স্কলাসটিকা স্কুলে গুপী গাইন বাঘা বাইন
সন্ধ্যা নামতেই চারদিকে নেমে আসে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ঠিক তেমনই এক নিস্তব্ধতার আবহ তৈরি হয়েছে রাজধানীর স্কলাসটিকা মিরপুর ক্যাম্পাসে। বিশাল ভবনের ভেতর গা ছমছম করা পরিবেশ। স্কুল প্রাঙ্গণ মিলনায়তনে অপেক্ষমাণ দর্শকেরা দৃষ্টি স্থির করে রেখেছেন মঞ্চের দিকে। ছায়া-ছায়া আলোয় দেখা যাচ্ছে কালো পোশাকে একদল ভূত! একটু খোঁজ নিয়েই জানা গেল, সেখানে চলছে বিখ্যাত শিশু-কিশোর নাটক গুপী গাইন বাঘা বাইন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কালজয়ী গল্প অবলম্বনে তৈরি এ নাটকে ভূতের সাজে মঞ্চে এসেছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। আলো নিভতেই শুরু হলো বহু প্রতীক্ষিত মঞ্চনাটকটি, আর ভৌতিক সেই আবহে দর্শকদের শরীর শিরশির করে উঠল।
বর্ণিল বার্ষিক আয়োজন
স্কলাসটিকার মিরপুর ক্যাম্পাসে দুই দিনব্যাপী আয়োজিত হয় বার্ষিক নাট্যোৎসব। স্কুলের ড্রামা, মিউজিক ও ড্যান্স ক্লাবের শিক্ষার্থীরা যৌথভাবে মঞ্চস্থ করে গুপী গাইন বাঘা বাইন। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে যে গল্প নতুন প্রাণ পেয়েছিল, সেটিই যেন এই মঞ্চে পুনরায় জীবন্ত হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল পরিবেশনায়।
উৎসবের প্রথম দিনে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার গিয়াস উদ্দিন সেলিম। শিশু-কিশোরদের কাজের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘এমন আয়োজন শুধু অভিনয় শেখায় না, শেখায় দলগত চেতনা ও জীবনবোধ।’ দ্বিতীয় দিনের অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ। তিনি শিক্ষার্থীদের নিবেদন ও কারিগরি দক্ষতার প্রশংসা করে বলেন, ‘পাঠ্যক্রমের বাইরে এমন সাংস্কৃতিক চর্চা শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশে অপরিহার্য।’
অধ্যক্ষ নুরুন নাহার মজুমদার শিক্ষার্থীদের এই ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বলেন, ‘স্কলাসটিকা সব সময় শিখন প্রক্রিয়ায় সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দেয়।’
নাটকের নির্দেশনা দেন ড্রামা ফ্যাকাল্টি সানি ঘোষ। সংগীত পরিচালনা করেন সৈয়দ মেহরাজ কবির, নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও তানজিলা মেঘলা, আর মঞ্চসজ্জায় ছিলেন জাকিয়া খান, রোকসানা সুলতানা ও প্রান্তিকা মণ্ডল। পুরো আয়োজনে ইভেন্টস ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ম্যানেজার জান্নাত হক ও সানোয়ারা জাহান এবং সিনিয়র অফিসার মুহসিনা মাহজাবিনের সমন্বয় ছিল প্রশংসনীয়। সহযোগী হিসেবে যুক্ত ছিল ওরেন্ডা অ্যান্ড বিনস, ক্রোস্টা, চামিচি ও কফি ওয়ার্ল্ড।
সবাইকে নিয়ে এক উৎসব
গল্পের কেন্দ্রে আছে দুজন গ্রামীণ যুবক, গুপী ও বাঘা। গুপী গাইতে ভালোবাসে, কিন্তু তার গলায় সুর নেই। বাঘা ঢোল বাজাতে ভালোবাসে, কিন্তু তার বাজনা বেসুরো। গান-বাজনার এই ব্যর্থতার জন্য তারা গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়, আর তারপরই এক বনে দেখা মেলে ভূতের রাজার সঙ্গে।
এই নাটকে অংশ নেয় ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা শুধু অভিনয় করেনি, তারা মঞ্চসজ্জা, আলোকনিয়ন্ত্রণ, আবহসংগীত ও পোশাক পরিকল্পনাতেও যুক্ত ছিল।
দ্বাদশ শ্রেণির অনন্যা অদ্রী জাফর অভিনয় করেছে বাঘা চরিত্রে। সে বলেছে, ‘এটি আমার স্কুলজীবনের শেষ নাটক, তাই কাজটি আমার কাছে শুধু অভিনয় নয়, এক আবেগঘন স্মৃতি।’ সহপাঠী নাজমুস সাদাতের আমলকীর রাজার চরিত্রে গাম্ভীর্যপূর্ণ অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। দশম শ্রেণির বর্ণিল মূর্ছনা জানিয়েছে, ‘টানা আড়াই মাসের মহড়া আমাদের জন্য আনন্দের সময় ছিল। এর মধ্য দিয়ে দারুণ বন্ধন তৈরি হয়েছে।’ আর বিন ইয়ামিন খান রিদম বলেছে, ‘বিভিন্ন ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা সত্যিই অসাধারণ।’
সংগীত দলে কাজ করা দ্বাদশ শ্রেণির হৃদিতা বিনতে হাসান বলেছে, ‘অভিভাবকদের সামনে পরিবেশনা করতে পারা ছিল সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত।’
নাটক দিয়ে শেখা
গুপী ও বাঘার সরলতা দেখে ভূতের রাজা তাদের তিনটি বর দেন। এই বরই পরবর্তী সময়ে তাদের শান্তির বার্তাবাহী অভিযানে নিয়ে যায়। যেখানে তারা দুই রাজ্যের যুদ্ধ থামিয়ে প্রতিষ্ঠা করে বন্ধুত্ব ও সংগীতের জয়।
অষ্টম শ্রেণির তাহসিন শ্রেয়াস ভূতের রাজার চরিত্রে অভিনয় করে জানায়, ‘চরিত্রের জন্য মুখে রং মাখা আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।’ সহপাঠী দিনাহ সারাফ গাজী (বরফি চরিত্রে) ও লাইবা হুনাইসা সংগীত দলে নিজেদের দক্ষতা দেখায়।
অষ্টম শ্রেণির আদ্রিয়ান প্রাঞ্জল বলেছে, ‘আমাদের স্কুলে প্রতিবছরই নাটক হয়। গত সেশনে আমরা রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ মঞ্চস্থ করেছিলাম, যা পরে শিশু একাডেমিতে পরিবেশিত হয়।’
স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আরিক উদ্দিন খান তারেক বলেন, ‘এ ধরনের প্ল্যাটফর্মই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে।’
স্কুলের ইভেন্টস ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ম্যানেজার জান্নাত হক বলেন, ‘নাট্যোৎসব স্কলাসটিকার বিস্তৃত শিখনপদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা বিশ্বাস করি, শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চা ছাড়া একটি শিক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব নয়।’
নাটকের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করতে পারবে বলে আশা আয়োজকদের।