মঙ্গল অভিযানের জন্য পৃথিবীর আদলে বানানো এক্সপেরিমেন্ট কেন ব্যর্থ হয়েছিল

বায়োস্ফিয়ার ২–এর ভেতর ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আট বিজ্ঞানীছবি: এক্স থেকে নেওয়া
একবার কল্পনা করো তো—একটা বিশাল কাচের ঘর। যার ভেতরে আছে বন, মরুভূমি, সাগর, ছোট ছোট প্রাণী, আর মানুষ! এখানে থাকতে হবে দিনের পর দিন। বাইরে বের হওয়া যাবে না। ভেতরের খাবার, পানি, বাতাস—সবই নিজেদের জোগাড় করতে হবে। কী, রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে তো! ঠিক এমনই এক রোমাঞ্চকর পরীক্ষা হয়েছিল অনেক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা মরুভূমিতে। এই পরীক্ষার নাম বায়োস্ফিয়ার ২। বিশাল এই কাচের ঘরটা বানানো হয়েছিল পৃথিবীর আদলে। পৃথিবীর ক্ষুদ্র সংস্করণ। ভেতরে যেন সবকিছু পৃথিবীর মতোই কাজ করে। এই ঘরের নাম ছিল বায়োস্ফিয়ার ২। কারণ, আমাদের আসল পৃথিবীকে বলা হয় বায়োস্ফিয়ার ১। বিজ্ঞানীরা আসলে এই ঘর বানিয়ে বুঝতে চেয়েছিলেন—পৃথিবীর বাইরে, যেমন মঙ্গল বা চাঁদে মানুষ কি এমন ঘর বানিয়ে থাকতে পারবে?

কৃত্রিম পৃথিবী

১৯৯০–এর দশকের শুরুর দিকে আটজন বিজ্ঞানী পৃথিবীর আদলে কাচঘেরা বায়োস্ফিয়ার ২ নির্মাণ করেন। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা ও আবিষ্কার ভবিষ্যতের মহাকাশ নয় বরং পৃথিবী রক্ষার পাঠ দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার মরুভূমিতে তিন একর জায়গাজুড়ে পৃথিবীর আদলে বায়োস্ফিয়ার ২–এ আছে বিস্তৃত কাচের পিরামিড, গম্বুজ এবং টাওয়ারের বিশাল জটিল গঠনটি ঘিরে আছে এক উষ্ণমণ্ডলীয় বন, যার আছে ২৫ ফুট উঁচু এক জলপ্রপাত। এ ছাড়া আছে সাভানা, কুয়াশাচ্ছন্ন মরুভূমি, ম্যানগ্রোভ ভরা জলাভূমি ও একটি কৃত্রিম মহাসাগর—যেটি একটি অলিম্পিক সাঁতারের পুলের চেয়েও বড় এবং তাতে জীবন্ত প্রবালপ্রাচীরও আছে। উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশে মানুষ বসতি গড়বে—তার আগে পরীক্ষা চালানো।

এই নির্জন প্রান্তর ছিল এক ভবিষ্যৎধর্মী গবেষণার আদর্শ পটভূমি। আটজন মানুষ কাচঘেরা এই বিশাল স্থাপনায় স্বেচ্ছায় নিজেদের দুই বছরের জন্য বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। তাঁরা নিজেরাই ফসল ফলিয়ে খেতেন, নিজেদের বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করতেন এবং অক্সিজেন উৎপাদক গাছের পরিচর্যা করতেন।

আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা মরুভূমিতে পৃথিবীর আদলে বায়োস্ফিয়ার ২
ছবি: অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

