ওরা তিনজন, তিন বন্ধু। থাকে সেই আমেরিকায়, রকি বিচ নামের ছোট্ট, শান্ত, ছিমছাম এক শহরে। সান্তা মনিকা পবর্তমালা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এ শহর। রাজ্যের পুরোনো মালের জঞ্জাল নিয়ে এ শহরেই গড়ে উঠেছে পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড। দুই ভাই জাহেদ আর রাশেদ পাশা এ জঞ্জালের আড়তটা গড়ার সময় নাম দিয়েছিলেন ‘পাশা বাতিল মালের আড়ত’। কিন্তু ইংরেজি অক্ষরে এই বাংলা সাইনবোর্ডটা কেউই ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারত না। তাই রেগেমেগে শেষতক নামই পাল্টে ফেলা হয়।
এ স্যালভিজ ইয়ার্ডের জঞ্জালের নিচেই চাপা পড়ে আছে এক পুরোনো মোবাইল হোম। প্রায় ৩০ ফুট লম্বা একটা ক্যারাভ্যান। সেই মোবাইল হোমের ভেতরেই ওই তিনজন গড়ে তুলেছে গোপন এক আস্তানা। যেটাকে তারা ডাকে হেডকোয়ার্টার। কী নেই সেখানে? জলজ্যান্ত ছাপার যন্ত্র থেকে শুরু করে সর্বদর্শন নামের এক পেরিস্কোপ আর আস্ত এক ডার্করুমও আছে সেখানে। নিজেদের তদন্ত রিপোর্ট সংরক্ষণে আছে আলাদা জায়গা। গোয়েন্দাপ্রধানের জন্য সুইভেল চেয়ারসহ তিনজনের বসার জন্য আলাদা জায়গা তো আছেই, সঙ্গে আছে একটা টেলিফোনও। অতি গোপন এই হেডকোয়ার্টারে ঢোকার জন্য তারা নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছে আলাদা আলাদা গোপন পথ। সেগুলোর নামও বিচিত্র। সবুজ ফটক এক, দুই সুড়ঙ্গ, সহজ তিন কিংবা লাল কুকুর চার। এ নামগুলো শুনে কার সাধ্যি এগুলোর আসল অর্থ বোঝার! এতক্ষণ যে তিনজনের কথা বলছিলাম, তারাই সেই বিখ্যাত তিন কিশোর গোয়েন্দা। কিশোর পাশা, মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড। কিশোর মনে অসম্ভব ভালো লাগার সেই তিনটি নাম। একত্রে যারা পরিচিত কোথাও তিন গোয়েন্দা নামে, কোথাও ‘গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন’ নামে।
এ দেশে তিন গোয়েন্দাকে চেনে না এমন কিশোর খুঁজতে রীতিমতো কোনো গোয়েন্দাকেই ভাড়া করতে হবে। ঝাঁকড়া চুলো কিশোর, ‘খাইছে’ মুসা আর বইপোকা রবিন এ দেশের লাখো কিশোরের স্বপ্নের নায়ক। তিন গোয়েন্দার মতো হতে চাওয়া ছেলেমেয়ের অভাব নেই এ দেশে। ওদের দেখাদেখি অনেকেই খুলে বসে গোয়েন্দা বাহিনী, দুই গোয়েন্দা, তিন গোয়েন্দা, চার গোয়েন্দা। এমনকি দল ভারী হওয়ায় কেউ কেউ তো আট বা নয় গোয়েন্দাও খুলে বসে! তিন গোয়েন্দা পড়ে রোমাঞ্চের নেশায় কত ছেলেমেয়ে মা-বাবাকে না জানিয়ে কত শত অভিযান চালিয়ে বসে, তার খোঁজই বা কে রাখে। ক্লাসে বইয়ের নিচে লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়তে গিয়ে ধরা পড়ে স্যারের হাতে রামধোলাই খায় কত ছেলেমেয়ে। আবার বাসায় লুকিয়ে পড়তে গিয়ে ধরা খেয়ে শাস্তি পেতে হয় অনেককে। আর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রাস্তাঘাটে অপরিচিত মানুষকে অপরাধী মনে হওয়া, ম্যাচের কাঠি, পোড়া সিগারেটের টুকরো, পায়ের ছাপ বা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো দেখে সেটাকে রহস্য সমাধানের সূত্র মনে হয় তিন গোয়েন্দাপড়ুয়াদের। কিংবা ময়লা পুরোনো কাগজ দেখে সেটাকে গুপ্তধনের সংকেতও ভেবে বসে অনেকে।
