাতোরুর, আশপাশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার উপক্রম হলে সময়ে কিছুটা পিছিয়ে যেতে পারে সে। চলে যায় দুর্ঘটনা ঘটার খানিকটা আগের কোনো মুহূর্তে। যদি ওইটুকু সময়ের মধ্যে দুর্ঘটনার লক্ষণগুলো সে আবিষ্কার করতে পারে, তবে দুর্ঘটনা রুখে দেওয়ার একটা চেষ্টা সে করে। যদিও এই ক্ষমতা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারে না সাতোরু, সময়ের এই ভ্রমণ ঘটে প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত নিয়মে।
এমনই একদিন পিৎজা ডেলিভারির সময় সাতোরু লক্ষ করে, একটা বড় মালবাহী গাড়ি বেসামাল হয়ে চাপা দিতে চলেছে পথে থাকা এক শিশুকে। আচমকা পিছিয়ে যায় সময়। সাতোরু ফিরে আসে শিশুটিকে বাঁচাতে। গাড়ির অচেতন ড্রাইভারকে জাগাতে না পেরে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে কোনোমতে গাড়িটাকে সরিয়ে ফেলে পথ থেকে। ছেলেটি বেঁচে গেলেও আহত হয় সাতোরু, জ্ঞান হারায়।
আঘাত গুরুতর না হওয়ায় অচিরেই ঘরে ফিরে যায় সাতোরু। দেখে, সেখানে তার মা আগে থেকেই উপস্থিত। আহত ছেলের যত্ন নিতে কিছুদিনের জন্য কাজ ফেলে এখানে চলে এসেছে ভদ্রমহিলা। মায়ের সঙ্গে থাকতে কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করলেও মনে মনে খুশিই হয় সাতোরু। পরদিন দুজন বাজারে যায় রান্নাবান্নার জন্য টুকিটাকি কেনাকাটা করতে। সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে সাতোরু লক্ষ করে যে সময় আবার পিছিয়ে গেছে। সুতরাং, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। নিজে থেকে ঘটনার সূত্রগুলো ধরতে না পেরে মাকে বলে, অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লে জানাতে। ভদ্রমহিলা এদিক–ওদিক খুঁজে এক সন্দেহজনক লোককে দেখতে পায় এবং ধারণা করে যে একটা শিশুকে অপহরণ করতে চাইছিল লোকটা। কিন্তু, ওদের নজর থাকায় শেষ পর্যন্ত আর পেরে ওঠেনি।
নিজেদের মধ্যে এসব সন্দেহের কথা নিয়ে আলাপ না হলেও সাতোরু আর ওর মায়ের মনে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে আটকে থাকে এই ছোট্ট ঘটনা। সাতোরুর মনে পড়ে যায় ১৮ বছর আগের এক দুর্ঘটনার কথা। সে সময় ওদের শহরে কিছু ছেলেমেয়ে খুন হয়েছিল এক আততায়ীর হাতে। ওদের বাঁচাতে না পারার আক্ষেপ সেই ছোটবেলায় বড় পীড়া দিয়েছিল ওকে। তা ছাড়া যে ছেলেটা খুনি হিসেবে ধরা পড়ে শাস্তি পেয়েছিল, তাকে ঠিক খুনি বরে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি সাতোরু। পত্রিকার পাতায় পুরোনো সেই ঘটনায় আবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে। মনে পড়ে বিগত স্মৃতির কিছু কিছু।