তবে মানুষের জীবন টিকিয়ে রাখার দিক থেকে এই পরীক্ষা তেমন সফল হয়নি। ২০২০ সালের তথ্যচিত্র স্পেসশিপ আর্থ–এ এক ভাষ্যকার বলেছিলেন, ‘সেখানে যা যা খারাপ হতে পারত, তার সবই হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ভেতরে অক্সিজেন কমে গিয়েছিল, মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, কার্বন ডাই–অক্সাইড বেড়ে গিয়েছিল। অসংখ্য প্রাণী মারা গিয়েছিল, যার মধ্যে ছিল গাছের পরাগায়নে সহায়ক কীটপতঙ্গও। যদিও ভেতরের বাসিন্দারা নিজেদের চাষ করা খাবার খেয়ে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তাঁরা এতটাই ওজন হারিয়েছিলেন যে পরে তা ক্যালরি সীমাবদ্ধতা নিয়ে গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। একপর্যায়ে তাঁদের বাইরে থেকে অক্সিজেন দিতে হয়। এরপরই এ প্রকল্পকে ‘ব্যর্থ’ বলে নানাভাবে কটাক্ষ করা হয়।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক বিশেষজ্ঞ এ প্রকল্পের গুরুত্ব নতুনভাবে বিবেচনা করছেন—বিশেষ করে পরিবেশবিজ্ঞান, বায়ুমণ্ডলীয় রসায়ন এবং পৃথিবীর অপরিবর্তনীয় মূল্য সম্পর্কে উপলব্ধি।

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞান ইতিহাসবিদ লিসা র৵ান্ড বলেন, এই শিক্ষা এখন আরও প্রাসঙ্গিক। কারণ, একদিকে ধনকুবেররা ব্যক্তিগত মহাকাশ কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছেন, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনসহ মানুষের সৃষ্টি নানা সংকটে পড়ছে পৃথিবী।

এই প্রকল্প এখনো চলছে। বর্তমানে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুতন্ত্র কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, তা বোঝার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। পৃথিবী ছেড়ে পালানোর প্রকল্প না হয়ে বায়োস্ফিয়ার ২ আজ বায়োস্ফিয়ার ১ বোঝার এক শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। লিসা র৵ান্ড বলেন, ‘এটি ব্যর্থতা ছিল না। আমি মনে করি এটি সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল।’

জীবনের জন্য পৃথিবী

বায়োস্ফিয়ার ২ প্রকল্প শুরু হয়েছিল পরিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে—বলছেন বায়োস্ফেরিয়ান মার্ক নেলসন। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা নিউ মেক্সিকোর এক ইকোভিলেজে থাকতেন। সেখানে তাঁরা জৈব চাষ, পারফরম্যান্স আর্ট ও কাঠের কাজ করতেন। এই দলের প্রধান জন অ্যালেন চেয়েছিলেন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র তৈরি করতে, যা দিয়ে পৃথিবীর জটিলতা বোঝা যাবে।

এ প্রকল্পের জন্য তহবিল দিয়েছিলেন ধনকুবের এড বাস, যিনি প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার দেন। আজকের হিসাবে যা প্রায় ৪৪০ মিলিয়ন ডলার। ১৯৮৪ সালে এই স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

বায়োস্ফিয়ার ২-এর বর্তমান উপপরিচালক জন অ্যাডামস বলেন, যদিও এর কোনো বাস্তুতন্ত্রই বাস্তব জগতের মতো নিখুঁত ছিল না। তবু প্রতিটি বাস্তুতন্ত্র একই ধরনের গাছপালা, পোকামাকড়, মাছ ও পাখি থাকার ব্যবস্থাসহ নকশা করা হয়েছিল। ফসল চাষের জন্য কৃষিজমি ছিল। পাইপিং ও পাম্পের একটি ভূগর্ভস্থ ব্যবস্থা তাপমাত্রা থেকে আর্দ্রতা পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। বৃষ্টির পানি আহরণ, পানীয় জল তৈরির ব্যবস্থা ও বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থাও ছিল।

বায়োস্ফেরিয়ান মার্ক নেলসন বলেন, ‘বায়োস্ফিয়ার ২ এক শতাব্দী ধরে কাজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে যখন এখানে ঢোকা হয় তখন মনে হয়েছিল, এটি এত বিশাল পরীক্ষা যে আমাদের আটজনের কেউই নিশ্চিত ছিল না যে আমরা সেখানে দুই বছর এক বা অন্যভাবে টিকে থাকতে পারব।’