তিন দুঃসাহসীর সঙ্গে ইচ্ছে হলেই বইয়ের বাইরে থেকেই দূর আকাশে পাড়ি দেয় পাঠক। কিংবা নিমেষেই জলদসু্যুর হারানো মোহর খুঁজতে সাগরের অতলে নেমে পড়া যায়। চোর-ডাকাতকে নাকানি-চুবানি খাওয়াতেও ওদের সঙ্গী হওয়া যায়। অজানা ভীষণ অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া কিংবা মরুভূমির গরমে সেদ্ধ হতে হতে পরক্ষণে সুদূর বরফরাজ্যে ছুটে যায় পাঠক। ধাঁধার জাল কেটে লুকানো গুপ্তধন উদ্ধার করাতেও ভাগ বসানো যায় ওদের সঙ্গেই। এত কাণ্ডকারখানার সঙ্গী হয়ে সবারই একসময় মনে হয়, রকি বিচের তিন গোয়েন্দার অস্তিত্ব আসলেই আছে পৃথিবীতে! কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্ন, তিন গোয়েন্দা কি সত্যিই আছে? সে-ও এক বিরাট রহস্য! তবে এ রহস্য সমাধান করতে তোমাকে আর নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে কিশোর পাশা হতে হবে না। তার চেয়ে রহস্যটা ভেঙেই দিই।
গেল শতাব্দীর ষাটের দশকে কুয়াশা নামের এক কিশোর উপযোগী সিরিজের আবির্ভাব হয়। ১৯৬৪ সালের জুনে জন্ম নেওয়া এ সিরিজটি লিখতেন মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন ওরফে কাজীদা। ৭০টির বেশি বই প্রকাশিত হওয়ার পর হুট করে বন্ধ হয়ে যায় সিরিজটি। ওই সময় সেবাতে কিশোরদের জন্য এই একটিই সিরিজ ছিল। সেটিও বন্ধ হওয়ায় কিশোর উপযোগী সিরিজের অভাব দেখা দিল সেবা প্রকাশনীতে। ঠিক এ সময় রকিব হাসান সেবার স্বত্বাধিকারী কাজীদাকে প্রস্তাব দেন কিশোরদের জন্য একটি গোয়েন্দা সিরিজ লেখার। হাসিমুখেই রাজি হন কাজীদা। তাতেই ঘটে বাংলার কিশোর সাহিত্যের সবচেয়ে বড় বিপ্লব। ১৯৮৫ সালের আগস্টে ‘তিন গোয়েন্দা’ শিরোনাম দিয়ে তিন গোয়েন্দা সিরিজের পথচলা শুরু।
কিশোর-মুসা-রবিন নামের তিন দুঃসাহসী কিশোরের রোমহর্ষক কাহিনি সবার এত ভালো লাগবে, তা কেউই কল্পনাই করেনি। মুগ্ধ পাঠকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার চিঠিতে উপচে গেল সেবা প্রকাশনীর ডাকবাক্স। সে এক এলাহি কাণ্ড! এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি সিরিজটিকে। একে একে বের হতে লাগল তিন গোয়েন্দার অসাধারণ সব বই। ২০০৩ সাল পর্যন্ত একে একে ১৫৮টি তিন গোয়েন্দা লিখে ফেললেন রকিব হাসান। এর ফাঁকে ফাঁকে তিন গোয়েন্দা কিশোর-মুসা-রবিনকে নিয়ে ‘তিন বন্ধু’ নামে আরেকটি সিরিজ লিখে ফেললেন রকিব হাসান, সেবা প্রকাশনীর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান প্রজাপতি প্রকাশন থেকে হোয়াইট প্রিন্টে ছাপা হয়েছে এই সিরিজের বইগুলো। এখন পর্যন্ত এ সিরিজের মোট ৩৮টি বই বেরিয়েছে। নাম ‘তিন বন্ধু’ হলেও এগুলোও আসলে তিন গোয়েন্দাই। যে কারণে পরবর্তীকালে এই সিরিজের বইগুলোও সেবার তিন গোয়েন্দা ভলিউমে স্থান পেয়েছে।
একটানা অনেক বছর সেবায় তিন গোয়েন্দা লেখার পর অর্থনৈতিক কারণে রকিব হাসান ২০০২ সালের দিকে বাংলাবাজারের বিভিন্ন প্রকাশনী, পত্রপত্রিকা আর নাটক লেখায় ব্যস্ত হয়ে গিয়ে নিয়মিত আর তিন গোয়েন্দা লিখতে পারছিলেন না। সেবা প্রকাশনীও এমন জনপ্রিয় একটি সিরিজ মেরে ফেলতে চাইল না, প্রথমে রকিব হাসানকে গোস্ট রাইটারের সাহায্যে লেখা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করল। রকিব হাসান প্রথমে রাজি হয়েও পরে আর গোস্ট রাইটার দিয়ে লেখাতে আগ্রহ বোধ না করায় তিন গোয়েন্দা চালু রাখার দায়িত্ব দেওয়া হলো শামসুদ্দীন নওয়াবকে। অবশ্য শামসুদ্দীন নওয়াব কাজীদারই ছদ্মনাম। এ নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন গোস্ট রাইটার লিখতে লাগলেন সিরিজটিতে। সেখানে মূল লেখক হিসেবে থাকলেন কাজী শাহনূর হোসেন। তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হতে থাকল সিরিজটি। বলে রাখা ভালো, যেসব লেখক নিজের নাম ব্যবহার না করে অন্যের নামে বই প্রকাশে চুক্তিবদ্ধ হন, তাঁরাই গোস্ট রাইটার। বিশ্বের অনেক জনপ্রিয় সিরিজে গোস্ট রাইটাররা লেখেন।