ওদিকে সাতোরুর মা সাচিকো ফুজিনুমাও ভাবতে থাকে সেই অতীত ঘটনার কথা। ছেলের স্মৃতি থেকে সে সময়ের বিষাদটুকু ম্লান করতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু সাচিকোর অনুসন্ধানী মনে এত দিন পরও রয়ে গেছে প্রশ্ন। বাজার প্রাঙ্গণে সন্দেহজন লোকটাকে দেখে সে ভাবতে থাকে অবচেতনে। কয়েকটা সূত্র জুড়ে একটু মাথা খাটাতেই সে বুঝতে পারে যে অতীতের সেই আততায়ী আসলে কে ছিল। দীর্ঘদিন মনে আটকে থাকা প্রশ্নটার সমাধান হয়ে যেতেই মনে মনে সন্তুষ্ট হয় সাচিকো। বাড়ি ফিরে ছেলের জন্য রান্নার প্রস্তুতি নেবে, এমন সময় পেছন থেকে তাকে ছুরিবিদ্ধ করে অজানা আততায়ী। ছেলেকে কিছুই জানিয়ে যেতে পারে না তার মা, ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।
বাড়িতে ফিরে মায়ের লাশ দেখে ঘাবড়ে যায় সাতোরু। আচমকা এক প্রতিবেশী এসে ওকে লাশের সঙ্গে দেখে ভুল বোঝে, পুলিশে খবর দেয়। ছুটে আসে পুলিশ বাহিনী। মায়ের খুনের আসামি হিসেবে তাদের সন্দেহ হয় সাতোরুকে। তারা ওকে ধরার চেষ্টা করতেই ছুটে পালায় সাতোরু। হঠাৎ সময় পিছিয়ে যায়। সাতোরু নিজেকে আবিষ্কার করে ১৮ বছর অতীতে। ওর সহপাঠী কায়ো হিনাজুকি খুন হওয়ার ঠিক কয়েক দিন আগে। এর আগে কখনো সময়ের পথে এত দূর পাড়ি দেয়নি ও। এতকাল বহন করা চাপা হতাশা আর আক্ষেপ চালিত করে ওকে। দৃঢ়প্রত্যয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সাতোরু, যে করেই হোক বাঁচাতে হবে কায়োকে। বদলে দিতে হবে অতীত ইতিহাস। হয়তো তাহলেই রক্ষা পাবে আরও কিছু জীবন। কিন্তু, অজানা খুনি রয়েছে মুখোশের আড়ালে; খুনের পদ্ধতিও জানা নেই সাতোরুর। ঠিক কবে মেয়েটাকে খুন করা হয়েছিল, তা–ও ভুলে গেছে। আর সবকিছু জেনে ফেলতে পারলেও দিন শেষে ও শুধুই একটা শিশু, অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া কিছু্ই করার স্বাধীনতা যার নেই। এত প্রতিকূলতার বিপরীতে গিয়ে সাতোরু কি পারবে এই রহস্যের সমাধান করতে? জানতে হলে দেখতে হবে বোকু দাকে গা ইনাই মাচি।
একটু ব্যতিক্রম কাহিনি আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করে। ঠিক এ কারণেই দেখেছিলাম অ্যানিমেটা। যতদূর মনে পড়ে, ২০১৬ সালেই দেখা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে হতাশ করেনি, তাই এত দিন পরও ঠিক মনে করে বলতে চলে এসেছি তোমাদের কাছে। কেই সানবের লেখা এই গল্প ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয় কাদোকাওয়া শোতেন পরিচালিত মাসিক ‘ইয়ং এইস’ ম্যাগাজিনে। পরবর্তীকালে ইয়েন প্রেস প্রকাশনী থেকে ভলিউম আকারে ছাপা হয় বোকু দাকে গা ইনাই মাচি। এরই ধারাবাহিকতায় অ্যানিমে, তারপর তৈরি হয় চলচ্চিত্র। এ ছাড়া জনপ্রিয় মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স একটি লাইভ-অ্যাকশন সিরিজও এনেছে এই কাহিনির ওপর। সুতরাং, পাঠক-দর্শকপ্রিয়তার আঙ্গিকে বিচার করলে সিরিজটিকে সার্বিকভাবে সফল বলা যায়।