আরও পড়ুন

ভেতরে যা হয়েছিল

আছে শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) জলাভূমি
ছবি: বায়োস্ফিয়ার ২–এর ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

বায়োস্ফিয়ার ২–এর ভেতরে প্রথম ও প্রধান সমস্যা ছিল অক্সিজেনের ঘাটতি। ১৬ মাস পর বাতাসে অক্সিজেনের মাত্র ১৪ শতাংশে নেমে আসে। যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ৩৫০ মিটার উচ্চতায় অক্সিজেনের মাত্রার সমান। উচ্চতাজনিত অসুস্থতায় ভেতরের সবাই ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। পরে দেখা যায়, অক্সিজেনের এই ঘাটতির কারণ ছিল নতুন উর্বর মাটি, যা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের অতি বর্ধনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাটির ভেতরে থাকা অদৃশ্য জীবাণুর দল (ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস) অনেক বেশি নিশ্বাস নিচ্ছে! এর মানে তারা অক্সিজেন খাচ্ছে আর অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়ছে। ছোট ও অপর্যাপ্ত পরিমাণ গাছপালা সে ভারসাম্য রাখতে পারেনি।

জন অ্যাডামস বলেন, বায়োস্ফিয়ার ২–এর ভেতরে থাকা আটজন দ্রুত বেড়ে ওঠা গাছ লাগিয়ে, শুকনা ঘাস সংরক্ষণ করে অক্সিজেনের এই ঘাটতি কাটানোর চেষ্টা করেন। এমনকি তাঁরা ঘরের মেঝেতে শৈবাল চাষ করেন, কিন্তু এতে অক্সিজেন বাড়েনি।

শৈবাল মানে জলজ ছোট উদ্ভিদ, যেগুলোও অক্সিজেন দেয়। ভাবো একবার, খাওয়ার জন্য ধান–গম নয়, তাঁরা শুধু জীবন বাঁচাতে অক্সিজেনের জন্য শৈবাল চাষ করেছিলেন!

পতঙ্গরা গেল কোথায়

বায়োস্ফিয়ার ২–এর এই কাচঘেরা ঘরে ছিল একটা কৃত্রিম মহাসাগরও। সেখানে করা হতো প্রবালের চাষ।
ছবি: বায়োস্ফিয়ার ২–এর ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

বায়োস্ফিয়ার ২–এর ভেতরে আরেকটি অদ্ভুত বিপদ ঘটেছিল। ফুল ফুটছে, কিন্তু মৌমাছি বা প্রজাপতি আসছে না। যারা ফুল থেকে ফুলে উড়ে পরাগ ছড়িয়ে দেয়। এ কারণে অনেক গাছে ফলই ধরছিল না।

মার্ক নেলসন বলেন, একদিন তাঁরা বুঝতে পারলেন, ‘লংহর্ন ক্রেজি অ্যান্ট’ নামের একদল লম্বা শুঁড়ওয়ালা পিঁপড়া এই ছোট পতঙ্গগুলোকে ধরে খেয়ে ফেলছে। আর কাচের ঘরের দেয়ালে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি আসছে না, যেটা পোকামাকড়কে ফুল খুঁজে পেতে সাহায্য করে।

নেলসন বলেন, এটা বুঝতে পেরে তাঁরা হাত দিয়ে ফুলে পরাগ ছড়িয়ে দিলেন। এতে কয়েকটি প্রজাতির পরাগায়ন হয়েছিল। পরাগরেণু ফুলে ব্রাশ করেছিলেন, যাতে বীজ তৈরি হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল, পিঁপড়ার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা এবং বাইরের বিশ্ব থেকে নতুন পরাগরেণু প্রবর্তন করা।