এদিকে সেবায় তিন গোয়েন্দা ছাড়ার কিছুদিন পর তিন গোয়েন্দার ভক্তদের চাপে রকিব হাসান আবার কিশোর-মুসা-রবিনকে নিয়ে লিখতে বাধ্য হলেন। তবে এবার আর এককভাবে শুধু সেবার তিন গোয়েন্দায় নয়, সেবায় ‘তিন গোয়েন্দা’সহ বাংলাবাজারের বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে ‘কিশোর মুসা রবিনের সিরিজ’, ‘গোয়েন্দা কাহিনি: কিশোর মুসা রবিন’, ‘গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন’ শিরোনামেও তিন গোয়েন্দার কাহিনি চালিয়ে যেতে থাকলেন।
এখন, চলো আগের গল্পে ফিরে যাই। রকিব হাসান তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা তা তো সবাই জানো। কিন্তু এই তিন কিশোরকে তিনি কোথায় পেলেন? সেটার পেছনেও আছে দারুণ গল্প। রকিব হাসান মূলত এক বিদেশি সিরিজের কাহিনির ওপর ভিত্তি করে বাংলায় তিন গোয়েন্দা লিখেছিলেন। এ বিষয়টি তিনি কিংবা সেবা প্রকাশনী কখনো কোনো লুকোছাপা করেনি। সত্যি বলতে কি, প্রতি মাসে সম্পূর্ণ মৌলিক কাহিনি লিখে এ রকম জনপ্রিয় কোনো সিরিজের পাঠকদের চাহিদা মেটানোর সাধ্য কোনো লেখকেরই নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ তিনজনকে নিয়ে বিস্তর বই লেখা হয়েছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা আর মাধুর্যতার দিক দিয়ে সম্ভবত রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে লেখা বলে কোনোভাবেই রকিব হাসানকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। ভিনদেশি কাহিনিকে দেশের অগুনতি পাঠকের মনের শ্রেষ্ঠ খোরাক করে দেওয়া নিশ্চয়ই যেনতেন কাজ নয়। রকিব হাসানের কৃতিত্বটা ঠিক এখানেই।
যাহোক, আচ্ছা জুপিটার জোনসের নাম শুনেছ? শোনোনি, তাই তো? পিটার ক্রেনশোকে চেনো? কিংবা বব এন্ড্রিউসকে? এসব বিটকেলে নাম শুনে নিশ্চয় নিচের ঠোঁটে আঙুল চলে গেছে অনেকের। ভাবছ, এরা আবার কারা? ওদের পরিচয় দেওয়ার আগে একবার রবার্ট আর্থার জুনিয়রের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। রবার্ট আর্থার জুনিয়র জন্মেছিলেন ১৯০৯ সালের ১০ নভেম্বর, ফিলিপাইনে। ১৯২৬ সালে হাইস্কুল ম্যাগাজিনে জীবনের প্রথম দুটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল আর্থার সাহেবের। এরপর বিভিন্ন ম্যাগাজিনে অসংখ্য গল্প প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর। এসব গল্পের বিষয় ছিল অপরাধ, গোয়েন্দা, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, যুদ্ধ, ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃতিক। গল্প লিখে কিছুটা পরিচিতি পাওয়ার পর ১৯৪০ সালের দিকে রেডিও ক্রাইম ড্রামা লিখতে শুরু করেন তিনি, যার নাম দ্য মিস্টেরিয়াস ট্রাভেলার। যুক্তরাষ্ট্রে দারুণ জনপ্রিয় অনুষ্ঠানটি চলেছিল ১৯৫৩ পর্যন্ত। এসব করতে করতেই হঠাৎকিশোর উপযোগী একটা সিরিজ লেখার কথা ভাবলেন তিনি। যেটা পড়ে পাঠক মুগ্ধ হবেন, হবেন রোমাঞ্চিত। সে সময় হার্ডি বয়েজ সিরিজটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। তখন পর্যন্ত প্রকাশিত ওই সিরিজের প্রায় ৫০টি বইয়ের প্রতিটিই বছরে কমপক্ষে ৩৫ হাজার কপি করে বিক্রি হতো। রবার্ট আর্থারের লক্ষ্য ছিল হার্ডি বয়েজের থেকেও জনপ্রিয় কোনো সিরিজ লেখা, যেটা নিদেনপক্ষে ২৫ বছর চলবে। আসলে এ সিরিজটি চালিয়ে টাকা কামাতে চেয়েছিলেন তিনি। যাতে বুড়ো বয়সে কোনো অভাব না থাকে।