তোমাদের মধ্যে যাদের রহস্য গল্প পছন্দ, তাদের ভালো লাগবে বোকু দাকে গা ইনাই মাচি। রহস্য কাহিনিতে সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক চরিত্রদের দেখা যায় ব্যতিব্যস্ত হতে, কিন্তু এখানে তোমরা দেখতে পাবে যে ঘটনাটা অধিকাংশ সময় ছোট ছেলেমেয়েদের ঘিরেই চলেছে। গল্পের নায়ক সাতোরু নীরবে সবাইকে সাহায্য করার পথ খুঁজে চলে। কারও সঙ্গে সে ভাগাভাগি করে নিতে পারে না মূল সত্য। কারণ, এমন অভিনব সত্য কারও পক্ষেই বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। যে বয়সে তারা সুপারহিরো নিয়ে আড্ডা দিতেই বেশি পছন্দ করে, ড্রাগনকোয়েস্ট খেলে সময় কাটায়, সেই বয়সে ওদেরই এক বন্ধু সময়ের পথ পাড়ি দিয়ে অতীতে চলে এসেছে, তা মানবেই বা কেন? কিন্তু, তা বলে তো থেমে থাকা যাবে না। প্রাথমিকভাবে কায়ো হিনাজুকিকে বাঁচাতে সাতোরুর প্রয়াস আমাকে আবেগতাড়িত করেছে।
ছোট্ট বয়সের ছোট্ট প্রেমের গল্প ভেসে উঠবে তোমাদের সামনে। নিজের নিজের সমস্যা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা ছোট্ট মানুষ ওরা, কিন্তু সে বিপদ বহু জটিল। ভীষণ বিষাদেও মুখ বুজে চলতে থাকা সেই জীবনে যদি বন্ধুত্বের সুবাতাস বয়, তবে কেমন অনুভূতি হয়? তার উত্তর তোমরা পাবে সাতোরু আর কায়োর সম্পর্কের সমীকরণে। গল্পে সহায়ক চরিত্র হিসেবে রয়েছে সাতোরুর মা। আছে কয়েকজন সহপাঠী বন্ধু, যাদের মধ্যে কেনইয়া কোবায়াশি বিশেষ। এ ছাড়া সাতোরুর স্কুলের শিক্ষক, রেস্তোরাঁর সহকর্মী প্রমুখের আনাগোনা গল্পে বিশেষ স্থান দখল করেছে।
তোমরা যারা একটু চালাক–চতুর, তারা হয়তো মূল আততায়ীর পরিচয় আগেই অনুমান করতে পারবে। তবে তাতে অ্যানিমের আবেদন কিছুমাত্র ম্লান হবে না। রহস্য গল্পে যেমন অপরাধ কে করেছে তা জরুরি, ঠিক তেমনই কীভাবে বা কেন করেছে, তা–ও জরুরি। হত্যাকারীর চরিত্র ও পুরো রহস্যের ব্যাখ্যা শেষ পর্ব পর্যন্ত ধরে রাখবে আগ্রহ।
অ্যানিমের শব্দের প্রয়োগ আমার মন্দ লাগেনি। বিশেষ করে অ্যানিমের পর্বগুলোর সমাপ্তিতে ব্যবহৃত, জাপানিজ গায়িকা সাইউরির কণ্ঠে ‘সোরে ওয়া চিইসানা হিকারি নো ইউনা’ গানটা আমার দারুণ লেগেছে। সাধারণত অ্যানিমের পর্ব দেখার সময় আমি গানটুকু না শুনে পরের পর্বে চলে যাই, এই গানের ক্ষেত্রে পারিনি। বারবার শুনেছি। এমনকি পরবর্তী সময়ে শিল্পীর আরও কিছু গান শুনে দেখেছি, দারুণ লেগেছে। তোমরাও শুনতে পারো।
এ পর্যন্ত যা কিছু বলেছি, তাতে আশা করি, বোকু দাকে গা ইনাই মাচি সম্পর্কে তোমরা সামান্য হলেও আগ্রহী হয়েছ। সিরিজের জাপানিজ নামটিকে বাংলায় রূপান্তর করলে দাঁড়ায়, ‘যে শহরে নেই আমি’। নামকরণ সার্থক হয়েছে কি না, তা বিচারের দায়িত্ব আমি তোমাদের ওপর ছেড়ে দিলাম। গল্পের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন ও বিভ্রান্তির ভিড় থেকে যেসব আনন্দের মুহূর্ত তোমরা খুঁজে পাবে, তা হয়তো তোমাদের সঙ্গে থেকে যাবে দুর্লভ মণিমাণিক্যের মতো। কিছু কিছু গল্প থাকে যা অনেকবার পড়া যায়, দেখা যায়; এটাও তেমনই এক কাহিনি।