আরও পড়ুন

পৃথিবীর বিকল্প নেই

দুই বছর পর যখন বিজ্ঞানীরা বায়োস্ফিয়ার ২ থেকে বাইরে এলেন, অনেকেই বললেন—এই তো ব্যর্থ! কিন্তু আসলে বিজ্ঞানীরা সেখানে শিখেছেন অনেক কিছু। তাঁরা শিখেছেন—পৃথিবীকে বানানো এত জটিল যে সেটাকে পুরোপুরি নকল করা অসম্ভব।

এ প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি হলো, পৃথিবীর কোনো বিকল্প নেই। বায়োস্ফিয়ার ২-এর অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, মানুষ একা নয়, সে একটি পুরো বাস্তুতন্ত্রের অংশ এবং সেই ব্যবস্থা আবার অবিশ্বাস্য রকম জটিল ও ব্যয়বহুল।

বায়োস্ফেরিয়ান ডেভিড টিলম্যান বলেন, যদি বায়োস্ফিয়ার ২–এর মতো কোনো মহাকাশ উপনিবেশ হয়, তবে প্রতি মাসে একজনের খরচ হবে ৮২ হাজার ৫০০ ডলার। তবু এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।

এই অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে বায়োস্ফেরিয়ান মার্ক নেলসন সহকর্মীদের সঙ্গে লাইফ আন্ডার গ্লাস নামের একটি বই লিখেছেন। ওই বইয়ে তিনি বলেছেন, ‘তুমি যখন বুঝতে পারো তোমার জীবন ওই গাছটির ওপর নির্ভর করে—যে গাছটা অক্সিজেন দিচ্ছে, তখন পৃথিবীকে দেখার চোখই বদলে যায়।’

আরও পড়ুন

বায়োস্ফিয়ার ২ পরীক্ষা বিজ্ঞানীদের আরও অনেক কিছু শিখিয়েছে। যেমন গাছপালা আর মাটির ঠিকমতো যত্ন না নিলে বাতাসে অক্সিজেন কমে যেতে পারে; ছোট ছোট পোকামাকড়, যেমন মৌমাছি বা পিঁপড়া প্রকৃতির জন্য খুব দরকারি; গাছ, পানি, আলো, মাটি—সবকিছু মিলে তৈরি করে মানুষের জীবনের ভারসাম্য।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘বায়োস্ফিয়ার ২ আসলে আমাদের শিখিয়েছে পৃথিবীই আমাদের একমাত্র বাসা। তাই এটিকে সবাই মিলে ভালোবাসতে হবে, পরিষ্কার রাখতে হবে আর যত্ন নিতে হবে।’

তাহলে প্রকল্পের কী হলো

১৯৯৩ সালে বায়োস্ফিয়ার ২ থেকে বেরিয়ে আসেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্য দিয়ে পরীক্ষাটি শেষ হয়। এ সময় প্রকল্পটি সমালোচনার মুখে পড়ে। কারণ, এটি সরকারি বা প্রথাগত অ্যাকাডেমিক কাঠামো অনুসরণ করেনি। সরকারের পরিবর্তে এতে একজন ধনী ব্যক্তি অর্থায়ন করেছিলেন। অনেকেই ভাবতেন, এটি কোনো বিজ্ঞান নয়, বরং ‘নাটক’। বায়োস্ফিয়ার ২–এর ভেতর একজন অংশগ্রহণকারী আহত হলে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং পরে অক্সিজেন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়—এই সবকিছুকে ‘প্রতারণা’ বলা হয়েছিল।

বায়োস্ফিয়ার ২-এর বর্তমান উপপরিচালক জন অ্যাডামস বলেন, গণমাধ্যমের নেতিবাচক ধারণা এবং মূল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে বায়োস্ফিয়ার ২ কীভাবে পরিচালনা করা যায়, তা নিয়ে মতবিরোধ—প্রকল্পটির তত্ত্বাবধানকারীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। ১৯৯৬ সালে ধনকুবের এড বাস কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বায়োস্ফিয়ার ২–এর ব্যবস্থাপনা হস্তান্তর করেন। পরে এটি অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়কে উপহার দেন।