ষাটের দশকে টিনএজারদের জন্য সলভ-দেম-ইয়োরসেলফ নামের এক পাজলের প্রতিযোগিতা হতো যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে পাঁচটি ধাঁধা থাকত। সেই প্রতিযোগিতা থেকেই রবার্ট আর্থার পেলেন তাঁর স্বপ্নের সিরিজটি লেখার আইডিয়া। একসময় তিনি লিখেও ফেললেন সিরিজের প্রথম বইটি। সেটার নাম দিলেন থ্রি ইনভেস্টিগেটরস অ্যান্ড দ্য সিক্রেট অব টেরর ক্যাসল। নামটা কি চেনা চেনা ঠেকছে? বইটির কাটতি বাড়াতে কাহিনিতে চরিত্র হিসেবে তিনি বিশ্বের সর্বকালের সেরা পরিচালকদের অন্যতম আলফ্রেড হিচকককে রেখেছিলেন। এমনকি বইয়ের প্রচ্ছদেও জুড়ে দিয়েছিলেন হিচককের নামও। আর্থারের মতে, হিচককের নাম দেখলে মানুষ অনেক বেশি আকর্ষিত হবে। এমনিতেই রহস্যপ্রিয় মানুষ ছিলেন হিচকক। তা ছাড়া আর্থারের বইয়ের কাহিনিতে মুগ্ধ হয়ে তিনি থ্রি ইনভেস্টিগেটরসের সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে দিতে আপত্তি করলেন না। তাতে বইয়ের নাম দাঁড়াল আলফ্রেড হিচকক অ্যান্ড দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস: দ্য সিক্রেট অব টেরর ক্যাসল। আর সিরিজটির নাম হয়ে গেল ‘আলফ্রেড হিচকক অ্যান্ড দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’। অবশ্য নাম ব্যবহারের জন্য হিচকককে বই বিক্রির রিয়েলটি থেকে কিছু অর্থও দিতে হতো। র্যান্ডম হাউস থেকে প্রকাশিত হতে লাগল বইটি। তারপরই যেন মৌচাকে ঢিল পড়ল। বইটি কিশোরদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলল। পাঠকের সঙ্গে পরিচয় হলো তিন কিশোর গোয়েন্দা জুপিটার জোনস, পিটার ক্রেনশো আর বব এন্ড্রিউসের। সিরিজের প্রথম বইটি এত জনপ্রিয় হবে, সেটি বোধ হয় খোদ লেখকও কল্পনা করেননি।
এ সিরিজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আশির দশকে রকিব হাসান লিখেছিলেন এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দা। থ্রি ইনভেস্টিগেটরসের জুপিটার জোনস বা জুপকে ঘষেমেজে অনেকটা বদলিয়ে তিনি বানালেন গোয়েন্দাপ্রধান কিশোর পাশাকে। মূল সিরিজের জুপ দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়াত গভীর রহস্য নিয়ে ভাবার সময়। সেই মুদ্রাদোষটি আছে আমাদের কিশোর পাশারও। বাদামিচুলো মার্কিন কিশোর পিটার ক্রেনশোকে একটু অদলবদল করে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ কালোচুলো মুসা আমানকে বানানোতেও ভালো মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন রকিব হাসান! আর আইরিশ মার্কিন রবিন মিলফোর্ড এসেছে থ্রি ইনভেস্টিগেটরসের রবার্ট বব এন্ড্রিউস থেকে। এই তিনজনই রকি বিচ নামের শহরেরই বাসিন্দা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হলিউডের আশপাশে রকি বিচ নামের কোনো শহরের অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। ওই তিনজনের মতো এটাও কাল্পনিক!
থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজের প্রথম বই আলফ্রেড হিচকক অ্যান্ড দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস: দ্য সিক্রেট অব টেরর ক্যাসল প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪-তে। এর কাহিনি থেকেই তিন গোয়েন্দা সিরিজের জন্মবই তিন গোয়েন্দা লিখেছিলেন রকিব হাসান। একসময়ের বিখ্যাত অভিনেতা জন ফিলবির ভৌতিক বাড়ির রহস্যভেদের সেই অসাধারণ কাহিনি তো তোমাদের জানা। মূল বইতে টেরর ক্যাসলের ওই জন ফিলবি চরিত্রের নাম ছিল স্টিফেন টেরিল! চলচ্চিত্র পরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারের জন্য ভৌতিক বাড়ি খুঁজতে গিয়ে কী কাণ্ডটাই না করেছিল তিন গোয়েন্দা। সিরিজের এই ডেভিড ক্রিস্টোফার চরিত্রটি হিচককের আদলে বানানো। প্রথম দিকের বইগুলোতে তিন গোয়েন্দাকে তিনিই কেস জোগাড় করে দিতেন।
