এলিয়েনের সঙ্গে মানুষের দেখা হয়ে গেলে কী ঘটবে

মহাবিশ্বে আমরা একা কিনা, এই প্রশ্ন মানুষকে হাজার বছর ধরে তাড়িত করছে। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কখনো না কখনো আমরা অনেকেই ভেবেছি, ওই অসংখ্য নক্ষত্রের কোথাও না কোথাও কি আরেকটা পৃথিবী আছে? সেখানে কি কেউ আছে যারা হয়তো আমাদের মতোই এই মুহূর্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে একই প্রশ্ন করছে? এই কৌতূহল থেকেই জন্ম নিয়েছে সার্চ ফর এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সংক্ষেপে একে বলে সেটি বা SETI। মানে ভিনগ্রহী বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজ।

আগে বিজ্ঞানীরা শুধু রেডিও তরঙ্গ শুনতেন। ভাবতেন, হয়তো কোনো এলিয়েন সভ্যতা রেডিও সিগনাল পাঠাচ্ছে। কিন্তু এখন আমরা আরও স্মার্ট হয়ে গেছি। এখন বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণের জন্য তৈরি লেজার রশ্মি। এমনকি নক্ষত্রের চারপাশে তৈরি বিশাল শক্তি সংগ্রহ কাঠামোও খুঁজছেন, যেগুলোকে বলা হয় ডাইসন সোয়ার্ম। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, এলিয়েনদের খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়ছে।

আরও পড়ুন

কিন্তু এখানেই একটা বড় প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। আমরা যদি সত্যিই একদিন ভিনগ্রহী বুদ্ধিমান প্রাণীর সন্ধান পেয়ে যাই, তাহলে কী করব? কীভাবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করব? আমরা কি বন্ধুত্ব করব, নাকি ওদের তাড়িয়ে দেব? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ অ্যাস্ট্রোনটিকস বা আইএএ একটা নতুন প্রোটোকল তৈরি করছে। সহজ ভাষায় বললে, এটা হলো একটা নির্দেশিকা যেখানে লেখা থাকবে বিজ্ঞানীরা এমন আবিষ্কারের পর কী কী পদক্ষেপ নেবেন।

এই নতুন প্রোটোকল সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ২০২৫ সালের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনটিক্যাল কংগ্রেসে ভোটে পাস হয়েছে। আগামী বছরের শুরুতে এটা সম্পূর্ণভাবে গৃহীত হতে পারে। এটা গত ৩৬ বছরে প্রোটোকলের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন।

প্রথমবার আইএএ এই ধরনের নির্দেশিকা তৈরি করেছিল ১৯৮৯ সালে। তখন তারা একটা মূলনীতির ঘোষণা করেছিল। সেখানে লেখা ছিল, কোনো এলিয়েন গ্রহ থেকে সংকেত পেলে মানবজাতির কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। ২০১০ সালে এটা একবার আপডেট করা হয়। কিন্তু সেটা ছিল মূলত ছোটখাটো সংশোধন। আসল কথাগুলো প্রায় একই ছিল।

আরও পড়ুন

কিন্তু এবারের আপডেট একদম আলাদা। কেন? কারণ পৃথিবী গত পনেরো বছরে অনেক জটিল হয়ে গেছে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। একটা খবর ছড়িয়ে পড়তে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগে। ভুয়া খবর, গুজব, আতঙ্ক সব দ্রুত ছড়ায়। তাই নতুন প্রোটোকলে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যে বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কার ঘোষণা করবেন, তাঁরা যেন সুরক্ষিত থাকেন। অনলাইন হয়রানি বা আরও খারাপ কিছু থেকে তাঁদের বাঁচানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

সিডনিতে ভোটে পাস হয়ে যাওয়ার পর এখন শেষ ধাপ বাকি। আইএএ বোর্ড যদি এটা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেয়, তাহলে যে উপকমিটি এটা তৈরি করেছে, তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে উত্তর দেওয়ার বিষয়ে। আগের প্রোটোকলে বলা ছিল, আমাদের উত্তর দেওয়া উচিত এবং এতে তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কিন্তু নতুন প্রোটোকলে বলা হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা কোনোভাবেই উত্তর পাঠাবেন না যতক্ষণ না জাতিসংঘে এই বিষয়ে আলোচনা হয়। এটা যৌক্তিক, তাই না? কারণ এটা শুধু একটা দেশের বিষয় নয়, পুরো মানবজাতির বিষয়। তবে জাতিসংঘকে দিয়ে কোনো কিছুতে একমত করানো যে কতটা কঠিন, তা হয়তো তোমরা আরেকটু বড় হলে বুঝবে। 