ঘরের ভেতর সমুদ্রপাঠ

বায়োস্ফিয়ার ২–এর এই কাচঘেরা ঘরে ছিল একটা কৃত্রিম মহাসাগর। সেখানে করা হতো প্রবালের চাষ। সেখানে বিজ্ঞানীরা দেখলেন, যখন বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়ে, তখন সাগরের পানি অম্লীয় হয়ে যায়। এতে প্রবাল বেড়ে উঠতে পারে না। এটা ছিল বড় এক চমক। কারণ, পৃথিবীর সাগরেও আজ এটাই ঘটছে।

সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী ও ভূবিজ্ঞানী ডায়ান থম্পসন বলেছেন, বিজ্ঞানীরা বন্দী অবস্থায় প্রবালের বিকাশের জন্য কী ধরনের আলো প্রয়োজন, সে সম্পর্কেও অনেক কিছু শিখেছেন।

আরও পড়ুন

বায়োস্ফিয়ার ২ এখন টাইম মেশিন

বর্তমানে বায়োস্ফিয়ার ২ ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিস্থিতি অনুকরণ করে দেখার অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। বনাঞ্চল কীভাবে তাপমাত্রা ও খরার সঙ্গে খাপ খায়, প্রবাল কীভাবে লবণাক্ত সমুদ্রে টিকে থাকে—এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হচ্ছে এখানেই। বায়োস্ফিয়ার ২ এখন আর মহাকাশে যাওয়ার চাবিকাঠি নয়, বরং পৃথিবীর জটিল জীবনব্যবস্থাকে বোঝার এক পরীক্ষাগার।

ইউনিভার্সিটি অব মেইনের বাস্তুবিদ ব্রায়ান ম্যাকগিল বলেন, জীববৈচিত্র্য কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে গবেষণা করা বাস্তুবিদরা সাধারণত তাপপ্রবাহ বা খরার মতো পরিবর্তনের পরে কী ঘটে তা এখানে বিশ্লেষণ করেন। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যতে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে কীভাবে পরিবর্তন করবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য তাদের ভবিষ্যতের পরিস্থিতি আবার তৈরি করতে হবে এবং জীবন্ত প্রাণীরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা দেখতে হবে। এটা এখন একটি টাইম মেশিনের মতো।

বায়োস্ফিয়ার ২-এর রেইনফরেস্ট হলো বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বাস্তব জগতের প্রতিরূপগুলো কীভাবে কাজ করতে পারে তার পরীক্ষা মঞ্চ। একটি গবেষণায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেখা গেছে, বনগুলো আশ্চর্যজনকভাবে তাপের প্রতি সহনশীল; বরং উষ্ণায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত খরা তাদের ক্ষতি করে।

সম্প্রতি জার্মানির ফ্রেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিদ ক্রিশ্চিয়ান ওয়ার্নার ও তাঁর সহকর্মীরা বনটিকে ৭০ দিনের খরার মুখোমুখি করেছেন। তাঁরা শিখেছেন, কীভাবে কিছু গাছ গভীর, আর্দ্র মাটির স্তরে প্রবেশ করে বেঁচে থাকে এবং খরা-চাপযুক্ত গাছগুলো মনোটারপেন নামের আরও যৌগ নির্গত করে, যা বায়ুবাহিত কণা তৈরি করে এবং সম্ভাব্যভাবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বৃষ্টির মেঘ সৃষ্টিতে কাজ করতে পারে।

আমরা সবাই বায়োস্ফেরিয়ান

মার্ক নেলসন বলেছেন, ‘আমরা সবাই বায়োস্ফেরিয়ান। পৃথিবীর যত্ন নেওয়াই আমাদের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান ও নৈতিকতা।’ তিনি বলেন, সবাই মিলে পরিবেশের যত্ন নিলে পৃথিবী আরও সুন্দর থাকবে।

তথ্যসূত্র: বায়োস্ফিয়ার ২ ডট অর্গ, বিবিসি,

দ্য গার্ডিয়ান, দ্য ইকোলজিস্ট

আরও পড়ুন