মূল সিরিজের বই ছিল ৪৩টি। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত এ সিরিজের সব বই কিন্তু রবার্ট আর্থার লেখেননি। তিনি লিখেছিলেন সিরিজের প্রথম ১০টি বই। তিন গোয়েন্দা, কঙ্কাল দ্বীপ, রুপালি মাকড়সা, মমি, রক্তচক্ষু, কাকাতুয়া রহস্য, ঘড়ির গোলমাল বইগুলো মূলত রবার্ট আর্থারের বইয়ের কাহিনি থেকেই ধার করেছিলেন রকিব হাসান। ১৯৬৯ সালে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান রবার্ট আর্থার। ওই বছরেই থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজে তাঁর লেখা শেষ বই দ্য মিস্ট্রি অব দ্য টকিং স্কাল বেরিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতেও থেমে যায়নি ভীষণ জনপ্রিয় থ্রি ইনভেস্টিগেটরসের অসাধারণ অভিযানের কাহিনি। এরপর প্রায় ১৮ বছর চলেছিল সিরিজটি। ডেনিস লিন্ডস নামের এক লেখক ১৯৬৮ থেকে টানা ২০ বছর সিরিজের ১৩টি বই লিখেছিলেন।
এম ভি ক্যারি বা ম্যারি ভার্জিনিয়া ক্যারি সিরিজের ১৫টি বই লেখেন ১৯৭১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত সিরিজের শেষ বই দ্য মিস্ট্রি অব দ্য ক্রাংকি কালেকটর লিখেছিলেন এমভি ক্যারি। সিন্দবাদ অ্যান্ড মি লিখে এডগার এওয়ার্ডপ্রাপ্ত ছোটদের প্রিয় লেখক কিন প্যাট লেখেন সিরিজের দুটি বই। ১৪তম বই দ্য মিস্ট্রি অব কফিং ড্রাগন (১৯৭০) এবং ১৬তম বই দ্য মিস্ট্রি অব দ্য নার্ভাস লায়ন (১৯৭১) বই দুটি তিনি লিখেছিলেন নিক ওয়েস্ট ছদ্মনামে। সিরিজের বাদবাকি তিনটি লিখেছিলেন সুলেখক মার্ক ব্র্যান্ডল। ১৯৮৯ সালে র্যান্ডম হাউস ‘দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস: ক্রাইম বাস্টার্স’ নাম দিয়ে সিরিজটি আবার প্রকাশ করতে শুরু করে। ১১টি বই প্রকাশের পর রবার্ট আর্থারের পরিবারের সঙ্গে প্রকাশনীর কিছু আইনি জটিলতায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সিরিজটি। এদিকে থ্রি ইনভেস্টিগেটরস বইয়ের প্রচ্ছদ অলংকরণ করতেন হ্যারি কেইন। এ ছাড়া এড ভ্যাবেল, জ্যাক হার্ন, হার্ব মট, স্টিফেন মার্কেসের মতো ডাকসাইটে আঁকিয়েরা সিরিজের প্রচ্ছদ ও অলংকরণে মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন।
এ তো গেল থ্রি ইনভেস্টিগেটরসের কেচ্ছা। তিন গোয়েন্দার কাহিনি কি শুধু থ্রি ইনভেস্টিগেটরস থেকেই এসেছিল? উঁহু! এ সিরিজটি ছাড়াও বিশ্বের আরও অনেক জনপ্রিয় সিরিজ বা বই থেকে এসেছে তিন গোয়েন্দার মসলাপাতি। সে জন্যই তিন গোয়েন্দার স্বাদে এত ভিন্নতা। লেখক যেসব বিদেশি বই থেকে তিন গোয়েন্দা লিখেছেন সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ফাইভ অন আ ট্রেজার আইল্যান্ড বইয়ের মাধ্যমে জুলিয়ান, ডিক, অ্যান, জর্জিনা আর টিমি তথা বিশ্বখ্যাত সিরিজ ফেমাস ফাইভ-এর আবির্ভাব ঘটে। জনপ্রিয় ব্রিটিশ লেখিকা এনিড ব্লাইটনের হাতে ১৯৪২ সালে জন্ম হয় শিশু-কিশোর উপযোগী চমত্কার এ সিরিজটির। ১৯৪২ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ফেমাস ফাইভ সিরিজের ২১টি বই প্রকাশিত হয়েছিল। এই ফেমাস ফাইভের জর্জিনা জর্জ কিরিন থেকেই তিন গোয়েন্দার জিনা এসেছে। আর তার কুকুর রাফিয়ানকে ধার করা হয়েছে জর্জিনার কুকুর টিমির চরিত্র থেকে। ‘ফেমাস ফাইভ’ সিরিজ থেকে রকিব হাসান তিন গোয়েন্দা লেখার সময় ফেমাস ফাইভের জর্জিনা