আরও পড়ুন

এখানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। এই প্রোটোকল শুধু তখনই কাজ করবে যখন আমরা কারো কাছ থেকে সংকেত পাব। কিন্তু মেসেজিং এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা মেটি (METI) নামে আরেকটা ধারণা আছে। সেটা হলো, আমরা নিজেরা প্রথমে শক্তিশালী সংকেত পাঠাব কাছের নক্ষত্রণ্ডলীতে। এই ব্যাপারটা আরও বিতর্কিত। অনেকেই মনে করেন, এটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু এর জন্য এখনো কোনো সঠিক নিয়মকানুন নেই। শুধু আছে কিছু মতামত। 

নতুন প্রোটোকলে আরও কিছু ব্যবহারিক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেমন, সংকেত পাওয়ার পর সেটা কীভাবে যাচাই করতে হবে। তথ্যগুলো কোথায় কীভাবে রাখতে হবে। বলা হয়েছে, দুটো আলাদা ভৌগোলিক অবস্থানে তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে এবং যত বেশি সম্ভব গবেষক ও সংস্থা যেন সেই তথ্য দেখতে পারে। এমনকি যে সফটওয়্যার দিয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করা হবে, সেটাও সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এতে স্বচ্ছতা বাড়বে আর যাচাই করা সহজ হবে।

যদি সংকেতটা তড়িৎচুম্বকীয় হয়, মানে রেডিও তরঙ্গের মতো কিছু হয়, তাহলে প্রোটোকলে বলা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস ইউনিয়নের কাছে আবেদন করতে হবে। এই সংস্থা পৃথিবীর বেতার যোগাযোগের ফ্রিকোয়েন্সি বণ্টন করে। তাদের কাছে বলতে হবে যেন যে ফ্রিকোয়েন্সিতে সংকেত পাওয়া গেছে, সেটা খালি রাখা হয়। তাহলে মানুষের তৈরি সংকেত সেখানে হস্তক্ষেপ করবে না। যদি কেউ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সেই ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে, তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

আরও পড়ুন

মূল কথা হলো, গত পনেরো বছরে পৃথিবী অনেক পাল্টে গেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ জটিল হয়েছে। আবার ‘সেটি’ আবিষ্কার কেমন হতে পারে, সেই বিষয়েও আমাদের ধারণা বদলে গেছে। কোনো সংস্থাই দাবি করে না যে তাদের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর আছে। তবে আইএএ যেভাবে এই প্রোটোকল আপডেট করার কাজ করছে, সেটা প্রশংসার যোগ্য। গত দুই বছর ধরে তারা একাধিক দফায় সংশোধন এনেছে, বিভিন্ন মানুষের মতামত নিয়েছে।

সিডনিতে ভোটে পাস হয়ে যাওয়ার পর এখন শেষ ধাপ বাকি। আইএএ বোর্ড যদি এটা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেয়, তাহলে যে উপকমিটি এটা তৈরি করেছে, তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। এই কাজটা এখন হয়তো খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না, কিন্তু একদিন এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ভাবো তো, যদি সত্যিই একদিন আমরা কোনো এলিয়েন সভ্যতার সংকেত পাই! সেদিন পুরো মানবজাতির ইতিহাস বদলে যাবে। আমরা জানতে পারব, মহাবিশ্বে আমরা একা নই। তখন কী হবে? আমরা কী বলব তাদের? কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাব? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনই ভেবে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ সেই মুহূর্তে হয়তো ভাবার সময় থাকবে না।

এই প্রোটোকল কোনো আইন নয়, এটা হলো একটা নির্দেশিকা। কাউকে এটা মানতে বাধ্য করা যাবে না। কিন্তু যখন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত আসবে, এই নির্দেশিকা আমাদের একটা পথ দেখাবে। বিশৃঙ্খলার বদলে আমরা একসঙ্গে, দায়িত্বশীলভাবে এগিয়ে যেতে পারব। আর সেটাই তো আমাদের দরকার, তাই না?

সূত্র: ইউনিভার্স টুডে

আরও পড়ুন