কিরিনের চাচাতো ভাইবোন তথা দুই ভাই জুলিয়ান, ডিক আর তাদের বোন অ্যানকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিন গোয়েন্দার কিশোর, মুসা আর রবিনে পরিবর্তন করেন। জিনার সেই গোবেল আইল্যান্ডের কথা তো তোমরা জানোই। ফেমাস ফাইভের কিরিন আইল্যান্ড থেকেই গোবেল আইল্যান্ডের উদ্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত ফ্রাঙ্কলিন ডবিউ ডিকসন লিখতে শুরু করেছিলেন জনপ্রিয় শিশু-কিশোর সিরিজ ‘দ্য হার্ডি বয়েজ মিস্ট্রি স্টোরিস’। তিন গোয়েন্দার অনেক বইয়ের কাহিনি এসেছে এই হার্ডি বয়েজের কাহিনি থেকেই। এই সিরিজের প্রধান চরিত্র দুই ভাই ফ্রাঙ্ক হার্ডি আর জো হার্ডি। জাফর চৌধুরী ছদ্মনামে রকিব হাসান দুই ভাই রেজা আর সুজাকে নিয়ে ‘রোমহর্ষক’ নামের আরেক সিরিজ লিখতেন, যেটা ওই ‘হার্ডি বয়েজ সিরিজ থেকেই। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন জোনসের ‘বিগলস’ সিরিজ থেকে এসেছে মিসরীয় বংশোদ্ভূত বৈমানিক ওমর শরীফের কাহিনিগুলো। আবার উইলার্ড প্রাইসের অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ অবলম্বনে ভীষণ অরণ্যর মতো বেশ কিছু বই লেখা হয়েছে।
শামসুদ্দীন নওয়াব যখন সিরিজের হাল ধরেন, তখন তিন গোয়েন্দাতে এনিড ব্লাইটনের ‘ফারাওয়ে ট্রিজ’ এবং ক্রিস্টোফার পাইকের ‘স্পুকসভিল’ সিরিজও ঢুকে পড়ে। রকিব হাসানের ‘তিন বন্ধু’ সিরিজে স্পুকসভিল প্রথম এসেছে। স্পুকসভিল একটা ভুতুড়ে শহরের নাম। রকিব হাসান তার কাহিনিতে এর নাম রেখেছেন ‘ডেথ সিটি’। তিন গোয়েন্দা সিরিজে ডেথ সিটির সমস্ত কাহিনিই (একটা বাদে) রকিব হাসানের লেখা। আর এল স্টাইনের ‘গুজবাম্প’ সিরিজের বইও ঢুকেছে শামসুদ্দীন নওয়াবের সিরিজে। বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে কাজী শাহনূর হোসেনের লেখা নীল-ছোটমামা সিরিজটির কাহিনিও তিন গোয়েন্দাতে রূপান্তরিত হয়েছে। আবার বিদেশি কাহিনি অবলম্বনেই টিপু কিবরিয়ার লেখা হরর ক্লাব সিরিজের কিছু বইও তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর করা হয়েছে। রূপান্তরিত হয়েছে রকিব হাসানের ছদ্মনাম ‘আবু সাঈদ’ ও ‘জাফর চৌধুরি’ ছদ্মনামে লেখা ‘গোয়েন্দা রাজু’ ও ‘রোমহর্ষক’ সিরিজের বইগুলো। এ বইগুলোর ক্ষেত্রে রকিব হাসান আবারও ছদ্মনামের আশ্রয় নিলেন। শামসুদ্দীন নওয়াবের নামে বইগুলো রূপান্তর করলেন তিনি। রকিব হাসানের মতোই হার্ডি বয়েজসহ আরও কয়েকটি বিদিশ সিরিজ থেকে কাহিনি নিয়েছেন শামসুদ্দীন নওয়াব। তিন গোয়েন্দা এভাবে বিশ্বের বিস্তর বই আর সিরিজ থেকে কাহিনি ধার করে লেখা। তাই সিরিজটি পড়ে সহজেই বিশ্বের নাম না জানা অসংখ্য বইয়ের কাহিনি পড়ে ফেলা যায়। এটা অনেক ভালো একটা দিক। বিশ্বের অনেক দেশের শিশু-কিশোরেরাই এ সুযোগ পায় না। সেদিক দিয়ে তোমরা অনেক ভাগ্যবান।
তিন গোয়েন্দার একেকটি কাহিনি টিনএজারদের কাছে অমূল্য অমৃত! কী নেই তিন গোয়েন্দায়? রোমহর্ষক অভিযান, মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া বুদ্ধির প্যাঁচ, অবাক করা সব অজানা তথ্য, কত শত দেশের কত শত জায়গা, বিচিত্র সব মানুষ আর বিস্তর ভালো লাগার উপকরণ। তিন গোয়েন্দার অপূর্ব জগতে একবার ঢুকলে ঘরে বসেই পাওয়া যায় দূর দেশ, দ্বীপ, সাগর, বন, পাহাড় আর বহুদূরের আকাশ পাড়ি দেওয়ার আশ্চর্য সব উপকরণ। রহস্যের মারপ্যাঁচে মস্তিষ্ক ঝালিয়ে নেওয়া যায় সহজেই। ভূগোল, প্রকৃতি কিংবা বিজ্ঞানের অনেক অজানা জ্ঞানও তোমার নাকের ডগায় এসে খাবি খায় এই তিন গোয়েন্দার বদৌলতেই!
তোমরা তো জানোই তিন গোয়েন্দা আসলে কী করে, তাদের কাজ কী। তারপরও চলো তাদের দু-একটা গল্প শুঁকেটুকে দেখি তাদের গল্প আসলে কী রকম ঝাঁজের! তিন গোয়েন্দার বই দিয়ে তিন গোয়েন্দার গল্প লেখা শুরু করেছিলেন রকিব হাসান। কিশোর-মুসা-রবিন নামের রকি বিচের তিন কিশোর এক গোয়েন্দা বাহিনী বানিয়ে ফেলল হুট করে। নাম তিন গোয়েন্দা। কিন্তু গোয়েন্দাগিরির জন্য তো রহস্য প্রয়োজন। তা ছাড়া এ কাজে পরিচিতিও চাই। তবেই না মক্কেল আসবে নানা পদের রহস্য নিয়ে। কিন্তু রহস্য তো আর ক্লাসের হোমওয়ার্ক নয় যে, না চাইতেই ঘাড়ের ওপর চেপে বসবে। তবে উপায়?
উপায়ও ঠিক ঠিক বেরিয়ে গেল কিশোর পাশার ক্ষুরধার মগজ থেকে। বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার ভূতের সিনেমা বানাবেন। তার জন্য ভুতুড়ে বাড়ি দরকার। তিন গোয়েন্দা বাগিয়ে নিল ভুতুড়ে বাড়ি খোঁজার কাজ। বিনিময়ে ক্রিস্টোফার তিন গোয়েন্দার নাম চারদিকে ছড়িয়ে দিতেও সাহায্য করবেন। খুঁজে পেতে হলিউডের পাশেই ‘টেরর ক্যাসল’ নামের এক ভুতুড়ে বাড়ির সন্ধান পেল তিন গোয়েন্দা। নির্বাক যুগের অভিনেতা জন ফিলবি বাড়িটির মালিক ছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। তবে মরার আগে নোট লিখে যান, তার প্রেতাত্মা বাড়িটাকে পাহারা দেবে আর কেউ এ বাড়িতে বাস করতে পারবে না। এরপর টেরর ক্যাসলে কেউই এক রাতও কাটাতে পারেনি। কিন্তু তিন গোয়েন্দা ভূতের তাড়া খেয়েও নাছোড়বান্দার মতো বারবার গেল টেরর ক্যাসেলে। শেষমেশ হার মানল টেরর ক্যাসলের ভূত। বেরিয়ে এল এক রোমহর্ষক সত্য। সেই সত্যটা কী সেটা জানতে অবশ্যই পড়তে হবে বইটা।
তিন গোয়েন্দা কি শুধু রকি বিচেই গোয়েন্দাগিরি করে? মোটেই না। তাদের পদচারণ সাগরের অতল থেকে ভিনগ্রহ পর্যন্ত! তদন্ত আর অভিযানের প্রয়োজনে তারা চষে বেড়ায় নানা দেশ। ‘ভীষণ অরণ্য’ বইতে ভয়ংকর আমাজনে আর ‘পোচার’ গল্পে আফ্রিকার জঙ্গলে যেতে হয়েছে তাদের। তেমনি অথৈ সাগর-এর মতো অনেক বইয়ে সাগর আর দ্বীপ চষে বেড়াতে হয়েছে তাদের। এই যেমন ‘জলদস্যুর দ্বীপ’ পড়লে ওদের সঙ্গে যেতে পারবে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। তিন শ বছর আগে সাগরের ত্রাস জলদস্যু লুই ডেকেইনির মৃত্যু হলো এক অভিশপ্ত ডাবলুনের (স্প্যানিশ স্বর্ণমুদ্রা) অভিশাপে। ঘটনাচক্রে বব কলিনসের সঙ্গে দেখা কিশোর আর মুসার। তার বরাতেই তিন শ বছর পর তিন গোয়েন্দার হাতে পড়ল সেই অভিশপ্ত ডাবলুনটা।
তারপরই তিন গোয়েন্দার কপালে নামল একের পর এক দুর্ভোগ। ববের বাবার শেষ চিঠিতে ওরা জানতে পারল, প্রশান্ত মহাসাগরের এক দ্বীপে লুকানো আছে জলদস্যুদের ধনরত্ন। সেই গুপ্তধন খুঁজতে সেই দ্বীপে বব কলিনস আর বৈমানিক ওমর শরিফকে নিয়ে হানা দিল কিশোর-মুসা। নানা বিপদ সত্ত্বেও একসময় কিশোরেরা সন্ধান পেল সেই গুপ্তধন। কিন্তু পিছু ছাড়ল না ডাবলুনের অভিশাপ। ডাকাত বিগ হ্যামার আর তার দলবল বাধা হয়ে দাঁড়াল ওদের পথে। নিরস্ত্র গোয়েন্দাদের কাছ থেকে মোহর ছিনিয়ে নিতে উঠেপড়ে লাগল তারা। তারপর?
শুধু জঙ্গল আর সাগরই নয়, বরফরাজ্য অ্যান্টার্কটিকায় আর সাহারা মরুভূমিতেও গেছে তারা। এমনকি পৃথিবীর বাইরেও যেতে হয়েছে তাদের! কিশোর পাশার বাড়ি বাংলাদেশে; সেই সুবাদে তিন গোয়েন্দা এসেছে বাংলাদেশেও। শুধু বেড়িয়ে নয়, রহস্যেরও সমাধান করে গেছে তারা। ‘ঢাকায় তিন গোয়েন্দা’, ‘অপারেশন কক্সবাজার’, ‘বাংলাদেশে তিন গোয়েন্দা’, ‘জয়দেবপুরে তিন গোয়েন্দা’ তারই নমুনা।
কিশোর-মুসা-রবিনদের পরিচিত হওয়ার গল্পটাও বেশ মজার। ‘ঝামেলা’ বইয়ে আছে সেই গল্প। ওরা তিনজনই তখন ছোট। মুসা আর রবিন থাকে গ্রিন হিলসে। সেই শহরেই এক বাড়ি রহস্যজনকভাবে পুড়ে গেল। সেই বাড়ি দেখতে গিয়েই ওদের সঙ্গে পরিচয় হয় কিশোর পাশার। এরপর পুড়ে যাওয়া বাড়ির রহস্য উদ্ঘাটন করল তারা। ধরা পড়ল কালপ্রিট। তারপর কিশোর-মুসা-রবিন বন্ধু হয়ে গেল। গ্রিনহিলস থেকে রকি বিচে ফিরে তারা খুলে বসল ‘তিন গোয়েন্দা’।
তিন গোয়েন্দার গল্পগুলোতে রহস্য ছাড়াও আছে ভুতুড়ে কাণ্ড, ফ্যান্টাসির ভেলকি, হাসির কাণ্ডকারখানাসহ অনেক কিছু। গ্রিনহিলসের পুলিশম্যান ফগর্যাম্পারকটকে নিয়ে কাহিনিগুলো পড়ে হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে। তেমনি ভয়ংকর অসহায়, চাঁদের অসুখ, ভ্যাম্পায়ার দ্বীপ-এর মতো বইগুলো পড়ে গায়ের রোম খাড়া হতে বাধ্য! তিন গোয়েন্দার কিছু বইতে তুমি পাবে নির্জলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির গন্ধ। ফ্যান্টাসি, থ্রিলার কাহিনিও অন্তর্ভুক্ত আছে এ সিরিজে। এগুলো পড়তে গেলে নিজের অজান্তেই গল্পেরই একটা চরিত্র হয়ে যাবে তুমি। আবার তিন গোয়েন্দার চিরশত্রু শুঁটকি টেরি, ফগর্যাম্পারকট হয়ে যাবে তোমারও শত্রু। তেমনি জিনা, ফারিয়া, বব র্যাম্পারকট, টম, বিড কিংবা রাফি-টিটু-কিকোরাও বন্ধু হয়ে যাবে তোমার। তিন গোয়েন্দার মজাটা ঠিক এখানেই!
পাঠ্যবই যখন বিস্বাদ লাগে, তখনই তিন গোয়েন্দার পাতায় পাওয়া যায় একটু স্বস্তির নিশ্বাস। কারণ, এখানেই কল্পনার বল্গা হরিণ ছোটানো যায় ইচ্ছেমতো। তিন গোয়েন্দার পাতায় পাতায় নিমেষেই কেটে যায় সময়। সে জন্যই তিন গোয়েন্দার বই হাতে নিয়ে শিক্ষকের হুমকি, মা-বাবার বকুনি কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া নিমেষে ভুলে যায় সবাই। এ জন্যই তিন গোয়েন্দা সবার এত আপন। তিন যুগ আগে নিয়েছিল তিন গোয়েন্দা। কিন্তু এই তিন যুগ পরও সেই আগের মতোই চিরকিশোর রয়ে গেছে তারা। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে তিন গোয়েন্দার এই টিকে থাকার গল্পও তাদের রহস্য কাহিনির মতোই রোমাঞ্চকর। এই তিন দশকে রকিব হাসানের সৃষ্ট তিন গোয়েন্দার জনপ্রিয়তায় ভাটা তো পড়েইনি, উল্টো এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে কয়েক গুণ।
তাই পাঠক চাহিদা মেটাতে এখন সেবা প্রকাশনী ছাড়াও ‘প্রথমা’ আর ‘কথামেলা প্রকাশনী’ থেকেও রকিব হাসানের রচনায় তিন গোয়েন্দার কাহিনি নিয়ে বই প্রকাশিত হচ্ছে, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। দৈনিক পত্রিকার পাতা, বিভিন্ন ঈদসংখ্যা, মাসিক ম্যাগাজিনও রকিব হাসানের কিশোর-মুসা-রবিনকে নিয়ে লেখা কাহিনি ছাপছে।
যাহোক, কোঁকড়াচুলো-খাইছে-বইপোকা এই তিন কিশোর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে রহস্য-রোমাঞ্চের নেশাতুর সম্মোহনে বেঁধে রাখুক, এটাই সব কিশোরের চাওয়া। থ্রি চিয়ারস ফর তিন গোয়েন্দা, হিপ...হিপ...হুররেএএ..!!!